“ধর্ম এবং অধর্ম”- একটি তর্ক

“ধর্ম এবং অধর্ম”- একটি তর্ক
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ

তারিখ- ২৪শে আগষ্ট, ২০১৬ সাল, কৈলাশহর, ত্রিপুরা, স্থানীয় ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ সভাপতির বাড়ি।

সময়কাল—সকাল ৭ টা।বৃদ্ধ গৃহস্বামীর সংগে বাক্যালাপ চলছে। কুমিল্লা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরাতে আগমন বেশ আগে।

ছেলে (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সভাপতি), কৈলা শহরে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।  দুই ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। দু জনেরই বয়ষ ষাটোর্ধ। পরিচয় পেলাম একজন ছিলেন স্থানীয় কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক, অপর জন স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ওরা প্রবেশ করতেই আমার গৃহস্বামী পরিচয় করিয়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন।।

প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের এবং বিশদ পরিচয়াদি শেষ হবার পর শুরু হলো, বিশেষ আলোচনা পর্ব,যার জন্য ওই দুই ভদ্রলোক আমার সংগে দেখা করতে এসেছেন।

প্রশ্ন- (ইতিহাসের অধ্যাপক)—আপনি ৩২ বছর বিদেশে ছিলেন, পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎষা শাস্ত্রে উপাধী পেয়েছেন। আর আপনি এসেছেন এই কৈলাশহরে গীতা পাঠ করতে? আপনার কি মাথা খারাপ না আপনি অন্য কিছু”।

দেশে ফেরা অবধি এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আগেও হয়েছি। গতকাল ই কলকাতায় আমার পরিচিতএকজন প্রশ্ন করলেন,”আপনি শেষ মেশ কৃষ্ণের মতো একজন নারী ভোগী লম্পটের ভক্ত হলেন”?

কি করি??? সামনে বসা দুইজন স্থানীয় প্রভাবশালী সি পি এম নেত্ত্বৃত্ব (একজন জোনাল কমিটির সম্পাদক, আর একজন ওয়ার্ড মেম্বার। ) কথা ছিলো আগরতলায় গীতা পাঠ করার, জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে। ২২ শে রাতে পৌছানোর পর শুনলাম আগরতলায় চলছে উপজাতি এবং স্থানীয় বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের মধ্যে মারামারি। আমাকে নিয়ে কি করা যায় সেই জন্য সবাই চিন্তিত এবং আলোচনা। পরের দিন কাঁক ভোরে রীতিমতো  এসকর্ট গার্ড সহ , সামনে পিছনে দুটি গাড়িতে গার্ড আর মাঝখানে আমার গাড়ী দিয়ে বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমাকে পৌছে দেওয়া হয় কৈলা শহরে । সেখানেও জন্মাষ্টমী পালন হচ্ছে শহরের সবচেয়ে বড়ো কালী মন্দিরে।

কৈলাশহরেও দেখি বিপদ। সিপিএম এর বক্তব্য, আমি কেনো পশ্চিম বংগ থেকে ত্রিপুরায় গন্ডোগোল পাকাতে এসেছি। সেই কথা বলতে এবং আমাকে চুপ করাতে এই দুই মহারথীর আগমন।

আমি সব বুঝে বললাম-“ বিকেলে মন্দিরে আসুন। সেখানেই সবার সামনে খোলাখুলি সব বলবো। বন্ধু বান্ধব দের নিয়েই আসবেন”।

উত্তর — আমরা ওই মন্দির ফন্দিরে যাই না। ওই গুলো মানুষ ঠকানোর ব্যবসাকেন্দ্র।

ভদ্রলোক দু’জন যাবার আগে বলে গেলেন যে, আমি যেন উল্টোপাল্টা, পার্টি বিরোধী কোনো কথা না বলি।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক (আমার আশ্রয় দাতা ) এবং তার ছেলে ঘরে প্রবেশ করলেন।

“তা, এখন আপনি কি করবেন? ওরা খুব ইনফ্লয়েন্সিয়াল। ওদের কথায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। ওরা বাড়িতে ধেয়ে আসবে বুঝিনি।“ বৃদ্ধ বললেন।

