হিসেবেও সর্বসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭
সালের ভারতীয় বিদ্রোহের অন্যতম প্রতিমূর্তি ও পথিকৃৎ হয়ে রয়েছেন তিনি।
মারাঠা শাসনাধীন ঝাঁসী ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত।
প্রারম্ভিক জীবন
জন্মকালীন সময়ে তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মণিকর্ণিকা এবং ডাক নাম মনু। তিনি মহারাষ্ট্রের মারাঠী করাডে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯ নভেম্বর, ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে কাশী (বারানসী) এলাকায় তার জন্ম।[৩] তার বাবার নাম ‘মরুপান্ত তাম্বে’ এবং মা ‘ভাগীরথী বাঈ তাম্বে’।[৪]
চার বছর বয়সেই তিনি মাতৃহারা হন। পারিবারিক পরিবেশে বাড়িতে শিক্ষালাভ
করেন লক্ষ্মী বাঈ। বিথুরের পেশোয়া আদালতে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন তার
পিতা। সেখানে পরবর্তীতে নিজ কন্যাকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে থাকেন
মরুপান্ত তাম্বে। লক্ষী বাঈকে ছাবিলি নামে ডাকতেন উষ্ণ হৃদয়ের অধিকারী পিতা।
বাবা কোর্টের কাজ-কর্মে জড়িত থাকায় রাণী লক্ষ্মী বাঈ ঐ সময়ের অধিকাংশ
নারীদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিলেন। আত্মরক্ষামূলক
শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া চালনা, আর্চারী শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
এছাড়াও তিনি তাঁর বান্ধবীদেরকে নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।
১৮৪২ সালে ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও নিওয়াকরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লক্ষ্মী বাঈ। এভাবেই তিনি ঝাঁসীর রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বিয়ের পরই তার নতুন নামকরণ হয় লক্ষ্মী বাঈ
হিসেবে। ১৮৫১ সালে তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয়
দামোদর রাও। চার মাস পর সন্তানটি মারা যায়। পুত্র শোক ভুলতে রাজা এবং রাণী
উভয়েই আনন্দ রাওকে দত্তক নেন। আনন্দ রাও ছিলেন গঙ্গাধর রাওয়ের জ্যেঠাতো
ভাইয়ের ছেলে। জীবিত থাকা অবস্থায় ঝাঁসীর রাজা তার পুত্রের মৃত্যু রহস্য
কখনো উদঘাটন করতে পারেননি। ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও ২১ নভেম্বর, ১৮৫৩
সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আনন্দ রাওকে দত্তক নেয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী’র দখল স্বত্ত্ব বিলোপ নীতির
কারণে তার সিংহাসন আরোহণে প্রতিবন্ধকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ডালহৌসী জানান
যে, ঝাঁসীর সিংহাসনে প্রকৃত উত্তরাধিকারী নেই এবং ঝাঁসীকে কোম্পানীর
নিয়ন্ত্রণাধীনে নেয়া হবে। মার্চ, ১৮৫৪ সালে ঝাঁসীর রাণীর নামে বার্ষিক
৬০,০০০ ভারতীয় রূপি ভাতা হিসেবে মঞ্জুর করা হয় এবং ঝাঁসীর কেল্লা পরিত্যাগ করার জন্য হুকুম জারী হয়।
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ
১০ মে ১৮৫৭ সাল। ঐদিন মিরাটে ভারতীয় বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, লি ইনফিল্ড রাইফেলের
আচ্ছাদনে শুকরের মাংস এবং গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়। এরপরও ব্রিটিশ
শাসকগোষ্ঠী রাইফেলে শুকরের মাংস এবং গরুর চর্বির ব্যবহার অব্যাহত রাখে।
তারা বিবৃতি দেয় যে, যারা উক্ত রাইফেল ব্যবহারে অসম্মতি জানাবে তাদের
বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এবং আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নিতেও শুরু করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। এই বিদ্রোহে সিপাহীরা অনেক
ব্রিটিশ সৈন্যসহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে নিযুক্ত কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করে।
ঐ সময়ে লক্ষ্মী বাঈ তার বাহিনীকে নিরাপদে ও অক্ষত অবস্থায় ঝাঁসী ত্যাগ করাতে পেরেছিলেন। সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী
