সত্যেন বসু আলোচিত হবেন, সম্মনিত হবেন ততদিন যতদিন বিজ্ঞানের চর্চা থাকবে।

ছোটবেলায় স্কুলে অংক পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে অনেকেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘অংকে ১০০-র মধ্যে ১১০ পাবে তো?’ কথাটির মানে তেমন বুঝতাম না। তবে সত্যিই এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কথাটি সত্যি প্রমাণ করেছিলেন। অথবা বলা যায় তাঁর জন্যই কথাটি প্রচলিত হয়েছে। 

হিন্দু স্কুলে এন্ট্রান্সের টেষ্ট পরীক্ষায় তিনি অঙ্কের সব প্রশ্নগুলির উত্তর তো করেছিলেনই, উপরন্ত জ্যামিতির প্রশ্নগুলি একাধিক উপায়ে সমাধান করে দেন। অংকের শিক্ষক শ্রী উপেন্দ্রনাথ বক্সী খুশি হয়ে তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন।

মাধ্যমিকের পর তিনি ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে আই.এস.সি পাশ করেন প্রথম হয়ে। এই কলেজে তিনি সান্নিধ্যে আসেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতন অধ্যাপকদের। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক এবং ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে একই ফলাফলে মিশ্র গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। তবে যা শুনলে আপনি কিছুটা হলেও বিস্মিত হবেন তা হল তিনি পরীক্ষায় রেকর্ড স্কোর করেন যা এখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষত আছে |
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ বলেছিলেন , “যখন তাঁকে নিয়ে আলোচনা করবে , মনে রেখ ,এইরকম মেধা নিয়ে আর কোনও ভারতীয় বিজ্ঞানী আসেননি|”
তিনি বাংলা তথা ভারতের গর্ব বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু | ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ১ জানুয়ারি আজকের দিনেই উত্তর কলকাতার গোয়া বাগান অঞ্চলে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের পাশে ২২ নম্বর ঈশ্বর মিত্র লেনে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম |
বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করার ইচ্ছে সত্যেন বসুর ছোটবেলা থেকেই ছিল। এম-এস-সি’তে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর পাবার পর তাঁর শিক্ষক প্রফেসর ডি এন মল্লিক সস্নেহে ডেকে বললেন, “এত বেশি নম্বর পেয়েছ পরীক্ষায়, বড় বেমানান লাগছে হে”। সত্যেন্দ্রনাথ ভাবলেন এবার মনে হয় সুযোগ এলো বিদেশ যাবার। কিন্তু হল না। সে বছর পদার্থবিদ্যা বা গণিতের জন্য কোন বৃত্তি দেওয়া হল না। সবগুলো বৃত্তি পেল রসায়নের শিক্ষার্থীরা। এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও ভালো কোন চাকরির ব্যবস্থা হল না। কিংবা বলা যায় এত ভাল রেজাল্টের কারণেই কোন চাকরি পাওয়া গেল না। এত ভাল ছাত্রকে কেউ সাধারণ চাকরি দিতে চান না। তাঁর বাবা রেলওয়ের বড় অফিসারদের ধরে রেলওয়েতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে চাইলেন। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ রাজী হলেন না।
একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির কাছ থেকে ডাক এল। শুধু সত্যেন বসু নয়, তাঁর মত আরো সব কৃতী ছাত্রদের ডেকেছেন তিনি। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে লাইব্রেরি ঘরের পাশে স্যার আশুতোষের খাস কামরায় হাজির হলেন সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন ঘোষ। স্যার আশুতোষ শুনেছেন এই নবীন ছাত্ররা চাইছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিষয় পড়ানো হোক। তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা পড়াতে পারবি?” সত্যেন বসু উত্তর দিলেন, “আজ্ঞে, যা বলবেন তা-ই যথাসাধ্য চেষ্টা করব”। স্যার আশুতোষ সস্নেহে হাসলেন।
মেঘনাদ সাহার উপর ভার পড়লো কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে পড়াশোনার। সত্যেন বসুকে পড়তে হবে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি। কিন্তু বই পাবেন কোথায়? রিলেটিভিটির কিছু ইংরেজি বই পাওয়া গেল। শিবপুর কলেজের ইংরেজ অধ্যাপক ডঃ ব্রাউলের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে পাওয়া গেল কিছু জার্মান বই। মেঘনাদ সাহা জার্মান শিখলেন এবং বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। কিছু প্রয়োজনীয় বই পাওয়া গেল ফরাসী ভাষায়। সত্যেন বসু ফরাসী ভাষা শিখলেন বইগুলো পড়ার জন্য। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সত্যেন বসু সেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করেন | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসু তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞান ও এক্সরে ক্রিস্টোলোগ্রাফির ওপর কাজ শুরু করেন। একদিন ক্লাসে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ও অতিবেগুনি রশ্মি বিপর্যয় পড়ানোর সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বর্তমান তত্ত্বের দুর্বলতা বোঝাতে এই তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের পার্থক্য তুলে ধরেন। ঠিক ঐ সময় তত্ত্বটিকে অঙ্কের মাধ্যমে বোঝাতে গিয়েই তিনি ভুলটা করে ফেলেন। পরে দেখা যায় তার ঐ ভুলের ফলে পরীক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অনুমান মিলে যাচ্ছে! তিনি তখন মনে মনে ভাবলেন, সে ভুল নিশ্চয় কোনো ভুল নয়। শুরু হলো তার উপর নিজের মতো করে গবেষণা। প্রথম প্রথম কেউ তার কথা মানতে চাননি। (বসু পরে তার ঐদিনের লেকচারটি একটি ছোট নিবন্ধ আকারে ‘Planck’s Law and the Hypothesis of Light Quanta’ নামে প্রকাশ করেন।)