আমি বললাম, “ এতোদুরে এসে ওদের শাসানিতে গীতা পাঠ করবো না , তা আবার হয় নাকি? আমি ওদের ভয় পাই না। আপনারা ভয়ে জন্মাষ্টমী বন্ধ করে দিলে অন্য কথা।“
******
আর কোনো কথা হলো না। বিকেলে ৫ টায় মন্দিরে গেলাম। মন্দিরের সামনের রাস্তার উল্টোদিকে দেখলাম দুই কমরেড সাংগ পাংগ নিয়ে বসে আছেন। একেবারে ঠিক একই দৃশ্য, যা আমি দেখেছিলাম , ১৯৭৯ সালে তেঘরিয়াতে যখন আমার ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছিলো কমরেড বৃন্দ, এক বিশেষ কমরেডের নেতৃত্বে। আমি ভাবলাম, ভালোই হলো, প্রায় ৩৬ বছর পর আবার ওদের মোকাবিলা করা যাবে। সহায় সম্বলহীন,তখন আমি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজ সেই অপমানের ঊত্তর দেবো।
**********
আমার, প্রবচন হয়েছিলো পর পর দুদিন।  প্রথম দিন বলেছিলাম “ধর্ম পালন করি কেনো বা সকলেরই ধার্মিক হওয়া এবং ধর্মকে আশ্রয় করে থাকা, ধর্ম পালন করা উচিত কোন যুক্তিতে। আর ধর্ম কি আসলে “সমাজের জঞ্জাল” না যারা ওই কথা বলে তারাই জঞ্জালের আমদানী করে সমাজ সংসারের পরিবেশ দুষিত করছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।  ধর্মের  বিপরীত শব্দ “অধর্ম”। ধর্ম কি এবং অধর্ম কি? যারা ধর্মের বিরুদ্ধবাদী তারা নিশ্চয়ই ‘অধর্ম’ কে অনুসরন করে। এর মধ্যবর্তি  তো কিছু নেই , হয় ও না। তা সে যে যাই বলুক।

“ আমি ঈশ্বর মানি না, ওই সব বুজরুকি,” আমি মানবতা বাদী, মানুষকে ভালোবাসি, সেটাই যথেষ্ট”, এই  সব কথার কোনো অর্থই হয় না। অন্যের জিনিষ কেড়ে নিলে আমার যদি ফায়দা হয় তাহলে আমি তা কেনো করবো না ????? এই প্রশ্নের উত্তর কি “অধর্ম” এর পথে খুজে পাওয়া যাবে??????

শুধু মানুষ কে ভালোবাসলেই  সব হয়ে গেলো? অন্য প্রানীকুল, উদ্ভিদ ভেষজ এরা কি এই পৃথিবীর কোনো কাজে লাগে না? এদের সংগে আমাদের কি সম্পর্ক হবে???

এই রকম হাজারো প্রশ্নের কি সমাধান? সেই সমাধান শুধু কি ওই বস্তাপচা সাম্য বাদী বা বস্তুবাদী/ ভোগ বাদী অর্থনিতী করতে পারে? তাহলে চীন কেনো সুখে নেই, কিউবা আজ এক হত দরিদ্র দেশ কেনো? পশ্চিমী দুনিয়ায় এতো অশান্তি কেনো???/ এদের কারো কাছে কি এই প্রশ্নের উত্তর আছে?

আমি আমার সারা জীবন দিয়ে বুঝেছি, একমাত্র “ঈশ্বরীয় দর্শন “ ছাড়া অন্য কোথাও এর উত্তর কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না।  বর্তমান পৃথিবীতে প্রাচীন কালের মুনি ঋষিদের দিয়ে যাওয়া “আপ্ত্যজ্ঞান” ছাড়া অন্য কোনো জ্ঞান মানুষের চারিপাশের এই অন্ধকার (তমসা) দূর করতে পারবে  না। আর সেই আপ্ত্যজ্ঞান ই “মানুষের ধর্ম, মানব ধর্ম”, মানবতাবাদ, আর সব অধর্ম। আমি সেই জন্যই  ধর্মকে নিয়ে চলি, জীবনে চলার পাথেয় আমি আমার সনাতনি দর্শন এবং বৈদিক ধর্ম থেকেই খুজে নেই। অধর্ম কে ভয় পাই,লজ্জা বোধ করি।

