সমাজ জীবনের নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা কতটা কঠিন।

একটি ছাত্র। খুব গরীব ঘরের। মা লোকের বাড়িতে কাজ করেন। বাবা রিক্সা চালান বা চায়ের দোকান করেন। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা অন্য কোনো পরীক্ষায় দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করেছে। অথবা সমাজ জীবনের কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আর একটি ছাত্র। ধনী পরিবারের। জীবনে কখনও আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। সেও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা অন্য কোনো পরীক্ষায় দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করেছে। অথবা সমাজ জীবনের কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এবার বলুন আপনি কাকে বেশি কৃতিত্ব দেবেন ? কার গলায় বরমাল্য দেবেন ? অবশ্যই প্রথম জনকে। কেন ? ব্যাপক আর্থিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে সে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে। এ যে কত বড় কৃতিত্ব ! আহা !
আর দ্বিতীয় জন ? ধুর , বাবা তো টাকার কুমীর ! এটা আবার কোনো ব্যাপার হল ! অর্থাৎ যেহেতু অঢেল টাকা পয়সা আছে, তাই ছেলেটির তেমন কোনো কৃতিত্বই নেই। হা হা  !
সত্যিই কি তাই ? আসুন আজ এই বহুল প্রচলিত মিথটিকে একটু কাটা ছেঁড়া করা যাক। গভীরে না যাওয়ার অভ্যাস, সুদীর্ঘ বাম শাসনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচার, তথাকথিত বাংলা সিনেমা/ সিরিয়ালের প্যানপ্যানানি ইত্যাদির যুগল বন্দীতেই এই একদেশদর্শী ভাবনাটির জন্ম। কি ?  আর্থিক বাধাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। তার বিরুদ্ধে লড়াই করে সাফল্য পাওয়াটাই অনেক বড়। বাকি সব রাবিশ।
ভুল বন্ধু ভুল।  কোনো ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে হলে লড়াইটা সবাইকেই করতে হয়। তবে ভিন্ন ভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে। তাই সাফল্যের লড়াইটা একই রকম কঠিন। যে আপনি যে পরিবারেই জন্মান। আসুন একটু ভেবে দেখি।

প্রথম ছেলেটিকে দিয়েই শুরু করা যাক। সে প্রথম থেকেই দারিদ্র দেখেছে। বাবা মায়ের লড়াই দেখেছে। দেখেছে বাবা মা কত লড়াই করে তাঁকে মানুষ করার চেষ্টা করছেন। কত হিসেব করে, খেয়ে না খেয়ে ছেলেকে বই কিনে দিচ্ছেন। প্রাইভেট টিউটর যাতে কমে পড়ান, বা বিনা পয়সায় পড়ান তার জন্য আবেদন নিবেদন, দিন রাত দুশ্চিন্তা কালই পরীক্ষার ফি জমা দিতে হবে ইত্যাদি। এসবই অনস্বীকার্য। এ বড় কঠিন লড়াই। কিন্তু ছেলেটির লক্ষ্য স্থির। তাকে বাবা মার মুখ উজ্জ্বল করতেই হবে। সফল হতেই হবে। তার সামনে আর কোনো প্রলোভন নেই। থাকবেই বা কি করে ? নুন আনতে পান্তা ফুরোনো ঘরে কিসের প্রলোভন ? মা বাবাকে সাহায্য আর পড়াশোনা করা—এই তার একমাত্র কাজ।তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। নইলে বাবা মাকে কে দেখবে ? 
এবার আসি দ্বিতীয় জনের কথায়। না তার আর্থিক কোনো প্রতিবন্ধকা নেই। কোন কিছু চাইতেই হয়না। সব কিছু মজুত। দামী স্মার্ট ফোন, মিউজিক সিস্টেম, প্লে স্টেশন আরও কত কি ! হাজার হাজার টাকার হাত খরচ। অতএব প্রলোভনের পর প্রলোভন। সুন্দরী বান্ধবীর হাতছানি, এক নয় একাধিক। পকেটে অঢেল টাকা থাকলে যা হয়।  নামী দামী স্পোর্টস বাইক। পেছনে ডানা কাটা পরী। এক কথায় পদে পদে বখে যাওয়ার সম্ভাবনা। বাবা মাকে কে দেখবে এমন চিন্তা তাকে করতে হয়না। কারণ চোদ্দ পুরুষ বসে খেলেও সম্পদ শেষ হবেনা। নিজের পায়ে না দাঁড়ালেও তার কিছু যায় আসেনা। গোলাপের পাপড়ির উপর ভেসে থাকা জীবন। তাকে তার মা বাবা দিন পড়তে বসার কথাও বলেন না। তারা সোসাইটি, পার্টি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত।
এবার ভাবতে থাকুন।দ্বিতীয় ছেলেটির লড়াইটিও কত কঠিন। তার সামনে প্রথম ছেলেটির মত কোনো মোটিভেশন নেই। তার লড়াই প্রলোভনের বিরুদ্ধে, বখে যাওয়ার বিরুদ্ধে। নিজের সাথে নিজের লড়াই। এ যে কত কঠিন একমাত্র সেই জানে। প্রথম ছেলেটির পাশে বিপদে আপদে এন জি ও আছে, নেতা মন্ত্রী আছে। আজকাল তো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে অনেক গরীব মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের সাহায্য করা হয়। বিনা পয়সায় পড়ানো, বই খাতা কিনে দেওয়া। এসব তো আছেই। টাকার অভাবে মেধাবী ছাত্রের শিক্ষা আটকে আছে, এমন ঘটনা এখন দুর্লভ। কেউ না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আমিও দিয়েছি। আপনিও দিয়েছেন। অর্থাৎ তার লড়াইয়ে সহানুভূতির অভাব ঘটেনা। তার মোটিভেশনও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 
কিন্তু দ্বিতীয় ছেলেটি ? তার পাশে কে আছে ? কেউ নেই। থাকা সম্ভবও নয়। কারণ তার লড়াইটা নিজের সঙ্গে নিজের।