ইরানে সাম্প্রতিক জনরোষ অথবা নতুন পারস্য বিপ্লবের সূচনা :

ইরানে সাম্প্রতিক জনরোষ অথবা নতুন পারস্য বিপ্লবের সূচনা :
(নতুন সকালের প্রত্যাশায় )

সবাইকে  ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে এক নতুন গণজাগরণের উপর কিছু বলতে এসেছি।হয়ত নতুন কিছু হতে চলেছে আগামীতে।এর দিনপঞ্জি লেখার বাসনায় এই লেখা।ঘটনার গতিপ্রকৃতির পরবর্তী ধারার উপর আবার হয়ত আরো কিছু লিখবো।
গত তিনদিন যাবৎ ইরানে এক সার্বিক প্রতিবাদ হচ্ছে যার জেরে সাধারণ মানুষ পথে নেমেছেন। আজকের এই প্রতিবেদন লিখেছি অনেকগুলো সূত্র কে অবলম্বন করে। পশ্চিমের খবরের কাগজ অথবা নিজেদের দেশের কাগজ কে সূত্র করে লিখলে অনেকের কাছেই উহা সহি হতো না আবার ইরানের কাগজ (সবই সরকারের নিয়ন্ত্রণের ) উপর নির্ভর করলে কিছুই পেতাম না। এই কারণে সূত্র করেছি সৌদি এবং পাকিস্তানের কাগজ কে। আর খবরের সূত্র ধরে ওই বস্তুগুলোকে মিলিয়েছি কিছু ভিডিও ইত্যাদির সাথে। আশাকরি অনুভূতি সম্পন্ন মানুষগণ এবং আলোকপ্রাপ্ত বাকি মানুষদের কোনো কিছুতে আঘাত হবে না।

ইরানে এই মোল্লাতন্ত্রের বিষয়ে আগেও লিখেছিলাম কি ভাবে মানুষ এর বিষয়ে অসুখী। এবার কিন্তু এর সাথে জুড়েছে অর্থনৈতিক সংকট। এরফলে এবার বিষয়টা অনেক জটিল। এই আন্দোলন সরকার পরিবর্তন করবে না সব এক থাকবে তার কোনো আগাম ভবিষ্যৎবাণী এখনই করা নিরর্থক তবে যা আমরা জানি না তা হলো বহুকাল ঠিক আমাদের আগের দেখা সেই মহান সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট সরকারের মতোই একটি একনায়কতান্ত্রিক ধর্ম ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছিল ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। তাদের হয়তো মনে ছিল না যে এই দেশটির একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব আছে,ওটা হলো এদের এক হাজার হাজার বছরের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর চেতনার ধারা। এই কারণে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরানোর চেষ্টা সাময়িক সফল হলেও চিরকালীন সফলতা পায় না।

আজকের সমস্যার মূল কারণগুলো প্রধানত কয়েকটি :
১. অর্থনৈতিক সংকট এবং দেশের অগ্রগতির স্তব্ধতা
২. মানুষের স্বাধীনতার উপর ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় হস্তক্ষেপ
৩. দেশের মানুষের কথা না ভেবে আন্তর্জাতিক ঝামেলায় ইরান এর যুক্ত হওয়া 

কি ভাবে শুরু হলো এই আজকের গণবিক্ষোভ ?
অর্থনৈতিক সমস্যার সূচনা

দীর্ঘদিন ধরেই ইরানে প্রবল  জন-অসন্তোষ চলছে। এর প্রধান কারণ সেই সেভিয়েত পতনের মতোই ,অর্থাৎ অর্থনৈতিক কাঠামো কে সচল রাখতে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। এর সাথে আছে মানুষের স্বাধীনতা হরণের কাজকারবার। রাষ্ট্র তার ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে অন্য পাঁচটি এই ধরণের দেশের মতোই অর্থাৎ একটি বশংবদ বাহিনীর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে এই কাজ করছে ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ড।

