পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি বিরোধের কাছে নতি স্বীকার করেছে ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচের পর পাকিস্তানিরা নিজেদের খেলোয়াড় হাসান আলিকে বাজেভাবে ট্রোল করেছে। তিনি একজন শিয়া মুসলিম বলে ট্রোলড হয়েছেন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ ছিল পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। কিন্তু খেলার শেষ নাগাদ এই ম্যাচটি শিয়া-সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে খেলায় পরিণত হয়। যেখানে পাকিস্তানের সুন্নি মুসলমানরা তাদের নিজের খেলোয়াড় হাসান আলীর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণ্য ছড়িয়েছে। কারণ তিনি একজন শিয়া মুসলিম।
হাসান আলীকে নিয়ে পাকিস্তানে এখনো ট্রোলড হচ্ছেন, তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে আপত্তিকর কথা। এটাও বলা হচ্ছে যে গত ম্যাচ চলাকালীন, তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ম্যাথিউ ওয়েডের ক্যাচ মিস করেছিলেন কারণ তিনি একজন শিয়া মুসলিম হওয়ায় সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ অর্থাৎ পাকিস্তানের জয় সহ্য করতে পারেননি।
শিয়া-সুন্নি বিরোধ: শিয়া হাসান আলীকে দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে
২৭ বছর বয়সী হাসান আলী যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের হয়ে ৮ বছরে ২০৯ উইকেট নিয়েছিলেন । 2017 সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন। একই পাকিস্তানের মানুষ একদিন তাকে শিয়া মুসলমান বলে দেশদ্রোহী প্রমাণ করবে, সেটা হয় তো হাসান আলী নিজেও কল্পনা করতে পারেনি।
পাকিস্তানে হাসান আলীর প্রতি এই ঘৃণার একটি কারণও তার ভারত সংযোগ। হাসান আসলির স্ত্রী শামিয়া আরজু হরিয়ানার মেওয়াতের বাসিন্দা। এ কারণেই গত ম্যাচের পরাজয়ের জন্য পাকিস্তানে তাকে টার্গেট করা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে গালিগালাজ করা হয়।
আপনার মনে থাকবে এই বিশ্বকাপে ভারতের দল যখন পাকিস্তানের কাছে হেরেছিল, তখন মহম্মদ শামিকে নিয়ে পাকিস্তানের থেকে বিভিন্ন সামাজিরক ফেক একাউন্ট থেকে ট্রোলিং হয়েছিল এমন কি তাদের সুরে ভারেতের ভিতর থেকেও সেই ঘৃন্নাকে উসকে দেওয়া হয়েছিল। যা ভারতে ক্রিকেটের বিরুদ্ধে এক ধরনে সড়যন্ত্র ছিল। সে সময় পাকিস্তানের মিডিয়া এবং তার খেলোয়াড়রা ভারতের জনগণ ও ক্রীড়াবিদদের খেলোয়াড়দের সম্মান করার পরামর্শ দিয়েছিল। ম্যাচের মাঝখানে, পাকিস্তানি খেলোয়াড় মোহাম্মদ রিজওয়ান, মোহাম্মদ শামির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে টুইটারে লিখেছেন যে ক্রিকেট খেলা মানুষকে ভাঙতে নয়, যোগ দিতে শেখায়।
শিয়া-সুন্নি বিরোধ: নীরবতা অবলম্বন করেন মোহাম্মদ রিজওয়ান
হাসান আলি যখন একই ধরনের ট্রোলিং করেছিলেন এবং তাকে শিয়া মুসলিম হওয়ার জন্য খারাপ বলা হয়েছিল, তখন মোহাম্মদ রিজওয়ান তার সমর্থনে একটি টুইটও করেননি। এর চেয়ে মজার আর কী হতে পারে ভেবে দেখুন?
শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ ইসলামের মতোই পুরনো। সপ্তম শতাব্দীতে নবী মুহাম্মদ যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন প্রশ্ন উঠেছিল যে এখন ইসলামের প্রতিনিধি কে হবেন? যে মুসলিমরা আবু বকরকে নবী মুহাম্মদের উত্তরসূরি বলে মনে করত তারা সুন্নি মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হত। তাদের জন্য আবু বকর ইসলামের প্রথম খলিফা হয়েছিলেন। যে সমস্ত মুসলিমরা নবী মুহাম্মদের জামাতা হযরত আলীকে তাঁর উত্তরসূরি বলে মনে করত, সেই মুসলমানদেরকে শিয়া বলা হত। তার জন্য হযরত আলী ইসলামের প্রথম ইমাম হন।
বছরের পর বছর ধরে চলছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব
তখন থেকেই ইসলাম ধর্মে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মুসলিম সুন্নি। সেই সাথে শিয়া মুসলমানদের জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। ইরান, ইরাক ও লেবাননের মতো কয়েকটি দেশই শিয়া অধ্যুষিত।
ইরানের পর সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি শিয়া মুসলিম রয়েছে পাকিস্তানে, যেখানে তাদের জনসংখ্যা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান আন্দোলনে শিয়া মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে একজন শিয়া মুসলিম ছিলেন, যিনি ভারত ভাগের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। এটা বলা পরিহাস হবে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল একজন শিয়া নেতার কারণে, কিন্তু তারা কখনই শিয়া মুসলমানদের গ্রহণ করেনি।
শিয়া-সুন্নি বিরোধ: পাকিস্তানে ৫ হাজার শিয়া নিহত হয়েছে
2001 থেকে 2018 সালের মধ্যে পাকিস্তানে 5 হাজার শিয়া মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। এটা দেখায় যে পাকিস্তানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যতটা ঘৃণা, শিয়া মুসলমানদের প্রতিও ততটা ঘৃণা। সম্ভবত এই কারণেই পাকিস্তানি খেলোয়াড় শাহীন আফ্রিদির ট্রোলিং নেই, যিনি একই ওভারে পরপর তিনটি ছক্কা দিয়েছিলেন তিনি একজন সুন্নি মুসলিম। কিন্তু হাসান আলী তার সম্প্রদায়কে ঘৃণা করা হলো। এতে পাকিস্তানের মিডিয়া ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও পিছিয়ে নেই।
পাকিস্তানে পরজয় কি ইসলাম পরাজয়?
আপনাদের মনে থাকবে পাকিস্তান যখন ভারতকে পরাজিত করেছিল, তখন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ এই জয়কে ইসলামের বিজয় বলে অভিহিত করেছিলেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাকিস্তান হেরে গিয়েছে তারা কি এটাকে ইসলামের পরাজয় মনে করবে?
পাকিস্তান কি এখন বলবে যে গত ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ইসলাম ধর্মকে পাঁচ উইকেটে হারিয়েছে? পাকিস্তান দলের অধিনায়ক বাবর আজমও সম্ভবত ভয় পেয়েছিলেন যে দলের খেলোয়াড়রা হাসান আলিকে টার্গেট করতে পারে। সম্ভবত সে কারণেই তিনি পরাজয়ের পর সব খেলোয়াড়কে বলেছিলেন, এর জন্য কেউ একে অপরকে কিছু বলবে না।