এসবও কি ইতিহাসের প্রতিশোধ?

নবাব সিরাজদৌলা সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘সিরাজ উদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরাণ কৰ্ম্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্ৰিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা, প্ৰতিদিন, তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্ৰায় কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই’ (বাঙ্গালার ইতিহাস, প্রথম অধ্যায়, শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)।

বামপন্থি ইতিহাস লেখক অসিত বন্দোপাধ্যায় এ কারণে বিদ্যাসাগরকে ‘সাম্রাজ্যবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী’ বলে অবিহত করেন। তিনি লেখন, ‘বিদ্যাসাগর প্রায় মার্শম্যানের অবিকল অনুবাদ করিয়াছেন। মার্শম্যানের সাম্রাজ্যবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিমাও তিনি হুবহু স্বীকার করিয়া লইয়া অনুবাদ করিয়াছেন’।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য নাস্তিক থেকে বিদ্যাসাগরকে ধর্মের পথে আনা। রামকষ্ণের সঙ্গ অসহ্য ঠেকেছিলো বিদ্যাসাগরের। রামকৃষ্ণ খাতির জমাতে বিদ্যাসাগরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি সাগরে এসেছি, ইচ্ছা আছে কিছু রত্ম সংগ্রহ করে নিয়ে যাব’। বিদ্যাসাগর বিরক্ত হয়ে উত্তর করলেন, ‘আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে বলে তো মনে হয় না, কারণ এ সাগরে কেবল শামুকই পাবেন’। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে পরে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এমন কি তাঁর (বিদ্যাসাগরের) নিজের মোক্ষলাভের জন্য ভগবানের নাম করবারও কোন স্পৃহা নেই, সেইটা বোধ হয় তাঁর সবচেয়ে বড় ত্যাগ। অন্য লোকের উপকার করতে গিয়ে তিনি নিজের আত্মার উপকার করার প্রয়োজন অগ্রাহ্য করেছেন (বিনয় ঘোষ লিখিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পৃষ্ঠা- ১৫৭)।

নকশালরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙ্গেছিলো কারণ তিনি তাদের দৃষ্টিতে বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদী। তাঁকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ বলতেও বামপন্থি ঐতিহাসিকদের আটকায়নি। কারণ তিনি নবাব সিরাজদৌলার সমালোচনা করেছিলেন। কার্ল মার্কস ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতীয়দের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে দাবী করেছিলেন আর দেশীয় বিপ্লবীরা নবাব সিরাজের পরাজয়কে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত বলে দাবী করেন। নবাব সিরাজদৌলার নানা আলিবর্দি খানকে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ‘দুরাত্মা’ বলা হয়েছে। সিরাজ তার নানাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার পরাজয়ে বাংলার সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার সূর্য কেমন করে অস্ত যায় কে জানে!

বিদ্যাসাগর তার হিন্দু সমাজের ধর্মীয় বিধানকে আইন করিয়ে নিষিদ্ধ করেন। হিন্দুদের ধর্মীয় আচার নিয়ে প্রকাশ্যে ঠাট্টা করতেন। বেদ শাস্ত্রকে অপ্রয়োজনীয় বলে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেও তিনি হিন্দুদের কাছে ‘হিন্দু ধর্ম বিদ্বেষী’ হননি কিন্তু নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে বলেই বামাতী সংঘের কাছে তিনি ‘ইসলাম বিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদী’!

এত কথা উঠল হেফাজতি ফইসবুক বুদ্ধিজীবী পিনাকীর একটা পোস্ট পড়ে। এই লোক নবাব সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে যারা যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের প্রত্যেকেই অপঘাতে মারা যাবার কথা উল্লেখ্য করে বলেছেন ইতিহাসের প্রতিশোধ। আসলে এর মাধ্যমে সে দৈব বলে একটা বিষয় এনে বলার চেষ্টার করেছেন নবাব সিরাজদৌলার মত পীর সাহেবের বিরুদ্ধে গিয়ে তারা যে পাপ করেছিলেন সেই পাপের সাজা হাতেনাতে তারা পেয়ে গেছে। … মাঝে মাঝে এই পিনাকীকে আমার সন্দেহ হয় বেকুব মুসলমানদের নিয়ে খেলে কিনা! সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যদি এতখানি একশান ঘটে যায় তাহলে মানুষ চিন্তা করে কূল পাবে না কেন নবী বংশ অপঘাতে মারা গিয়েছিলো একে একে? স্বয়ং নবী বিষক্রিয়ায় ভুগে চার বছর পর মারা যান। তার কন্যা উমারের চাকরের ধস্তাধস্তিতে গর্ভপাত ঘটে চারদিন পর্যন্ত নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে মারা যান। এরপর জামাতা আলী আততায়ীর হামলায় খুন হন। নাতি দু্ইজনের একজনকে বিষপান করিয়ে অপরজনকে কারবালার ময়দানে নৃসংসভাবে হত্যা করা হয়। এসবও কি ইতিহাসের প্রতিশোধ?