বিক্ষোভের শুরু পশ্চিম ইরানের মাসাদ শহরে।এমনিতেই এক বিশাল অংশের মানুষের অবস্থা আগেই অতীব খারাপ হয়েছিল এর আগের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদেনিজাদ এর কারনে। বহিঃবিশ্বে এক নিস্কলঙ্ক ইসলামের সেবক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও ইরানে এই লোকটি প্রবল নিন্দিত। তার আমলে তার প্রশ্রয়ে গড়ে উঠেছিল অনৈতিক ব্যাংকিং কিছু প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের চিট ফান্ডের কারবারিদের মতোই হাজার হাজার মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে।  অবশেষে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রৌহানি ২০১৩তে এইগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে স্বচেষ্ট হয়। তিনটি প্রথম সারির এই ধরণের প্রতিষ্ঠান যেমন মিজান ,ফেরেস্তাগণ এবং সামেন আল হেজাজ  (Mizan, Fereshtegan , Samen al-Hojaj) বন্ধ করেন। এরপর দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক (মানে আমাদের রিজার্ভ ব্যাংক এর মতো) কে নির্দেশ দেন আমানতকারীদের টাকা পরিশোধ করতে। বলেছেন কিন্তু শোধ হয় নি ,যা বা হয়েছে তার পরিমান যথেষ্ট না। এর ফলে আজ এই বিক্ষোভের সূচনা। উহু , কোনো হাওয়ায় কথা বলছি না ,বিক্ষোভের সূচনা হয়েছে প্রথম মাসাদ শহরে ,এই শহর ওই উল্লিখিত মিজান বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কারবারের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। এই শহরেই দশ লক্ষাধিক আমানতকারী তাদের পুঁজি হারিয়েছেন এই মিজান এর কারণে।
এর পরের বিক্ষোভের শহর হলো কেরামান্শাহ, এই শহর আবার অন্য এক চিট ফান্ডের (ক্যাস্পিয়ান নামের অন্য আরো একটি প্রতিষ্ঠান) দ্বারা প্রতারিত,এর সঙ্গে আছে কয়েক মাস আগে ভুমিকম্পের পরবর্তী ত্রান ব্যবস্থার অপ্রতুলতা।
আকাশছোয়া মূল্যবৃদ্ধি আর সরকারী অপদার্থতা
ইরানের মূল ভোগ্য সামগ্রী মানে দুধ ,ডিম আর বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য প্রায় ৬৭%মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারন মানুষের প্রায় কোমর ভেঙ্গে দেওয়ার দশা করেছে।একই সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে অত্যন্ত বিপদজনক ভাবে।এর উপর খোজ খবর করে দেখছি সরকারী খবর বলছে আলু থেকে বিনস,মাংস থেকে মাখন সব কিছুর দাম ৬০শতাংশ থেকে ১০শতাংশের মত বেড়েছে।
উপরে যেমন বলেছি,বিক্ষোভ পশ্চিম ইরানের থেকে ছড়িয়েছে ক্রমশ তেহরানে।হাজারে হাজারে মানুষ রাস্তায় নেমেছে।স্লোগান উঠেছে স্বৈরাচার নিপাত যাওয়ার , মোল্লাতন্ত্রের অবসানের।এক পর্যায়ে ওই রিভলিউশন গার্ড এর জওয়ানদের মানুষ বলছে বলে শোনা যায় ,যাও চোরেদের ধর,আমাদের না।
মানুষ চাইছে রুহানির পদত্যাগ,আরো স্লোগান উঠেছে -প্যালেস্টাইন বা লেবানন না ইরান হোক অগ্রাধিকারের বিষয়।
প্রথমে দু দিন ইন্টারনেট ব্যবস্থা বন্ধ রাখলেও খবর ঠিক চলে আসে।অসমর্থিত ভাবে মাত্র দুজন মারা যাওয়ার খবর আর কয়েকশ কারাগারে বললেও এর ফলাফল এতো স্বল্প মনে হয় না ।সমস্যা ছড়িয়েছে ইরানের শিল্পাঞ্চল ইস্পাহানে।শ্রমিক আর সাধারন মানুষ যারা কয়েক মাস মাইনে পাননি তারা রাস্তায় নেমেছেন।কেরামান্শাহ শহরে স্লোগান উঠেছে স্বৈরাচারের মৃত্যু হোক ,রুটি চাই,চাকরি চাই,স্বাধীনতা চাই ।