পরবর্তীতে সত্যেন্দ্রনাথ হতাশ চিত্তে গবেষণাপত্রটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন পুরো ব্যাপারটি বুঝে ফেলেন এবং সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। বসুর সেই ভুল অঙ্কটিই এখন বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব নামে পরিচিত। আইনস্টাইন এই ধারণাটি গ্রহণ করে তা প্রয়োগ করলেন পরমাণুতে। এই থেকে পাওয়া গেল নতুন কনডেনসেট যা এখন বোস- আইনস্টাইন কনডেনসেট নামে পরিচিত। এটি আসলে বোসন কণার একটি ঘণীভূত রূপ। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে এক পরীক্ষায় এটির প্রমাণ পাওয়া যায়। আর বিশ্বজগতের যে কণাগুলোর স্পিন পূর্ণসংখ্যা বসুর নামে পল ডিরাক তার নামকরণ করা করেন বোসন কণা।
১৯২৪ সালে সত্যেন বসু গেলেন ইউরোপে। জার্মানিতে গিয়ে দেখা করলেন আইনস্টাইনের সাথে। খোলামেলা বৈজ্ঞানিক আলোচনা করলেন আইনস্টাইন ও সত্যেন বসু। জার্মানি থেকে প্যারিসে গিয়ে মাদাম কুরির সাথে দেখা করলেন। মাদাম কুরির ল্যাবোরেটরিতে কিছু কাজ করারও সুযোগ পেলেন সত্যেন বসু। দ্য ব্রগলির ল্যাবেও কাজ করেছিলেন কিছুদিন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে বৈজ্ঞানিক সাক্ষাৎ সত্যেন বসুর গবেষণা ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেশে ফেরার পর ১৯২৭ সালে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক এবং সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন নির্বাচিত হন।
মনে প্রাণে বাঙ্গালী এই বিজ্ঞান প্রেমী ব্যক্তিত্ত্ব বাংলাভাষার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত অনুরাগী। তিনি সবসময় চেয়েছেন এদেশের মানুষ বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করুক। এই প্রসঙ্গে তাঁর অমর উক্তি, “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।” শুধু মাত্র তিঁনি বলেই চুপ করে বসে ছিলেন না বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞান পরিচয় নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেও তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখিয়ে নিয়েছিলেন। সত্যেন বসুর প্রত্যক্ষ উৎসাহেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক বই ‘বিশ্ব পরিচয়’ লেখেন ১৯৩৭ সালে। রবীন্দ্রনাথ সত্যেন বসুকেই উৎসর্গ করেছিলেন ‘বিশ্ব পরিচয়’। এ প্রসঙ্গে সত্যেন বসু বলেন, “নোবেল পুরষ্কার লাভ করলেও আমি এতটা কৃতার্থ বোধ করতাম না”।
বসু একজন ভালো সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন বটে। উচ্চমানের সঙ্গীত শোনার জন্য তিনি রাতের পর রাত জেগেই কাটিয়ে দিতেন। তিনি খুব ভালো এস্রাজ বাজাতেন। সাহিত্যেও ছিল তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ও বিশেষ প্রীতি। তার সাহিত্যপ্রীতির স্বীকৃতি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের বিশ্বপরিচয় বিজ্ঞানগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর জাপানে ভ্রমণরচনা ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন।অনুশীলন সমিতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগও রাখতেন দেশব্রতী সত্যেন্দ্রনাথ। 
বাগান করা ছিল তার কাছে শখের ঘরানা ব্যাপার। সময় ও সুযোগ পেলেই তার শখের বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সাহিত্যজগতে আনাগোনার মধ্য দিয়ে তার পরিচয় ঘটে সাহিত্য জগত দিকপাল বুদ্ধদেব বসুর সাথে। আর তার সে পরিচয় কালের আবর্তে পৌঁছে গিয়েছিল কোলকাতার ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ‘কবিতা ভবন’ দ্বারপ্রান্তে। সেখানে প্রায় সময় সত্যেন্দ্রনাথ যেতেন, আড্ডা দিতেন, সময় কাটাতেন। আই এস সি তে থাকাকালীন তিনি ক্যারম খেলা শিখেছিলেন। পরে সে খেলায় দিনরাত এক করে খেলতে শুরু করেন, তাতে অবশ্য মায়ের বকুনি কোনো অংশেই কম শুনতেন না, অথচ ক্যারমের নেশা যেন তাকে ছাড়েই না! পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। প্রায়শই পরনের ফতুয়া ভুল করে গায়ে না জড়িয়ে কাঁধে চাপিয়ে রাখতেন। জুতোর অবস্থাও ছিল এমন যে প্রায় সময়ই দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে সবখানে ঘুরে চলে আসতেন।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তার আবিষ্কৃত তত্ত্বের উপরে কাজ করে অনেকেই নোবেল পেলেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে কিন্তু নোবেল দেওয়ার কথা কেউ তোলেননি। সত্যেন বসু আলোচিত হবেন, সম্মনিত হবেন ততদিন যতদিন বিজ্ঞানের চর্চা থাকবে।
কৃতজ্ঞতা – অভীক মণ্ডল 
তথ্য – বিজ্ঞানবর্তিতা