রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় কি ভারতের নাগরিকরা বসবাস করে?

রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় কি ভারতের নাগরিকরা বসবাস করে? নইলে ‘ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বিনষ্ট করতে কেন ঠাকুরপাড়ায় হামলা’ করা হবে? তার মানে ভারত না থাকলে কিংবা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হিন্দুরা কোন নিরাপত্তাই পাবে না? মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যখন বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বিনষ্ট করতেই ঠাকুরপাড়ায় হামলা করা হয়েছে’ সেটা তার দোষ নয়, এটা বাস্তবতা। ভারতের রাষ্ট্রদুত ক্ষতিগ্রস্থ ঠাকুরপাড়া পরিদর্শন করতে গেছেন। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার ঠাকুরপাড়ায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয়েছে বলেই দেখতে গেছে। যেমন রোহিঙ্গা মুসলমান ক্যাম্প দেখতে গিয়ে তুরস্কের ফাস্টলেডি কান্নাকাটি করেছিলেন। মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা টেকনাফে পদধূলি দিয়েছিলো কারণ রোহিঙ্গারা মুসলমান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও টেকনাফ পরিদর্শন করেছিলেন কারণ রোহিঙ্গারা উনার মতই মুসলমান। এই যে, হরকলি-ঠাকুরপাড়ায় হিন্দু ১১টি পরিবারকে ২৫ হাজার করে টাকা এবং একটি ক্ষতিগ্রস্থ মন্দিরকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে সরকার এটাও সম্ভবত ভারতকে খুশি করতে। কারণ সুষমা সরাজ বলেছিলেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষতিপূরণ দিবে সেদেশের সরকার।

তাহলে কি পৃথিবীতে মানবতবাদী দেশ বা জাতি নেই? অবশ্যই আছে। সেটা আমরা আন্তর্জাতিক সংকটেই দেখতে পেয়েছি। এমন কি রোহিঙ্গা নির্যাতনে ধর্মে মুসলিম না এমন জাতি গোষ্ঠি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তাই মানবতাবাদী আর ধর্মীয় মানবতাবাদীদের লিস্ট না লিখে আজ কেবল বাংলাদেশের কথাতেই সীমিত থাকি। ঠাকুরপাড়া হামলার ঘা কাঁচা থাকতেই কথাগুলো বলে রাখা ভাল। অন্য সময় বললে ‘হিন্দুত্ববাদী’ বলে মনে হতে পারে…।

৭ মাচের্রর ভাষণকে ইউনেস্কো ‘বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অতি গর্বের বিষয়। কারণ ৭ মার্চ ভাষণ ছিলো বাঙালী মুসলমানের পাঞ্জাবী মুসলমানের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ। বাঙালী জাতীয়তাবাদ ছিলো প্রকৃতপক্ষে বাঙালী মুসলমান জাতীয়তাবাদ। এর মধ্যে বাঙালী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ আরো ভিন্ন ভিন্ন জাতি গোষ্ঠির চিন্তা ছিলো না। থাকার কথাও না। পাকিস্তান হয়েছিলো ‘মুসলমানের দেশ’ হিসেবে। যে কারণে অবশিষ্ট থেকে যাওয়া অমুসলিম নাগরিকরা রাজনৈতিকভাবে ছিলো হিসেবের বাইরে। পাঞ্জাবী মুসলমানদের কাছে বাঙালী মুসলমান ব্যবসায়, চাকরিতে, প্রশাসনে, রাজনীতিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল। অন্যদিকে হিন্দুদের কারণে মুসলমানরা পিছায় আছে তাই দেশভাগ করে মুসলমান অধ্যুষিত দেশ বানাতে হবে- এই ভিত্তিতে পার্টিশন হয়েছিলো। এই জন্যই বলছি অবশিষ্ট অমুসলিম নাগরিকরা রাজনৈতিকভাবে হিসেবের বাইরে ছিলো পাকিস্তানে। পাকিস্তানে বাঙালী হিন্দু বা পাহাড়ীর কোন ইস্যু নেই। সেই হিসেব ৪৭ সালেই মিটিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তাই ৭ মার্চের ভাষণ ‘বাঙালী মুসলমানের’ ঐতিহাসিক উত্থানের ডাক ছিলো। এই ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কখনই পূর্ণিমা শীল, রসরাজ, টিটু রায়ের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিলো না। দেশভাগের আগে সংখ্যালঘু- সংখ্যাগুরু বলতে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিলো না। দেশভাগ হিন্দুদের ‘সংখ্যালঘু’ করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে পরাধীন করে দিয়েছিলো। এই পরাধীনতা স্বাধীন বাংলাদেশের একদম প্রথম দিন থেকেও ছিলো। তাদের মারলে ভারত রাগ করতে পারে- এমনটাই ভেবে এসেছে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি। এরা মুসলমানদের পার্টি। বাংলাদেশে দুই ধরণের পার্টি আছে। একটা মুসলমান পার্টি অন্যটি ইসলামী পার্টি। কমিউনিস্টরাও মুসলমান পার্টির ক্যাটাগরিতে গিয়ে পড়ে।

মিঠা মিঠা আশাবাদের কথা বলতে পারছি না। এদেশের ইতিহাস শুরু করতে হবে ৪৭ সাল থেকে। ৭ মার্চের ভাষণ থেকে নয়। নতুন প্রজন্মকে এই গোটা উপমহাদেশের ইতিহাস নির্মোহভাবে জানাতে পারলেই সম্ভবত একটি দ্রোহী প্রজন্ম আসতে পারে। যারা বিদ্রোহ করবে। এটুকুই আশাবাদ…।