ইতিমধ্যেই তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ছড়িয়েছে।গনতন্ত্রের,স্বাধীনতার আর ধর্মীয় কঠোরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ছাত্র আর সাধারণ মানুষ।প্রচুর পুলিশ আর সামরিক উপস্থিতির মধ্যেও মানুষ তাদের বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কি মিল ভাবুন সেই নব্বই এর দশকের মতই পেটোয়া সমর্থক দিয়ে ইরানের বর্তমান সরকার পাল্টা বিক্ষোভ আর মিছিল করার চেষ্টা করেছে।ফলাফল,শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যা জানতে পারছে তা হলো,ওই ভাড়া করা লোক তাদের সমর্থন দিয়ে সুবিধা করতে পারে নি।এমনকি সমর্থক অনেকেই তাদের সমর্থন দেয় নি বা আসে নি।স্লোগান উঠেছে, স্বৈরাচার তোমার দিন শেষ ! মিছিল করার বদলে শেষে একটি জমায়েত দিয়ে মোল্লাতন্ত্রের ওই পাল্টা কর্মসূচি শেষ হয়েছে।
এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে,অনেক স্লোগান পুরনো শাহ এবং তার শাসনব্যবস্থার সমর্থনে ও হচ্ছে।মোল্লাতন্ত্র তার ফতোয়া এবং ধর্মীয় তাস খেলেছিল,বিরোধীদের নারী নেতৃত্ব আছে তাই উহা হারাম ইত্যাদি বলেছিল তবে সুবিধা হয় নি।এই বিক্ষোভের মূল দল People’s Mojahedin Organization of Iran (PMOI/MEK)র নেতৃত্বের মহিলা উপস্থিতির (নেতৃত্বে মারিয়াম রিজভী আছেন ) ওই কথা  উড়িয়ে দিয়ে ছাত্র আর সাধারন মানুষ পাল্টা স্লোগান তুলেছে খোমেইনির বিরুদ্ধে এবং তার আর সরকারী বিভিন্ন প্রথম সারির লোকের ছবি ইত্যাদি জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ইরানের শাসক আপাতত কয়েকদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে,তার কারন দেখিয়েছে প্রাকৃতিক দুষন।আজ সকালে সরকারী খবরের কাগজ ইরান ডেইলি বলেছিল দেশের বর্তমান পরিস্থিতির উপর প্রেসিডেন্ট রুহানি ভাষণ দেবে কয়েকঘন্টার মধ্যেই তবে কথা থাকলেও ওটা আর হয়ে ওঠে নি।পরে রুহানির মুখপাত্র এসে বলে প্রেসিডেন্টের কর্মসূচিতে ভাষণের কোনো বিষয় নেই।
ঘটনার তথ্যসূত্র হিসেবে বেশ কিছু ইউটিউব ভিডিও লিংক দিয়েছি।ছবি ও নিয়েছি পৃথিবীর পরিচিত নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম থেকে।ব্যক্তিগতভাবে প্রবল আগ্রহে এর গতিপ্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখেছি কারণ আগেও বলেছি,জেন্দা-অভেস্তার উপর জানার সময় থেকেই এই দেশটির উপর বেশ আগ্রহ হয়েছে।আমি চাই একটি ধর্মনিরপেক্ষ উন্নত ইরান আবার মাথা তুলে উঠুক।
অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে তবু বলছি,কোনো এইদিকের মানে বঙ্গজ সংবাদ মাধ্যমে এর উপর কিছু পেয়েছেন ?অথবা কোনো আগুনখোর ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লবীর দলের কোনো বিবৃতি ?আমি দেখিনি,হয়তো দেখিনি তেমন ভালো করে …আপনি দেখেছেন ?
নতুন বছর নিয়ে আসুক কোনো অন্য খবর এই প্রত্যাশায় দিন গুনছি
তথ্যসূত্র :
১.সরকারী টিভির থেকেই পাওয়া বিক্ষোভের ছবি https://www.youtube.com/watch?v=56MK6fPG6aI
২.খোমেইনীর ছবি উত্পাটন আর জ্বালানোর ছবি https://www.youtube.com/watch?v=sqEJ_cB9-Aw
৩. সহি এবং অনেকের কাছে গ্রহন যোগ্য কাগজের সূত্র : https://www.dawn.com/news/1379624
৪. সরকারী পেটোয়া মানুষ দিয়ে বিক্ষোভ দমনের পরিচিত খবর https://www.dawn.com/news/1379769/pro-government-supporters-come-out-in-droves-in-iran
৫. কেরামন্শাহ শহরে বিক্ষোভকারীদের উপর সরকারী দমন এর ছবি https://www.youtube.com/watch?time_continue=1&v=8LBt9pr-Vow
৬. স্বৈরাচার নিপাত যাক,গনতন্ত্র মুক্তি পাক,সেই পরিচিত স্লোগান এর ছবি https://www.youtube.com/watch?v=W8vNH0Giw3M
৭. আমাদের মতই ওই চিট ফান্ডের চিটিংবাজির বিষয়ে জানতে দেখুন https://www.dawn.com/news/1379624

Scroll to Top