ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের প্রতি বাংলাদেশিদের এত ঘৃণা পোষণ করার কারণ কি??? ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বাংলাদেশ ক্রিকেটের কি কি ক্ষতি করেছে যার কারণে তারা ইন্ডিয়া টিমের প্রতি এতখানি ঘৃণা পোষণ করেন- এরকম প্রশ্ন আমি বেশ কয়েকজনকে করেছিলাম। দুই রকম উত্তর পেয়েছি।
প্রথমটা সাধারণ দোকানদার, মুদিঅলা, চাঅলা, ড্রাইভার… তাদের উত্তর ছিলো, বাংলাদেশ যখন ভারতের সঙ্গে প্রায় জিতে যায় তখন নরেন্দ মোদী শেখ হাসিনাকে ফোন করে বাংলাদেশকে হারতে বলে।
যদি বাংলাদেশ না হারে তাহলে ভারত বাংলাদেশ সরকারের ক্ষতি করে দিবে বলে সাবধান করে দেয়…। দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে ব্যাংকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণীর পেশার মানুষ। তাদের উত্তরটি এরকম: ভারতের ম্যাচের সময় আইসিসি থেকে আম্পায়ারদের আগেই নির্দেশ দেয়া থাকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাজে সিদ্ধান্ত দেয়ার।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ও আইসিসি মিলে আগেই ঠিক করে দেয় ম্যাচে ভারতকে যেভাবেই হোক জিতিয়ে দিতে হবে…।
যতই হাস্যকর হোক এগুলো হচ্ছে ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের প্রতি বাংলাদেশীদের বিদ্বেষ ঘৃণার অকাট্ট কারণ! আসলে বাংলাদেশের ভারতকে ঘৃণা করার কারণ ইমরান খানের কথাতে বুঝতে সহজ হবে। ইমরান খান তার ইন্টারভিউতে বলেছিলেন তার প্রথম বাংলাদেশ সফরে গিয়ে তিনি বাংলাদেশীদের সমর্থন দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন।
ক্রিকেট যখন ধর্মের হাতিয়ার: ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের “জয়” ইসলামের বিজয় হলে পরাজয়টা কি??
ইন্ডিয়ান ক্রিকেট
তিনি ভেবেছিলেন যুদ্ধের পর প্রথম পাকিস্তান সফরকে বাংলাদেশ মানুষ তাদেরকে অপছন্দ করবে। কিন্তু তিনি গিয়ে দেখেন রাস্তার দুইপাশে হাজার হাজার মানুষ পাকিস্তান পাকিস্তান বলে চিৎকার করছিলো!… ঢাকার মাঠে ভারত পাকিস্তান ম্যাচে একচেটিয়া পাকিস্তান সমর্থন, ওয়াশিম আক্রামের বাংলাদেশকে হোমগ্রাউন্ড সাপোর্টের কারণে সেকেন্ড হোমগ্রাউন্ড বলা থেকেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখার আগের চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
সারজায় মিয়াদাদের শেষ বলে ভারতের বিপক্ষে ৬ মেরে জিতে যাবার পর পাড়া মহল্লায় উল্লাস মিছিল কি মিথ্যে হয়ে যাবে? না, ইতিহাসকে কেউ মিথ্যে বানাতে পারবে না। ৬৪-৬৫ সালে ঢাকার পল্টন গুলিস্তানে ‘ভারতের দালাল’ বলে রোজই কাউকে না কাউকেই ধোলাই দেয়া হতো।
এসব ধোলাই দিতে যারা জাতক্রোধ নিয়ে এগিয়ে আসতেন সেইসব সাধারণ মানুষই ৭১ সালে সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতেই আশ্রয় নিয়েছিলো। ৯ মাস ভারতের চাল ডাল খেয়ে, ভারতের সৈন্যদের সহায়তায়, ইন্দিরা গান্ধির রাজনীতিতে ভর করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে বর্ডার পার হয়েই দাবী করতে থাকে, ভারত আমাদের ট্যাংক, গোলাবারুদ, অস্ত্র সব লুট করে নিয়ে গেছে…।
বাংলাদেশের লেখক সাহিত্যিকদের প্রায় সবাই ভারত বিরোধী হয়। কারণটা হচ্ছে হিন্দুরা ভালো উপন্যাস গল্প কবিতা লিখতে পারে। এসব রচনা আবার বাংলাদেশর ভারত বিরোধী পাঠকরাও গ্রোগ্রাসে গিলে। যেমন ভারত বিরোধী হবার পর ভারতীয় সিনেমা, টিভি চ্যানেল গিলতে তাদের সমস্যা হয় না।
তবে ক্রিকেটে যেহেতু দেশ পরিচয়ের একটা ব্যাপার আছে, তাই সেখানেই সবটুকু ধর্ম ঢেলে দিয়ে মনের বিষ মেটানো যায়। বাংলাদেশের ভারত বিরোধীতা পরিস্কারভাবে হিন্দু বিরোধীতা। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এখানে পাকিস্তানের দাবী তুলে হিন্দুদের খেদানো হয়েছিলো।
হিন্দুরা সেসব মনে রাখেনি। রাখলে ৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ফ্রি বাস-ট্রামে চলাচল, চা খেলে পয়সা নিতো না- মাসির দেশ বলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে কাছে টেনে নেয়া, দেশভাগের ক্ষোভ তারা মনে পুষে রাখেনি। ভারতের বুদ্ধিজীবীরা, সুনীল, ঋত্বিক, মৃণালদের মত বুদ্ধিজীবীরা রাস্তা প্লেকার্ড হাতে নিয়ে অর্থ তুলেছিলো।
এরা সকলেই নিজের দেশ হারিয়েছিলো কারণ এখানে ‘মুসলমানদের দেশ’ কায়েম হবে। তবু তাদের মনে কত ভালোবাসা ছিলো। অথচ আজ যখন আমাদের সাহিত্যিকদের ফেইসবুক পোস্ট দেখি, সেলিব্রেটিদের পোস্ট, তারা লিখছে, ‘দাদাদের অনুভূতি জানতে চাইছি’।
মানে কাল ভারত নিউজিল্যান্ডের কাছে হারার পর ‘দাদাদের কাছে অনুভূতি জানতে চাইছে।‘দাদাদের’ মানেটা কি? ‘দাদা’ কারা ডাকে? এটা বাঙালীদের সম্বধন। বাঙালী হিন্দু বড় ভাইকে দাদা ডাকে। এক সময় বাঙালী মুসলমানও বড় ভাইকে দাদা ডাকত। এখন ‘দাদা’ ‘দাদাবাবু’ ‘দিদি’ হচ্ছে চরম হিন্দুত্বের প্রতীক! কারণ আমরা মুসলমান!
