বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কুস্তিগির ও ভারোত্তলক ভীম ভবানী।

বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কুস্তিগির ও ভারোত্তলক ভীম ভবানী। ভবেন্দ্রমোহন সাহা (১৮৯০ – ১৯২২) বা ভীম ভবানী বা ভীমমূর্তী ছিলেন একজন ভারতীয় কুস্তিগীর ও ভারোত্তলক।তিনি প্রফেসর রামমূর্তী নাইডুর কাছে শরীরচর্চা শিক্ষা করেন এবং তার সাথে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে তার শারীরিক শক্তির পরিচয় দেন।

পরে প্রফেসর বসাকের হিপোড্রোম সার্কাসের সাথে এশিয়া যাত্রা করেন ও তার কৃতিত্বের পরিচয় দেন। জাপান সম্রাট (মিকাডো) তার শারীরিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে স্বর্ণপদক দান করেন। বুকের উপর হাতী তোলার জন্য তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হন। সমসাময়িক কালে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় শরীরচর্চা ও তজ্জনিত সুস্থ ও বলিষ্ঠ দেহের প্রয়োজনীয়্তা অনুভূত হলে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
কলকাতায় স্বদেশী মেলায় অমৃতলাল বসু তাকে ‘ভীম ভবানী’ আখ্যা দেন। পশ্চিম ভারতে তিনি ‘ভীমমূর্তী’ নামে খ্যাত ছিলেন।

বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কুস্তিগির ও ভারোত্তলক ভীম ভবানী
বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কুস্তিগির ও ভারোত্তলক ভীম ভবানী
ভবেন্দ্রমোহন সাহা ছিলেন কলকাতার বিডন স্ট্রীটের বর্ধিষ্ণু সাহা পরিবারের সন্তান। তার পিতা উপেন্দ্রমোহন সাহা মতান্তরে উপেন্দ্রনাথ সাহা ছিলেন বলিষ্ঠ পুরুষ। ১৮৯০ সালে ভবেন্দ্রমোহনের জন্ম।তিনি ছিলেন পিতার নয় পুত্রের মধ্যে পঞ্চম। ভবেন্দ্রমোহন ছোট থেকেই ভবানী বলে পরিচিত ছিলেন।
বাল্যকালে ভবানী সম্ভবতঃ অতীন্দ্রকৃষ্ণ বসুর আখড়াতেই প্রথম ব্যায়াম শিক্ষা শুরু করেন। অতীন্দ্রকৃষ্ণ বসু ওরফে ক্ষুদিবাবু ভবিষ্যতে সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। শরীরচর্চার পাশাপাশি ক্ষুদিবাবুর কাছেই বিদ্যাশিক্ষাও আরম্ভ করেন। কৈশোরে ভবানী ম্যালেরিয়ার কবলে পড়েন।
১৪-১৫ বছর বয়স অবধি তিনি ম্যালেরিয়ায় ভুগে শীর্ণকায় হয়ে পড়েন।তখনকার দিনের বিখ্যাত ওষুধ ডিঃ গুপ্ত খেয়ে তিনি আরোগ্যলাভ করেন কিন্তু তার শারীরিক দুর্বলতার কোন উন্নতি হয়না। এমন সময়ে একদিন ভবানীর সমবয়সী একটি ছেলে তাকে বেদম প্রহার করে। এই ঘটনার পর ভবানীর মনে নিজের প্রতি ধিক্কার আসে এবং তিনি শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মনে মনে সংকল্প করেন।
তিনি ক্ষুদিবাবুর কাছে কুস্তি শেখেন এবং অল্প বয়েসেই বহু পালোয়ানকে পরাস্ত করেন। এরপর তিনি উত্তম রূপে কুস্তি শিক্ষা করার জন্য দর্জিপাড়ায় ক্ষেতুবাবুর আখড়ায় ভর্তি হন। সেই সময়ে ক্ষেতুবাবুর আখড়া ছিল ভারতবর্ষে কুস্তির পীঠস্থান। বলা হত ভারতে এমন কোন কুস্তিগীর ছিলেন না যিনি ক্ষেতুবাবুর আখড়ার মাটি গায়ে মাখেননি।
উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে প্রত্যহ ভবানী কুস্তি শিক্ষা করতে থাকেন। চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তার স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি হয়।
