Published, Bhorer Kagoj, Monday, 31st July 2017
নওয়াজ শরীফের পতন, পাকিস্তান জিতলো না হারলো?
http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2017/07/31/158972.php
পাকিস্তানের বিচার বিভাগ মাঝে মধ্যে যুগান্তকারী কিছু ঘটনার জন্ম দেয় যাতে বিশ্ব চমকিত হয়ে ওঠে। এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার, ২৮শে জুলাই ২০১৭। পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের সর্বসম্মত রায় দিয়েছে যে, নওয়াজ শরীফ সৎ নন, তিনি প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্ট সদস্য থাকার অযোগ্য। রায় মেনে নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ করেন। তিনি ‘আম ও ছালা’ দু’টোই হারান। পাকিস্তানের মত দেশে এমন একটি রায় দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়! এটা সম্ভব বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন হলে অথবা সামরিক বাহিনী পক্ষে থাকলে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কোনটি সত্য? পাকিস্তানের বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন বা সকল ধরণের প্রভাবমুক্ত, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এমন যুগান্তকারী রায়ের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পরোক্ষ সমর্থন থাকা অসম্ভব নয়? কারণ পাকিস্তানে রাজনীতিকদের হেয় প্রতিপন্ন করাটা একটি পুরানো বদভ্যাস। বেচারা নওয়াজ শরীফ, তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কোনবারই পাঁচ বছর টার্ম পূর্ণ করতে পারেননি।প্রথমবার ১৯৯৩ সালে তিন বছরের মাথায় তিনি দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা হারান, দ্বিতীয়বার ১৯৯৯ সালে দুই বছরের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানে এবং এবার ২০১৭ সালে চার বছরের মাথায় বিচার বিভাগের রায়ে।
এখানেই শেষ নয়, কোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। আরো তদন্ত হবে, মামলা হবে, জেল-জরিমানা হতে পারে। পানামা পেপার্স ফাঁস হলে নওয়াজ শরীফ, মেয়ে মরিয়ম, জামাই ইশরাক দার, দুইপুত্র হুসাইন ও হোসেন, এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে বিদেশে বিপুল পরিমান অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠে। আদালতের নির্দেশে যৌথ তদন্ত কমিশন (জেআইটি) গঠিত হয়। কমিশন এর প্রতিবেদনে জানায় যে, শরীফ পরিবার তাদের নামে থাকা অর্থের উৎস জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুপ্রিমকোর্ট এই রিপোর্ট আমলে নিয়ে রায় দেন। রায়টি পাঁচজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে সর্বসম্মতভাবে আসে। রায়ে বলা হয়েছে, নওয়াজ শরীফ আজীবন প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যে অযোগ্য, তিনি পার্লামেন্ট সদস্য পদেরও অযোগ্য। পাকিস্তানের সত্তর বছরের ইতিহাসে ১৮জন প্রধানমন্ত্রী তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নওয়াজ কন্যা মরিয়ম এক টুইটে এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আর একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ঘরে পাঠানো হলো। তিনি আশা ব্যক্ত করেছেন যে, শিগগিরই তার পিতা আরো শক্তি ও জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসবেন’।
পাকিস্তানের জনগণ দুইভাগে বিভক্ত। একভাগ বলছেন, ভালোই হয়েছে। অন্যরা বলছেন, কাজটা ঠিক হয়নি, আবার একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হলো। এরা বলছেন, সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফকে অপছন্দ করে, তাই তাকে যেতে হলো। এ ধরণের ঘটনার জন্যে বারবার সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হচ্ছে। নওয়াজ শরীফের পতনে সবচেয়ে খুশি ইমরান খান এবং জামাত। ইমরান সেনাবাহিনীর পেয়ারা বন্ধু। পানামা কেলেঙ্কারী শুরু হলে সেনাবাহিনী, ইমরান খান, জামাত দেরি না করে নওয়াজের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়ে। সেনাবাহিনীর সাথে নওয়াজ শরীফের তিক্ত সম্পর্ক সবার জানা। পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে নওয়াজ শরীফের পদত্যাগে আনন্দ মিছিল হয়েছে। রাজধানীতে নওয়াজের সমর্থকরা প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। জনতা আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করে। লাহোরে নওয়াজ শরীফের পক্ষে মিছিল হয়েছে। ক্রিকেটার কাম রাজনৈতিক ইমরান খান খুশি হয়ে বলেছেন, আদালত একটি ভালো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে এবং এভাবে পাকিস্তান থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদ হবে। শুক্রবার রায়ের পর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান বলেন, আজ পাকিস্তান জিতেছে।
নওয়াজ শরীফ লন্ডনে কেনা বাড়ি ও সম্পদের হিসাব দিতে পারেননি। তার চার সন্তানের মধ্যে তিনজন এই কেলেঙ্কারীতে জড়িত। নওয়াজের ঘনিষ্ট জনের বলছেন, এটা তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র। স্মর্তব্য যে, বেনজীর ভুট্টোর স্বামী আসিফ জারদারী প্রেসিডেন্ট পদ হারিয়েছিলেন দুর্নীতির অভিযোগে। দুর্নীতি, সামরিক অভ্যুত্থান, ও ক্ষমতার দাপট এবং ধর্ম পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা সৃষ্টি করে দেশটিকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত করেছে। আগেও পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট সেনা শাসক জেনারেল মোশারফকে সাঁজা দিয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বরখাস্তকৃত বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীকে বিচার বিভাগ স্বপদে ফিরিয়ে এনেছিলো। কারো কারো মতে, ইমরান খান, সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ত্রিভুজ আক্রমণে নওয়াজ শরীফ এবার ধরাশায়ী হলেন। এনিয়ে ফেইসবুকে এক বন্ধু একটি গল্প বলেছেন: ‘ঘাস সবুজ না হলুদ, এনিয়ে শিয়াল ও গাধায় বিতর্ক বাঁধে। শিয়ালের বক্তব্য ঘাস সবুজ, গাধা বলছে, হলুদ। বিচার গেলো সিংহের কাছে। সিংহ রায় দিলো, শিয়ালের সশ্রম কারাদন্ড। বেচারা শিয়াল বললো, এটা কি ন্যায় বিচার? ঘাস কি সবুজ নয়? সিংহ বললো: নিশ্চয় ঘাস সবুজ, আমি তোকে সাজা দিয়েছি, তুই গাঁধার সাথে তর্ক করেছিস বলে?
আদালতের রায়ের ওপর তর্ক চলেনা। নওয়াজ শরীফের একজন মুখপাত্র বলেছেন, রায় নিয়ে রিজার্ভেশন থাকলেও তা মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। নওয়াজ শরীফ শনিবার এক টেলিভিশন মন্তব্যে রায় নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, এ রায় একটি দু:খজনক ঘটনা। নওয়াজ শরীফের ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বলেছে, এটা দুৰ্ভাগ্যজনক যে পাকিস্তানে কোন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেন না। দল আরো বলেছে, আগামী নির্বাচনে মুসলিম লীগ আরো শক্তিশালী দল হিসাবে আবির্ভুত হবে। এদিকে ক্ষমতাসীন দল সাবেক মন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসীকে নয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করেছে। শনিবার দল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। পার্লামেন্টে মুসলিম লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাই পার্লামেন্ট বসলে তিনি জয়ী হবেন। মুসলিম লীগ আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, নওয়াজ শরীফের ভ্রাতা পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ আসন্ন উপনির্বাচনে নওয়াজ শরীফের শূন্য আসনে প্রতিদ্ধন্দিতা করবেন। ইমরান খান শনিবার বলেছেন, নওয়াজ শরীফ তার ভাইকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইছেন। এটা রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়। মঙ্গলবার ১লা আগষ্ট পাকিস্তানের অধিবেশন বসছে, সেখানে নুতন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন।