প্রবল গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই চরম মুহুর্তে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অন্যত্র
মনোযোগের চেষ্টা চালায়। লক্ষ্মী বাঈ একাকী ঝাঁসী ত্যাগ করেন। তার
নেতৃত্বে ঝাঁসী শান্ত ও শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রয়েছিল। হলদী-কুমকুম
অনুষ্ঠানে ঝাঁসীর রমণীরা শপথ গ্রহণ করেছিল যে, যে-কোন আক্রমণকেই তারা
মোকাবেলা করবে এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণকে তারা ভয় পায় না।[৫]
এ প্রেক্ষাপটে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনায় দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ৮ জুন, ১৮৫৭ সালে জোখন বাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে কর্মরত কর্মকর্তাসহ স্ত্রী-সন্তানদের উপর গণহত্যার বিষয়ে তার ভূমিকা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে।[৬] অবশেষে তার দ্বিধাগ্রস্থতা কেটে যায় যখন ব্রিটিশ সৈন্যরা স্যার হিউজ রোজের
(লর্ড স্ট্রাথনায়র্ন) নেতৃত্বে ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং ২৩ মার্চ, ১৮৫৮
তারিখে ঝাঁসী অবরোধ করে। লক্ষ্মী বাঈ তার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব
দেন এবং এ অবরোধের প্রেক্ষাপটে তিনি প্রচণ্ডভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। ঝাঁসী
এবং লক্ষ্মী বাঈকে মুক্ত করতে বিশ হাজার সৈনিকের নিজস্ব একটি দলের নেতৃত্ব
দিয়েছিলেন অন্যতম বিদ্রোহী নেতা তাতিয়া তোপে। তবে, ব্রিটিশ
সৈন্যদলে সৈনিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১,৫৪০জন। স্বল্প সৈনিক থাকা স্বত্ত্বেও
তাতিয়া তোপে ব্রিটিশ সৈন্যদের অবরোধ ভাঙ্গতে পারেননি। ব্রিটিশ সৈনিকেরা
ছিল প্রশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ যা প্রতিপক্ষের আনাড়ী ও অনভিজ্ঞ সৈনিকেরা
তাদের ৩১ মার্চের আক্রমণে টিকতে পারেনি। লক্ষ্মী বাঈয়ের নিজস্ব বাহিনী এ
আক্রমণ সহ্য করতে পারেনি। আক্রমণের তিন দিন পর ব্রিটিশ সৈন্যদল দূর্গের
দেয়ালে ফাটল ধরায় এবং ঝাঁসী শহরটি করায়ত্ব করে নেয়। এর পূর্বেই এক রাতে
দূর্গের দেয়াল থেকে সন্তানসহ লাফ দিয়ে লক্ষ্মী বাঈ প্রাণরক্ষা করেন। ঐ
সময় তাঁকে ঘিরে রেখেছিল তার নিজস্ব একটি দল, যার অধিকাংশই ছিল নারী সদস্য।[৬]
আনন্দ রাওকে সাথে নিয়ে রাণী তার বাহিনী সহযোগে বাণিজ্যিক বিনিয়োগের
উর্বর ক্ষেত্র কাল্পীতে যান। সেখানে তিনি অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে
যোগ দেন। তাতিয়া তোপের নেতৃত্বেও একটি বিদ্রোহী দল ছিল।এরপর রাণী লক্ষ্মী
বাঈ এবং তাতিয়া তোপে গোয়ালিয়রের দিকে রওনা দেন। সেখানে তাদের যৌথবাহিনী
গোয়ালিয়রের মহারাজার দলকে পরাজিত করে। পরাজিত বাহিনীর সদস্যরা পরবর্তীতে
যৌথবাহিনীর সাথে একত্রিত হয়। তারপর কৌশলগত অবস্থানে থাকা গোয়ালিয়রের
কেল্লা দখল করে বাঈ এবং তোপের সম্মিলিত বাহিনী। ১৭ জুন, ১৮৫৮ সালে ফুল বাগ
এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে রাজকীয় বাহিনীর সাথে পূর্ণোদ্দম্যে যুদ্ধ চালিয়ে শহীদ হন রাণী।[৭]
পরবর্তীতে আরো তিনদিন পর ব্রিটিশ সেনাদল গোয়ালিয়র পুণর্দখল করে। যুদ্ধ
শেষে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পক্ষে জেনারেল হিউজ রোজ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ
করেন যে,[৮]
রাণী তার সহজাত সৌন্দর্য্য, চতুরতা এবং অসাধারণ অধ্যবসায়ের জন্য
স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও, তিনি বিদ্রোহী সকল নেতা-নেত্রীর তুলনায়
সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিলেন।
কীর্তিগাঁথা
রাণী লক্ষ্মী বাঈ ভারতবর্ষের ‘জাতীয় বীরাঙ্গনা’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি
পান। তাঁকে ভারতীয় রমণীদের সাহসী প্রতীক ও প্রতিকল্প হিসেবে চিত্রিত করা
হয়েছে। সুভাষ চন্দ্র বসু’র নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম নারী দলের নামকরণ করেন রাণী লক্ষ্মী বাঈকে স্মরণপূর্ব্বক।