ভবেন্দ্রমোহনের যখন ১৯ বছর বয়স তখন ভারতের প্রসিদ্ধ কুস্তিগীর প্রফেসর রামমূর্তী তার সার্কাসের দল নিয়ে কলকাতায় খেলা দেখাতে আসেন। ভবেন্দ্রমোহন খেলা দেখতে গিয়ে দেখেন সার্কাসের তাঁবুর আশেপাশে তিলধারণের জায়গা নেই। তিনি ইতস্ততঃ ঘুরছেন, এমন সময় প্রফেসর রামমূর্তী স্বয়ং তার সাথে এসে পরিচয় করেন।
তিনি ভবেন্দ্রমোহনের দেহ সৌষ্ঠব দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে চান। ভবেন্দ্রমোহন বাড়িতে কাউকে এ কথা জানান নি। তার পিতা তখন প্রয়াত, তিনি ভেবেছিলেন মাকে সার্কাসে চাকরির কথা বললে মা কখনই রাজি হবেন না। তারপর এক দিন রাতের বেলা বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রফেসর রামমূর্তীর সার্কাসের দলে যোগ দিয়ে রেঙ্গুনে পাড়ি দেন।
প্রফেসর রামমূর্তীর সাথে তিনি রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর হয়ে জাভায় পৌঁছন। সেখানে জনৈক ওলন্দাজ কুস্তিগীর প্রফেসর রামমূর্তীর সাথে কুস্তি লড়তে চাইলে, ভবেন্দ্রমোহন তার গুরুকে প্রস্তাব দেন যে আগুন্তুক যেন প্রথমে তার সাথে লড়েন। তাকে পরাজিত করতে পারলে তবেই প্রফেসর রামমূর্তী স্বয়ং লড়বেন।
রামমূর্তী তাতে রাজি হন। ভবেন্দ্রমোহন জনৈক ওলন্দাজ ব্যক্তিকে তিন মিনিটের মধ্যে পরাজিত করেন। ভবেন্দ্রমোহন প্রফেসর রামমূর্তীর সার্কাসে বেশী দিন থাকেননি। সেখানে স্বাধীনভাবে খেলা দেখানোর তেমন সুযোগ তিনি পাচ্ছিলেন না। শীঘ্রই তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং কিছু কাল প্রফেসর বোসের সার্কাসে খেলা দেখাতে থাকেন ।
তারপর তিনি প্রফেসর কে বসাকের বিশ্ববিখ্যাত হিপোড্রোম সার্কাসে যোগ দেন। সেখানে তিনি স্বাধীনভাবে খেলা দেখাবার সুযোগ পান। তার দৈহিক শক্তির প্রদর্শন দর্শকদের বিস্মিত করে তোলে। তিনি পাঁচ মণ ওজনের বারবেল অনায়াসে ভাঁজতেন।
সিমেন্টের পিপের উপর পাঁচ সাত জন লোককে বসিয়ে, সেই পিপে দাঁত দিয়ে কামড়ে শূন্যে তুলে ঘোরাতেন। বুকের উপর ৪০ মণ ওজনের পাথর চাপিয়ে তার উপর ২০-২৫ জন লোকের বসার ব্যবস্থা করতেন। তারা খেয়াল খাম্বাজ গাইত। তিনি লোহার শেকলে আবদ্ধ থেকেও তার মট্‌মট্‌ করে ভেঙে ফেলতেন।
তার বুক ও উরুর উপর দিয়ে একসাথে দু’টি গরুর গাড়ি যেতে পারত। প্রতিটিতে ৫০ জন লোক থাকত। তিনি দু’খানা চলন্ত মোটর গাড়ীকে আটকে রাখতে পারতেন।
ভবেন্দ্রমোহন প্রফেসর কে বসাকের হিপোড্রোম সার্কাসের সঙ্গে এশিয়া ভ্রমণ করেন। সিঙ্গাপুরে তিনি জি সি হাইডের সাথে কুস্তি লড়েন। চীনে সাংহাইতে বেন ফাসমার নামক জনৈক মার্কিন পালোয়ান ১০০০ ডলার বাজীতে তাকে কুস্তিতে আহ্বান করেন। কুস্তিতে মার্কিন পালোয়ান পরাজিত হন এবং শর্ত অনুযায়ী ১০০০ ডলার দিতে বাধ্য হন।
প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তিনি ভবেন্দ্রমোহনের প্রাণনাশের চেষ্টা করলে ভবেন্দ্রমোহন সাংহাইয়ের কন্‌সালের শরণাপন্ন হন। কন্‌সালের হস্তক্ষেপে ভবেন্দ্রমোহনের প্রাণরক্ষা হয়। এরপর কন্‌সাল নিজে ভবেন্দ্রমোহনের শক্তি পরীক্ষা করতে চান। ঠিক হয় কন্‌সাল মোটর গাড়ি চালাবেন এবং ভবেন্দ্রমোহন যদি তা থামাতে পারেন, তা হলে গাড়ী তার হবে।
ভবেন্দ্রমোহন কন্‌সালের চলন্ত মিনার্ভা মোটর গাড়ীকে থামাতে সক্ষম হন এবং সেটি পুরস্কার রূপে পান। জাপান ভ্রমণকালে সম্রাট মাৎসুহিতো তার দৈহিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে একটি স্বর্ণপদক ও ৭৫০ টাকা পুরস্কার দেন।