আরো বলেছিলাম,——— “অনেকে মনে করেন মহামতি কার্ল মার্ক্স, সমাজে ধর্মের গুরুত্বকে সম্পুর্নভাবে অস্বীকার করেছেন। এর থেকেও ভ্রান্ত ধারনা আর নেই। যারা মার্ক্স পড়েন নি বা বোঝেন না, মার্ক্স কে নিয়ে যারা রাজনিতী করতে ব্যস্ত, কবিতা লিখে, শিবের মাথায় ‘কন্ডোম’ পরিয়ে নাম কিনতে ব্যাস্ত, সারদিনে আকন্ঠ মদ্য পান করে, উৎসব  করে  গরুর মাংস খেয়ে বড়াই করে, তারাই মার্ক্স কে নিয়ে এই অপপ্রচার করে। 

মার্ক্স বলেছেন, “ Religion is the heart of a heartless world”.——- অর্থ্যাত, ধর্মই হচ্ছে হৃদয়হীন বিশ্বের অন্তরাত্মা” । —–ধর্ম মানব জাতিকে তার দৈনন্দিন জীবনের কঠোর বাস্তবতা থেকে মুক্তি দেয়, আশ্রয় দান করে। ধর্মকে বাদ দিয়ে সমাজ হয় না, অধর্মকে দিয়ে সমাজ চলে না।

ধর্ম কথাটির ব্যুৎপত্তি গত অর্থ হলো, “ যা কিছু ধারনশক্তি যুক্ত, যা জীব কুলকে, সৃষ্টিকে ধারন করে রাখে”। এছাড়া অন্য সব কিছু অধর্ম।  যে আদর্শ , যে নিয়ম বা নীতি বিশ্বকে ধরে রেখেছে এবং যে তত্ব তার নিজ স্বকীয়তায় ব্যক্ত হয় সেটাই ধর্ম। বিশ্বের সব বস্তুর ই একটি ধর্ম আছে।  যেমন আগুনের ধর্ম তাপ ও আলো প্রদান করা। এই তাপ এবং আলোই আগুনকে ধারন করে আছে। এই তাপ এবং আলো সরিয়ে নিলে আগুন আর আগুন থাকে না। শীতলতা জলের ধর্ম। তাপ দিয়ে শীতলতাকে দূর করে দিলে জল বাস্পাকারে ঊবে যায়, জল আর থাকে না। তেমনি সব জীবের, উদ্ভিদের নিজস্ব ধর্ম আছে,তারা সেই মতো চলে,জীবন ধারন করে।

তাহলে সৃষ্টির শ্রেষ্ট প্রানী মানুষ ধর্ম বিবর্জিত হতে পারে কি করে?? এটা কি মানুষের প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয়??? যে সব গুন থাকলে মানুষকে মানুষ বলা যায় সেই গুনাবলীই মানুষের ধর্ম, আর যে সব গুনের অভাবে  মানুষ আর মানুষ থাকে না, অমানুষ হয়ে যায় সেটাই “অধর্ম”। যারা অধর্মের পুজারী, যারা ধর্ম মানে না বা ধর্মের পথে চলে না, ধর্মকে আশ্রয় করে চলে না।,জীবন থেকে মনুষ্যত্বকে বর্জন করে চলে তারা ‘অধার্মিক’।

মনু সংহিতায় ধর্মের দশ টি লক্ষন বা স্বরুপের কথা উল্লেখ করা আছে। শ্রীগীতা তে পুরো একটি অধ্যায় আছে দৈব গুন এবং আসুরিক গুন নিয়ে আলোচনা। পতিঞ্জলির “যোগ শাস্ত্র” মানুষের ধার্মিক গুনের লক্ষন বিশদ ভাবে আলোচনা করেছেন।

“ধৃতিঃ ক্ষমা  দমোহস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয় নিগ্রহঃ ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধা দশকং ধর্মলক্ষনম”।।

সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, চিত্ত সংযম, চুরি না করা, শুচিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, ধী (বুদ্ধি) বিদ্যা (জ্ঞান) সত্য, ও অক্রোধ—– এই দশটি ধর্মের লক্ষন। 

এর কোনটিকে বাদ দিয়ে আপনি সমাজ কল্যান করবেন?????????