শেকড়ের খোঁজে এক মালাউন … আমার বাংলাদেশ ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতা…

প্রথমবার যখন বাবার সঙ্গে পিতৃভূমি বাংলাদেশ যাই, নিতান্তই ছোট। উঠেছিলাম আমার এক পিসির বাড়িতে, খুব সম্ভবত ‘যাত্রাবাড়ী’  নাম ছিল এলাকাটার। বিশাল পুরনো পৈতৃক বাড়ি, পুকুর। পিসি ছিল খুব ধর্মপ্রাণ মহিলা , একটু শুচিবাইও ছিল। পিসেমশাইয়ের সঙ্গে বাজারে গিয়ে একদিন শুধু কাছিমের মাংস উচ্চারণ করায় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা কোনদিন ভোলার নয়। বলছি –

বাংলাদেশের খাওয়া দাওয়া খুব বিখ্যাত। আমি পাহাড়ী ত্রিপুরার, চিংড়ি বলতে শুধু জানতাম নদী বা পাহাড়ী ছড়ার কুচোচিংড়ি। চিংড়ি এতবড় হতে পারে, সেই চিংড়ির ঠ্যাং এত শাঁসালো হতে পারে যে এ দিয়ে পর্যন্ত টক রাঁধা যায়, জানতামই না। যাই হোক, কাছিমের মাংস আমার খুবই পছন্দের। আমি ভাবলাম, এত নদী আছে যখন, বাজারে কাছিমের মাংস তো থাকবেই। বাজারে গিয়ে আমি মুখ দিয়ে শুধু কাছিম উচ্চারণ করেছি, পিসেমশাই হাত দিয়ে আমার মুখ চাপা দিয়ে বললেন – “চুপ, চুপ”! চোখে আতঙ্ক, চারদিকে তাকাচ্ছেন। আমি তখন ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই জানি না, জানি না গলাতে আড়াই পোঁচ দিয়ে নৃশংস ভাবে কাছিমকে মারা সম্ভব নয় বলে শূয়োরের মতোই কাছিমও ইসলামে নিষিদ্ধ। পরে বাড়ি এসে শুনলাম বাংলাদেশে কাছিম ‘জলখাসী’ নামে পরিচিত এবং এজন্যই নাকি আশপাশের লোকজন হঠাৎ করে আমার ‘কাছিম’ কথাটা ঠাহর করতে পারে নি। নাহলে ভীষণ সমস্যা হয়ে যেত, এমনকি হয়তো ভিটে ছাড়াও হতে হত। এখন তুলনা করে ভাবি, বাংলাদেশে হিন্দুরা খাওয়া দূর, ভয়ে বা সংখ্যাগুরুদের ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়ে নামও উচ্চারণও করে না ইসলামে নিষিদ্ধ মাংসের। আর এদেশে মুসলমানরা স্রেফ সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মনে আঘাত দেওয়ার জন্যই জেদ ধরে গরু খায়।

এরপর দ্বিতীয় বার যখন হীরো কাপের সময় যখন যাই, মোটামুটি বড়। ততদিনে পিসি ঐ বাড়ি জলের দরে বিক্রি করে ঢাকার একটি ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে, বলা যায় উঠে আসতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবেশী মুসলমানদের আপত্তির কারনে শেষদিকে ঐ বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা শাঁখ বা কাঁসর বাজানো যেত না, যদিও ওরা ছিল সব অনেক দিনের পুরনো প্রতিবেশী। আত্মীয় স্বজন ছাড়াও আশপাশে একসময় হিন্দু বাড়ি কিছু ছিল, এখন নেই। অনেকেই ইন্ডিয়া চলে গেছে, নয়তো এদেশেরই অন্য কোথাও। শুধু পিসিরাই পড়ে ছিলেন  পিসেমশাইয়ের পোস্টিিং সমস্যায়।
  যাই হোক, মূল শহরে বেশ সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট। বোঝা যায় সব উচ্চবিত্ত, নিরাপত্তাও বেশ আঁটোসাঁটো। লক্ষ্য করলাম একটা তুলসীর টব রুমের ভেতরে জানলার কাছে রাখা। পিসিকে বললাম – “ঘরে কেন, বাইরে ব্যালকনিতে রাখলে তো রোদ হাওয়া পেত গাছটা”। পিসি উত্তর দিল “বাইরে রাখলে রাস্তা থেকে দেখা যাবে, এতে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয় থাকবে, বিপদ হতে পারে”। আর এদেশে?

একদিন বাইরে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, আমাদের এখানে বিভিন্ন ওয়ার্ডের উদ্যোগে যেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, মনে হল অনেকটা সেরকম। অনেকের সঙ্গে আমিও দাঁড়িয়ে দেখছি, একজন শিল্পী নজরুল গীতি (বাংলাদেশে বলে নজরুল সঙ্গীত) পরিবেশন করছেন। স্টেজে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে দাড়ি টুপি পরাও কয়েকজন আছেন। গায়কী একটু অন্যরকম হলেও গায়ক খুব ভালো গাইছেন। কোন গানটা ছিল ঠিক মনে নেই, একটা গান শেষ হওয়া মাত্র স্টেজে উপবিষ্ট একজন দাড়ি টুপি পরা বয়স্ক ভদ্রলোক আবেগে কাঁপতে কাঁপতে এক লাফে উঠে এসে গায়কের হাত থেকে মাইক্রোফোনটা কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন “কোন মালাউনের (হিন্দুর) বাচ্চার সাধ্য আছে কি এমন গান লেখার?” বাড়ি এসে শুনলাম ঐ কথাটি রবিন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলা। আমরা চলে আসি, যথারীতি অনুষ্ঠান চলতে থাকে। ভাবুন তো, এদেশের কোন সরকারি অনুষ্ঠানে এরকমটা হচ্ছে!

মজার অভিজ্ঞতাও আছে। কি জানি কিনেছিলাম, দোকানদার যে টাকাটা ফেরত দিয়েছে , সেটা দিয়ে পুরো আকাশ দেখা যাচ্ছে । আমি পাল্টে দিতে বলায় দোকানদার অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “ইন্ডিয়ার”? একদিন রিক্সায় কোথায় যাব, পিসেমশাই দেখলাম রিক্সাওয়ালাকে ডাকছে ‘খালি’ বলে। বুঝলাম, সওয়ারী ছাড়া রিক্সাকে ‘খালি’ বলে।

প্রথমবার বাবার সঙ্গে গিয়ে আমাদের ‘দ্যাশের বাড়ি’ ও দেখতে গিয়েছিলাম। বেদখল হয়ে যাওয়া শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ি দেখে একটু নস্টালজিক হয়ে গেলেও বাবার মুখে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলার কোন দুঃখ বা রাগের অভিব্যক্তি কিন্তু দেখেছি বলে মনে পড়ে না । সবই যেন ভবিতব্য, কপাল – আমাদের বাবা দাদারা এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। আমরাও যদি ওদের মতোই ভাবি, আমাদের কপালও কি ওদের মতোই হবে না? ওদের যদিও ঠাঁই একটা জুটেছিল, আমাদের কিন্তু জুটবে না।

(সৌজন্যেঃ শ্রী Anirban Dasgupta….।।)