ভারতীয় মহিলা কবি সুভদ্রা কুমারী চৌহান (১৯০৪-১৯৪৮) রাণী লক্ষ্মী বাঈকে স্মরণ করে একটি কবিতা লিখেন। কবিতার নামকরণ করা হয় ঝাঁসী কি রাণী, যাতে জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে তাঁকে উল্লেখ করেছেন তিনি।
১৮৭৮ সালে কর্ণেল ম্যালসন লিখিত “দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইন্ডিয়ান মুটিনি” পুস্তকে লক্ষ্মী বাঈ বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি লিখেন,
… তার জনগণ সর্বদাই তাঁকে স্মরণ করবে। তিনি নিষ্ঠুরতাকে বিদ্রোহের
পর্যায়ে উন্নীত করার মাধ্যমে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি জীবিত আছেন এবং
স্বীয় মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে, ২১ জুলাই, ২০১১ তারিখে লক্ষ্মী বাঈকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ডানপিটে রমণীদের একজন
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা তাদের স্বামীদের কাছ থেকে সক্রিয়
সহযোগিতা পেয়েছিলেন। টাইম ম্যাগাজিনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। তালিকায়
ঝাঁসীর রাণীর অবস্থান ছিল ৮ম।[৯]
ব্রোঞ্জ মূর্তিতে খচিত ভাস্কর্য্যে রানী লক্ষ্মী বাঈকে ঝাঁসী এবং
গোয়ালিয়র – উভয় শহরেই ঘোড়ায় আরোহিত অবস্থায় অঙ্কিত করা হয়েছে।
সাহিত্য কর্মে
- জর্জ ম্যাকডোনাল্ড ফ্রেজার রচিত “ফ্ল্যাশম্যান ইন দ্য গ্রেট গেম” শীর্ষক ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক উপন্যাসে ভারতীয়দের আন্দোলন সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে ফ্ল্যাশম্যান এবং রাণী লক্ষ্মী বাঈয়ের মধ্যে অনেকগুলো বৈঠকের কথা তুলে ধরা হয়।
- মাইকেল ডি গ্রেস কর্তৃক ফরাসী ভাষায় লিখিত “লা ফ্যামে সেক্রি” উপন্যাসে ঝাঁসীর রাণীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তুলে ধরা হয়। এতে রাণী এবং একজন ইংরেজ আইনজীবির মধ্যেকার ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরা হয়।
- ২০০৭ সালে জয়শ্রী মিশ্র ইংরেজী ভাষায় “রাণী” নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন।
- জন মাস্টার লিখিত নাইটরানার্স অব বেঙ্গল উপন্যাসে রডনি
স্যাভেজ নামীয় এক ব্রিটিশ অফিসার এবং রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের সম্পর্ককে ঘিরে
রচিত হয়েছে। জানুয়ারী, ১৯৫১ তে প্রকাশিত বইটি অ্যামেরিকান লিটারেরি
গিল্ড’সে মাসের সেরা বই হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক
দৃষ্টিকোণ থেকে বইটি বেশ কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এটি ছিল ঐতিহাসিক
উপন্যাসের একটি ধারা যা ভারতে একটি ব্রিটিশ পরিবারের অংশগ্রহণ নিয়ে রচিত।
ঐতিহাসিক গ্রন্থ
মহাশ্বেতা দেবী “ঝাঁসী কি রাণী” নামে একটি বই লিখেছেন। বইটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন সাগরী এবং মন্দিরা সেনগুপ্তা।
উক্ত বইয়ে রাণী লক্ষ্মী বাঈ সম্বন্ধে ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করা
হয়েছে। এতে ঐতিহাসিক দলিলপত্রাদি, প্রচলিত লোকগাঁথা, কবিতাসমগ্র এবং মুখে
মুখে চলে আসা বিভিন্ন তথ্যাবলী সমন্বয় করার মাধ্যমে গবেষণা করা হয়।
ঐতিহাসিক দলিলগুলোর অধিকাংশই ঝাঁসীর রাণীর নাতি জি.সি. তাম্বের কাছ থেকে
সংগ্রহ করা হয়। বাংলা ভাষায় লিখিত মূল বইটি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়, যার
আইএসবিএন নং হলোঃ ৮১-৭০৪৬-১৭৫-৮।
চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ধারাবাহিকে
- দ্য টাইগার এণ্ড দ্য ফ্লেম (বাঘ এবং শিখা) ১৯৫৩ সালে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম টেকনিকালার চলচ্চিত্রের একটি। ছবিটির পরিচালক ও নির্দেশক ছিলেন চলচ্চিত্রকার সোহরাব মোদী।
- ঝাঁসী কি রাণী, টেলিভিশন সিরিজ।
- কেতন মেহতা নির্মিত ছবি দ্য রেবেল বা বিদ্রোহী। মঙ্গল পান্ডেঃ দ্য রাইজিং ছবির একটি সহযোগী চলচ্চিত্র এটি। ফারুখ ধোন্দী’র চন্দ্র প্রকাশ দিবেদী পুস্তক অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে।
|
|
|
|