প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা: আমাদের সভ্যতা ও শিকড়ে ফিরে যেতে হবে। আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা বিশ্বের অন্যতম গৌরবময় ও সমৃদ্ধ সভ্যতা। পৃথিবীর বহু দেশে যখন বর্বরতার যুগ চলছিল, সেই সময়েও আমাদের ভারতীয় সভ্যতা তুঙ্গে।
এর প্রধান কারণ শিক্ষা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছেন। শিক্ষার মাধ্যমেই জীবনের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। ভারতবর্ষের এই পবিত্র ভূমিতে বেদ ও পুরাণ রচিত হয়েছে এবং এ সবই সম্ভব হয়েছে শিক্ষার কারণে। একজন মানুষের জন্য বাতাস, জল ও খাদ্য যতটা প্রয়োজনীয়, শিক্ষাও ততটাই প্রয়োজনীয়। শিক্ষা ছাড়া মানুষ পশুর মতো।
বিদ্যা নাম নরস্য রূপমাধিকম প্রচ্ছন্নগুপ্তম ধনম্।
বিদ্যা ভোগকারি যশ: সুখকারি বিদ্যা গুরুনান গুরু:।
বিদ্যা বন্ধুজানো বিদেশগমনে বিদ্যা পরম দৈবতম।
বিদ্যা রাজসু পূজ্যতে ন হি ধন বিদ্যাবিহীনঃ পশু।
অর্থাৎ জ্ঞান হলো মানুষের একটি বিশেষ রূপ, জ্ঞান হলো গোপন সম্পদ। জ্ঞান ভোগদাতা, খ্যাতিদাতা ও কল্যাণদাতা। বিদ্যা শিক্ষকদের শিক্ষিকা। বিদ্যা হল দেবতা। রাজাদের কাছে জ্ঞানের পূজা হয়, অর্থের নয়। জ্ঞানহীন মানুষ পশু।
নিঃসন্দেহে যে কোনো সভ্য সমাজের জন্য শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা শুধু জীবিকা অর্জনের জন্য নয়, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগত সনদ নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পাওয়া যায় ঠিক, কিন্তু শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল একজন মানুষের সমগ্র জীবনকে বিকশিত করা। আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। একজন শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা:
বিদ্যা বিতার্ক বিজ্ঞান সমিতি: প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
যস্যতে শদগুণস্তস্য নাসাধ্যমতিবর্ততে।
অর্থাৎ জ্ঞান, যুক্তি, বিজ্ঞান, স্মৃতিশক্তি, তৎপরতা ও কর্মদক্ষতা এই ছয়টি গুণ যার আছে তার পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। বিদ্যা বা শিক্ষা সেই আলোর উৎস, যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু চাকরি পাওয়া পর্যন্তই হয়ে ওঠছে। দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা উঠে আসছে এবং এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে, যাতে শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন করা যায়। এর পাশাপাশি শিশুদের কাঁধে স্কুল ব্যাগের বোঝা কিছুটা কমানো যেতে পারে।
উন্নত শিক্ষার জন্য চরিত্র গঠন ও মানবিক গুণাবলির বিকাশের বিষয়গুলোও পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয় শুধুমাত্র মানুষের বৈষয়িক উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু শিল্পগত উন্নতির সাথে সাথে মানবিক মূল্যবোধেরও বিকাশ ঘটাতে হবে, যাতে নাগরিকরা সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ অর্জন করতে পারে।
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা:
বর্তমান যুগে মানুষ যেমন বৈষয়িকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তেমনি জীবনের মূল্যবোধকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে পারস্পরিক পারিবারিক বন্ধন। কেউ কাউকে নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। পরিবারের বড়দের বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হয় এবং শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। গ্রামের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে মহানগরে ছোট ছোট ঘরে শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করাকেই মানুষ জীবনে সফলতা মনে করেছে।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন করা সম্ভব বলে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মানুষের জীবন – মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। আজ একজন ব্যক্তি চরিত্রের চেয়ে অর্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এতে তার নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজে দিন দিন অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা:
সেজন্য পাঠ্যসূচিতে এমন পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে মানুষের নৈতিক বিকাশ হয় এবং তা সভ্য সমাজ গঠনে সহায়ক হতে পারে। নিঃসন্দেহে এটা করার জন্য শিক্ষা সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। প্রচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল, দয়াবান, সহানুভূতি, এবং সাহসের অধিকারী এমন গুণী মানুষদের বিকাশ করা। যারা নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ, যাদের কাছে মানবিক মূল্যবোধই প্রধান।
শিক্ষার প্রথম লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে চরিত্র গঠনে সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার লক্ষ্য শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করা উচিত নয়। শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাত্মক বিকাশ, যাতে সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বেড়ে উঠতে পারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীকে তার অধিকারের পাশাপাশি তার কর্তব্য সম্পর্কে জানানো, যাতে সে তার অধিকার অর্জন করতে পারে এবং পরিবার ও সমাজের প্রতি তার কর্তব্যও পালন করতে পারে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সমৃদ্ধ করা। শিক্ষার মাধ্যমে সে তার জীবনকে সহজ, উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের বর্ণমালা জ্ঞানের পাশাপাশি বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যাতে তারাও নিজ নিজ কাজে পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে। নৈতিকতায় পরিপূর্ণ চরিত্রবান ব্যক্তিই তার পরিবার ও দেশের নাম সমুন্নত করে।
মূলত, শিক্ষার উদ্দেশ্য দুটিই, প্রথমত, শিক্ষা লাভের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সমৃদ্ধি লাভ করে এবং সুখে জীবনযাপন করা এবং দ্বিতীয়ত, সে যেন অন্যকে সুখ ও সাহায্য করতে সক্ষম হবে। ছোট ক্লাস থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার পুরো উদ্দেশ্য এটাই। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে, আমরা আরাম-আয়েশ ও সুযোগ-সুবিধাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেছি।
আজ উচ্চশিক্ষা লাভ করার মানে, তার মাধ্যমে উচ্চ পদ লাভ করে। অতঃপর অঢেল সম্পদ সংগ্রহই জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠছে। এই দৌড়ে মানবিক মূল্যবোধ ক্রমাগত অবক্ষয় হচ্ছে। তাই আমাদের প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে এই ব্যবস্থা সাজিয়ে তুলতে হবে নতুন প্রজন্মনের জন।