এরপর ভবেন্দ্রমোহন দেশে ফিরে আসেন এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তার শারীরিক ক্ষমতার প্রদর্শন করেন। ভরতপুরের মহরাজা তাকে তিনটি মোটর গাড়ি থামাবার আহ্বান জানান এবং ১০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। কথা মত তিনটি মোটর গাড়ীতে যথাক্রমে মহরাজা, তার রাজ্যের রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রী চেপে বসলেন।
ভবেন্দ্রমোহন গাড়ীগুলোর পেছনে মোটা দড়ি বেঁধে অন্য প্রান্তগুলির দু’টি তার হাতে ও অন্যটি নিজের কোমরে শক্ত করে বাঁধলেন। ভবেন্দ্রমোহন ইঙ্গিত করলেই তারা তিনজন একযোগে গাড়ীর এঞ্জিন চালু করলেন, কিন্তু একটি গাড়ীও এক চুল নড়ল না। আর একবার মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন নবাবের হাতীশালে একটি বুনো হাতী আনা হয়, উচ্চতায় নয় ফুট সাত ইঞ্চি। নবাব ভবেন্দ্রমোহনকে হাতীটা বুকের উপর নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। ভবেন্দ্রমোহন প্রফেসর রামমূর্তীর কাছে সার্কাসের পোষ মানানো হাতী বুকে তোলার কৌশল শিখেছিলেন। তার হাতী তোলার একটা বিশেষত্ব ছিল।
সাধারণতঃ ভারোত্তলকদের বুকের উপর একটি কাঠের তক্তা নির্মিত সেতু ঢালু করে রাখা রাখত এবং তার উপর দিয়ে হাতী হেঁটে চলে যেত। কিন্তু ভবানীর ক্ষেত্রে হাতীটা তক্তা নির্মিত সেতুর মাঝামাঝি আসলে পুরো এক মিনিট সেখানে অবস্থান করত। ভবেন্দ্রমোহন নবাবের প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং কৃতকার্য হন। বাংলার গভর্নর ভবেন্দ্রমোহনের এই সাফল্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
পরে ভবেন্দ্রমোহন প্রফেসর কে বসাকের সার্কাস ছেড়ে দেন। তিনি আগাসীর সার্কাসে সপ্তাহে ১৫০ টাকা বেতনে খেলা দেখাতে শুরু করেন। তারপর কিছু দিন নিজেই একটা ছোট সার্কাসের দল চালিয়েছিলেন। তারপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খেলা দেখনোর জন্য পাসপোর্টের চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় তার মৃত্যু হয়।
প্রতিদিন সকালে ভবেন্দ্রমোহন ২০০টি বাদামের শরবত ও এক ছটাক গাওয়া ঘি খেতেন। প্রাতঃরাশে তিনি খেতেন দুই সের মাংস।মধ্যাহ্নে থাকত সাধারণ ডাল ভাত খেতেন। অপরাহ্নে খেতেন দুই বা আড়াই টাকার ফল, ৫০টি বাদামের শরবত ও এক সের মাংস। রাতে আধ সের আটার রুটি ও তিন পোয়া মাংস।তিনি অত্যন্ত সহজ সরল জীবনযাপন করতেন।
তিনি অকৃতদার ছিলেন। ভবেন্দ্রমোহন তার ছোট ভাইদের শরীরচর্চার প্রশিক্ষক ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে তার ভাইয়েরা অসামান্য শারীরিক বলের অধিকারী হন। তাদের মধ্যে দুর্গাদাস সাহা ক্ষেতুবাবুর আখড়ায় কুস্তি শেখেন।
তার বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি মোট ১২০ খানা স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক লাভ করেন। এছাড়াও পুরস্কার স্বরূপ শাল, আলোয়ান, আংটি, মোটর গাড়ি ও নগদ টাকাও পেয়েছিলেন। একবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক স্বদেশী মেলায় তিনি তার দৈহিক শক্তি প্রদর্শনের আহ্বান পান। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অমৃতলাল বসু প্রমুখ।
তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে রসরাজ অমৃতলাল বসু তাকে মহাভারতের ভীমের সাথে তুলনা করেন এবং তাকে কলিকালের ভীম বলে বর্ণনা করেন। তিনি তার ডাকনাম ‘ভবানী’-র পরিবর্তে তাকে ‘ভীম ভবানী’ বলে সম্বোধন করেন। সেই থেকে ভবেন্দ্রমোহন ভীম ভবানী নামেই পরিচিত হন।