বাংলাভাগের জন্য এপারের বর্ণহিন্দু 'দাদাবাবু'রা কতটা দায়ী ছিল ?

বাংলাভাগের জন্য এপারের বর্ণহিন্দু ‘দাদাবাবু’রা কতটা দায়ী ছিল ?
———————————————————————–
আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজের এক বৃহদাংশ এবং মাকু কম্যুনিস্টরা দেশভাগের পটভূমিকায় বাংলাভাগের প্রধান কারন হিসাবে এপার বাংলার বর্ণহিন্দুদের সেদিনের অবিভক্ত বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে অস্বীকার করাকেই দায়ী করে। ১৯৩৫ সালে Government of India act, 1935 অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলায় যে Provincial Constitution কার্যকারী ছিল তার আইনসভাতে নির্বাচনী ধারায় যথেষ্ট বৈষম্য ছিল। পাঠক, লক্ষ করে দেখুন অবিভক্ত বাংলার আইনসভার ২৫০টি আসনের বিন্যাস ঃ

১) ১১৭ টা আসন একমাত্র মুসলমান ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত মুসলমান প্রতিনিধিদের জন্য।
২) ৪৮ টা আসন সাধারন পাবলিকের ভোটে নির্বাচিত,বাংলার যে কোন প্রতিনিধির জন্য।
৩) ৩০ টা আসন সাধারন পাবলিকের ভোটে নির্বাচিত হিন্দু তফসিলি ক্যান্ডিডেটদের।
৪) ১৯ টা আসন বাণিজ্যিকদের দ্বারা নির্বাচিত,তাদের ক্যান্ডিডেটদের জন্য।
৫) ১১ টা আসন বাংলায় বসবাসকারী বিদেশিদের দ্বারা নির্বাচিত, তাদের ক্যান্ডিডেটদের জন্য।
৬) ৮ টা আসন শ্রমিক দ্বারা নির্বাচিত, তাদের ক্যান্ডিডেটদের জন্য।
৭) ৫ টা আসন জমিদারদের জমিদারির।
৮) ৩ টা আসন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের।
৯) ২ টো ভারতীয় খ্রীষ্টানদের।
১০) ২ টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১১) ২ টো মহিলাদের।
১২) ২ টো মুসলমান মহিলাদের।
১৩) ১ টা অ্যাংলোইন্ডিয়ান মহিলাদের।

তাহলে দাঁড়াল কি সেদিনের বাস্তবতায় ? বাঙ্গালী হিন্দুরা ম্যাক্সিমাম ১১৭ টা আসনে নির্বাচন লড়তে অনুমোদন পেয়েছিল,তার মধ্যে ৩০টি তফসিলিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এবারে উলটোদিকে বাঙ্গালী মুসলমানরা ম্যাক্সিমাম ২০৩ টা আসনে নির্বাচন লড়তে অনুমোদন পেয়েছিল,যার মধ্যে ১১৭ টা আসনের প্রার্থী, শুধুমাত্র মুসলমান ভোটারদের ভোটেই নির্বাচিত হবে ! ১৯৩১ সালে জনসংখ্যা গণনার হিসেব বলছে অবিভক্ত বাংলায় মোট জনসংখ্যার ৫২% থেকে ৫৪% মুসলমান ছিল। তাহলে পাঠক, জনসংখ্যা গণনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০৩ – ১১৭ আসনের বিন্যাস একতরফা অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রনোদিত ! ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ১১৭ আসনের সবকটাতে বাংলার হিন্দুরা না জিততে পারলেও জাতীয় কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আইনসভায় উঠে আসে। এরপরে ছিল মুসলিম লিগ এবং তৃতীয় স্থানে ছিল ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি। কংগ্রেস কোয়ালিশান সরকার গড়তে অস্বীকার করেছিল আর তাই কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লিগ কোয়ালিশান সরকার গড়ে। কৃষক প্রজা পার্টি প্রথমে মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িয়ে পরলেও,১৯৪১-এ মুসলিগের লিগের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসে তবুও বাংলাভাগের প্রক্রিয়া আর রোখা সম্ভব হয়নি,কারণ ততদিনে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির বাঙালি মুসলমান কর্মীরা বেশ অনেকেই মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছে, হাজার হোক ফুলের মত নিষ্পাপ নবীর উম্মত বলে কথা ! বর্ণহিন্দু ও তফসিলি হিন্দু প্রতিনিধিরাও ক্ষমতার লোভে ব্রিটিশ সমর্থিত লীগ মন্ত্রীসভায় জগ দিয়েছিল যেমন যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল। কংগ্রেসের ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক স্বার্থপরতা অবিভক্ত বাংলার বাঙ্গালিকে মুসলিম লীগের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা তুলতে দেয়নি অথচ আসামে কংগ্রেস কোয়ালিশান সরকারে গিয়ে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছিল এবং আসামের ঐক্য বজায় ছিল।

হিন্দু বাঙালি তাও চুপ ছিল বাংলা জাতে ভাগ না হয় ! সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে বলপ্রয়োগ করে ১৯৪৩ সালে ফজলুল হককে পদত্যাগ করায় ব্রিটিশ সরকার। মুসলিম লিগ ১৯৪৬-এর নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করে এই ব্রিটিশদের সাহায্যেই ! সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ১২১টি করা হল এবার আর মুসলিম লিগ জিতল ১১৪ টাতে। বিদেশি ও অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো কম্প্রমাইস করে লিগ সরকারকে গদিতে বসালো ব্রিটিশ। এরপরে বাংলা ভাগের কাছে মাথা নতজানু করা ছাড়া অবিভক্ত বাংলার বাঙালি হিন্দুর কোনও অপশন ছিলনা !