পাকিস্তানের এবারকার ঘটনাপঞ্জী অনেকটা এরকম: ২০১৬-র ৩রা এপ্রিল নওয়াজ শরীফের পরিবার পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির স্পটলাইটে আসে। ৫ই এপ্রিল নওয়াজ শরীফ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির ঘোষণা দেন। ২২শে এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী আবারো জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বলেন, তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। ৩০শে সেপ্টেম্বর পিটিআই নওয়াজ শরীফের পদত্যাগ দাবি করে। ২০শে অক্টবর ২০১৬ সুপ্রিম কোর্ট পিটিআই, জামহুরি ওয়াতান পার্টি, জামাতে ইসলামী ও অন্যদের পিটিশন গ্রহণ করে। ৭ই নভেম্বর নওয়াজ শরীফের দুই পুত্র হুসাইন ও হাসান এবং কন্যা মরিয়ম আদালতে এই মর্মে আর্জি পেশ করেন যে, প্রধানমন্ত্রীর দুই পুত্র দীর্ঘদিন বাইরে থাকে এবং তাদের ব্যবসার সাথে পিতা জড়িত নন। কন্যার পক্ষে বলা হয় যে, মরিয়ম নেসকোল ও নেলসন কোম্পানির ট্রাষ্টি মাত্র, বেনিফিশিয়ারি নন। ১৬ই নভেম্বর কাতারের প্রিন্স কোর্টে এই মর্মে কাগজপত্র জমা দেন যে, নওয়াজ শরীফের লন্ডনের সম্পত্তি তার ও নওয়াজ পরিবারের সেটেলমেন্টের অর্থ দিয়ে কেনা। ৪ঠা জানুয়ারি ২০১৭ সুপ্রিমকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। ২৩শে ফেব্রূয়ারি শুনানি শেষ। ২০শে এপ্রিল সুপ্রিমকোর্ট ৩-২ ভোটে বিভক্ত হয়ে পরে এবং ৬-সদস্যের জেআইটি গঠনের ঘোষণা দেন। ৫ই মে কমিটি কাজ শুরু করে। ১০ই জুলাই জেআইটি চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে পেশ করে। ২১শে জুলাই ৩ সদস্যের ইমপ্লিমেন্টেশন বেঞ্চ সকল পক্ষের শুনানি রেকর্ড করেন। ২৮শে জুলাই শুক্রবার ৫-সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত রায়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করেন।
জেআইটি নিয়েও কথা ওঠেছে। যে ৬জন জেআইটি সদস্য তারা হলেন: ফেডারেল ইনভেষ্টিগেশন এজেন্সির (এফআইএ) ওয়াজিদ জিয়া; চার্টার্ড একাউন্টটেন্ট আমির আজিজ; পাকিস্তান সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের বিলাল রসূল; ন্যাশনাল একাউন্টেবিলিটির ইরফান নাঈম মাঞ্জি; আইএসআই-র ব্রিগেডিয়ার (অব:) মুহাম্মদ নুমান সাঈদ; এবং মিলিটারি ইন্টিলিজেন্সের ব্রিগিডিয়ার কামরান খুরশিদ। ২০ এপ্রিল রুলিংয়ে সুপ্রিম কোর্ট ৬-সদস্যের জেআইটি গঠনের নির্দেশ দেয় এবং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও তার পরিবারের সদস্যের দুর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দেয়। আগষ্ট ২০১৬-তে পাকিস্তান জামাতে ইসলামী আদালতের শরণাপন্ন হয়ে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানায়। পাকিস্তান তারিক-ই-ইনসাফ পার্টির (পিটিআই) ইমরান খান এটির সমর্থন জানান। এ ছয় জনের মধ্যে দু’জন সামরিক বাহিনীর লোক। আমির আজিজের পিতা একজন সাবেক জেনারেল। তাই এনিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ২০ শে এপ্রিল ২০১৭-র রায় নওয়াজ শরীফের পক্ষে যায় এবং তার দল এতে বিজয় উৎসব করে।
নওয়াজ শরীফ পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে দ্বিতীয় শিকার। প্রথম শিকার ছিলেন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী গুন্নালুগাস্সং। এপ্রিল ২০১৬-এ তিনি পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে পানামা পেপার্স-এ যাদের নাম এসেছিলো তাদের বিরুদ্ধে কোন তদন্ত কমিটি হয়নি। অবশ্য, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করে লাভ নেই, কারণ সরকারের কারো নাম এতে আসেনি। যদিও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র দু’জন বড় ব্যাবসায়ী বড় নেতার নাম এসেছিলো। বাংলাদেশে কোন কোন মিডিয়া বর্তমান ঘটনায় একটু সুড়সুড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু কাজ হবেনা। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং যেভাবেই দেখিনা কেন, বাংলাদেশ প্রায় সকল ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। মনে রাখতে হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফের বিপক্ষে; মধ্যপ্রাচ্যে নুতন সংকটে নওয়াজ শরীফের ভূমিকায় আমেরিকা এবং ভারত-চীন সংকটে চীন নওয়াজ শরীফের ওপর কিছুটা বিরক্ত ছিলো। পাকিস্তানের মালিক আমেরিকা ও চীন, সেখানে কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন হতেই পারে? তবে এর মানে এই নয় যে, নওয়াজ শরীফের পরিবার ধোয়া তুলসী পাতা?
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
২৯শে জুলাই, ২০১৭। নিউইয়র্ক।