ইন্ডিয়ান ক্রিকেট
কোলকাতার ক্লাবগুলোতে এবারের বিশ্বকাপের সময়ও দেখা গেছে বাংলাদেশের চার ছয়ের মারে সেকি উল্লাস! কারণটা এখানে যেটা কাজ করে, ‘বাংলাদেশ’ বহু পশ্চিমবঙ্গীয়দের বাপ-দাদার দেশ ছিলো, দ্বিতীয়ত পশ্চিমবঙ্গীয়দের কাছে হিন্দুর চাইতে নানা কারণে প্রতিদিন ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ বেশি কাজ করে কারণ তাদের প্রতিদিনের জীবনে বহু জাতির সঙ্গে লড়াই করতে হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের ভারত বিরোধীতা পরিস্কারভাবে হিন্দু বিরোধীতা। যারা সাধারণ মুসলমান, তাদের মধ্যে ভন্ডামী কম। তারা ভারতকে গালাগালি করতে গিয়ে শুরুতেই হিন্দুদের নাম নিয়ে কুর্ৎসিত গালি দেয়। বাংলাদেশর চায়ের দোকানগুলোতে ভারতের ক্রিকেট খেলা থাকলে ভারতীয় ক্রিকেটারদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে গালাগালি শুনতে সবাই অভ্যস্ত।
যদি কোন হিন্দু পরিচয়ের মানুষ সেখানে থাকেন, তাহলে তিনি অবধারিতভাবে ‘ভারতের দালাল’। তাকে ঠেস দিয়ে কথা শুনাতে কেউ ছাড়বে না। ‘ভারতের দালাল’ এখনো বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কালচার।
এবার একটু ক্রিকেটে ফিরি। সাফ প্রশ্ন আপনাদের কাছে, ভারতীয় ক্রিকেট ঠিক কিভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চরম ক্ষতি করেছে তার কিছু প্রমাণ হাজির করুন। ভারত, ইংলেন্ড তিন মোড়লের দুই মোড়ল- তবু ইংলেন্ড আজ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে পারেনি।
ভারত জিতেছে দুইবার। প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ার রেকর্ডও আছে। ভারত দ্রুত টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়লে ক্রিকেটের রোজগার কমে যায়। এটা চিরন্তর সত্য ক্রিকেটের জন্য। এ কারণে ভারতকে জোর করে গায়ের জোরে জিতিয়ে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যাবার কোন প্রমাণ কি বাংলাদেশী মুসলমানদের কাছে আছে?
অস্ট্রেলিয়া ৫ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তারা জোর করে বা চুরি করে জিতেছে এমন দাবী কোন বাংলাদেশী মুসলমান করে না। যদিও তারা ক্রিকেটের মোড়ল! বাজে আম্পায়ারিংয়ের শিকার কি কেবল বাংলাদেশের ম্যাচে ঘটে নাকি সেটা ভারতের ম্যাচে ভারতীয় ক্রিকেটারও শিকার হন? ‘
ভারতকে বিশেষ সুবিধান দেয়া হয়’ এরকম অকাট্টা কোন প্রমাণ যদি ক্রিকেটে থাকে তাহলে আইসিসি সভায় বিভিন্ন দেশের কোর্ড সেটা প্রমাণ করে দেখায় না কেন?
ক্রিকেটের ৯৫ ভাগ অর্থ আসে ভারতীয় ক্রিকেট থেকে। সেই অর্থ যদি সবাই সমান করে ভাগ করে নেয়া দাবী তুলে তাহলে ভারত যে অর্থ পাবে একই অর্থ নেপালকেও দিতে হবে!
বিপুল অর্থ ভারতীয় ক্রিকেট থেকে আসার কারণে ক্রিকেটে ভারতের মর্যাদা প্রভাব বেশি। তবে সেটা সংগঠনিকভাবেই সত্য। ক্রিকেট মাঠে খেলেই জিততে হবে ভারতকে। যারা খেলে জিতে পারে না- তারাই নানা রকম ষড়যন্ত্রের দাবী তুলে।