কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক বিজ্ঞাপন নির্মাতা ভারতের কোম্পানি থেকে এড বানানোর ডাক পেয়েছেন মর্মে নিউজ বাংলাদেশের মিডিয়াতে প্রচার হয়েছে। তিনি আগেও একটা এড বানিয়েছিলেন ভারতের জন্য। সেটা জনপ্রিয় হওয়ায় এবার বড় একটা গ্রুপের জন্য এড বানানোর দায়িত্ব পেয়েছেন। এসব জেনে আমরা সবাই খুশি। বাংলাদেশের কেউ ভারতীয় সিনেমায় প্লেব্যাক গাইলেও আমরা সবাই খুশি। কিন্তু ভারতীয় কোন এড কোম্পানি বাংলাদেশের এড বানালে দেশের টাকা বিদেশে প্রচার হয়ে যাচ্ছে! ভারতের শিল্পীরা এখানে পার্ফরমেন্স করতে আসলে দেশীয় সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ে যায়!…
ভারতের টেলিভিশনে বাংলাদেশী এড দেয় বাংলাদেশী কোম্পানিগুলোই। কারণটা প্রচার সংখ্যা। যে চ্যানেল বাংলাদেশের মানুষ বেশি দেখে সেখানে এড দিলে সবচেয়ে বেশি মানুষ দেখবে। বাংলাদেশের মানুষ ভারত বিরোধী। তবু তারা ভারতীয় টিভি সিনেমায় বুঁদ। সম্প্রতি বিবিসি নিউজ করেছে পাকিস্তানে কাস্মির হামলার পর ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়ায় সেদেশের সিনেমা ব্যবসায় বড় রকমের ধস নেমেছে। কারণ পাকিস্তান ভারতীয় সিনেমা ছাড়া তাদের হলগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। দুটি দেশ এতটা শত্রুতা থাকার পর পাকিস্তানের এড ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হতে হতে এখন একশ’র বেশি নেই। এগুলোও কয়েক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশী সিনেমা ধ্বংসের প্রক্রিয়াটা ৭২ সালের হয়ে গিয়েছিলো। দেশীয় সিনেমা রক্ষার জন্য চাষি নজরুল ইসলাম তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে ভারতীয় সিনেমা এদেশে নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলত পাকিস্তান আমলে উর্দু সিনেমার সঙ্গে লড়াই করে বাংলা সিনেমা যে উচ্চতর অবস্থানে পৌছে গিয়েছিলো তার জাদুতে ৮০ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশী সিনেমা টেনে যেতে পারলেও মুখ থুবড়ে পড়াটা ছিলো এক অমোঘ নিয়তি। সারা দুনিয়াতে হলিউডের সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অন্যান্য দেশের সিনেমাগুলো টিকে থাকে। হলিউডের সিনেমার জন্য আশেপাশের কোন দেশের সিনেমা বন্ধ হয়ে গেছে কেউ শুনেছেন? সবচেয়ে বড় কথা হংকংয়ের সিনেমা আজ হলিউডের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য করেছে। তাদের তারকারা হলিউডে আমন্ত্রিত হন সিনেমা করতে। হংকং তো হলিউডি সিনেমার সঙ্গে ফাইট করে আজ বিশ্ব বাজার ধরতে সক্ষম হয়েছে। হাস্যকর জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে কিছু অযোগ্য লোক বাংলাদেশকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা সব সময় করে গেছে। আমাদের পড়ার, দেখার অধিকারকে তারা কেড়ে নিয়েছে তাদের ব্যবসার দোহাই দিয়ে। আমার তো বাংলাদেশের হলে বসে ‘সোনার কেল্লা’ দেখার কথা ছিলো। আমাকে বেশি দামে ভারতীয় বাংলা বই কিনতে যারা বাধ্য করেছে বা আমদানি হতে দেয়নি যে বইগুলি তারা নিজেরাই কিন্তু চোরাই পথে সেই জিনিস পড়েছে বরাবর।…
ভারতীয় চ্যানেলের বাংলা নাটকের মান কেমন সেটার চেয়ে বড় কথা বাংলাদেশী দর্শকরা সেটা দেখছে। যেহেতু তাদের দেখা থামানো যাচ্ছে না তখন পুরুষতন্ত্রকে লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলো প্রথমে। প্রচার করা হলো- এসব সিরিয়াল দেখেই নারীরা পরকিয়াতে জড়াচ্ছে। হাস্যকর যুক্তি। এককালে ‘মাদাম বোভারি’ ‘আন্নাকারেনিনা’ ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসগুলিকে ঠিক এই যুক্তিতে নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে আজকের যুগের সংস্কৃতি মৌলবাদীদের মত এসব পড়লে মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে বলে হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছিলো। সেই ধারা আজো চলে আসছে। গেলো গেলো সব গেলো! সংস্কৃতি চলে গেলো! ধর্ম চলে গেলো! হায় হায় মেয়েরা এরপর পুরুষদের আর প্রভু মানবে না! এইসব দেখে দেশে মেয়েদের পোশাকের শালিনতা চলে যাচ্ছে! এ জন্যই তো ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে…। এসবেও যখন কাজ হলো না, এবার আসল কাজটাই করেছে, একদম বন্ধ করে দিয়েছে। আগেও এরকম করে এক মাসের বেশি রাখতে পারে নাই। এবারো পারবে বলে মনে হয় না। যারা নিজেরা নিজেদের টিভি দর্শকদের দেখানোর মত কিছু বানাতে পারে না তেমন ব্যর্থরাই সবাই একজোট হয়ে মানুষের দেখার স্বাধীনতাকে রুখে দিতে চাচ্ছে। এরা প্রতিযোগিতায় যেতে রাজি নয় কারণ তারা জানে প্রতিযোগিতায় এরা বিলুপ্ত হযে যাবে। এরা যেটা জানে না- এভাবে কিছুদিন টিকে থাকা সম্ভব হলেও অচিরেই তারা বিলুপ্ত হবে। ভারতীয় সিনেমা, টেলিভিশন, প্রকাশনাকে ভয় পাওয়ার চাইতে, ঈর্ষার বদলে, হুমকির বদলে তাদেরকে মেনে নিয়েই উচিত কঠিন প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হওয়া। সেটাই তাদের জন্য ভালো হবে।
Susupto Pathok