মোদ্দা কথা মুসলমানদের কাছে গরু খাওয়াটা হল এদের দাপট এবং হিন্দুদের সহনশীলতা পরীক্ষা করার মিটার।

যেহেতু ধর্ম নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, গরু খেলে জাত চলে যায় কি না, গেলে কতটুকু যায় বা হিন্দুদের শাস্ত্রে এ নিয়ে কী লেখা আছে, কী নেই – এ ব্যপারে আমার কোন মাথা ব্যাথাই নেই।

কিন্তু মুসলমানদের গরু খাওয়া নিয়ে অবশ্যই আমার মাথা ব্যাথা আছে। কারণ এ খাওয়া শুধু মাংস খাওয়া নয়। ভাবছেন এ আবার কেমন কথা ! বুঝিয়ে বলছি…,

হিন্দুদের শাস্ত্রে গরু খাওয়া সত্যিই নিষিদ্ধ কি না – এরকম প্রশ্ন যদি তোলা যায়, ইসলামে সত্যিই গরু খাওয়ার কথা বা গরুই কুরবানী দিতে হবে, এমন নির্দেশ আছে কি না – সেই প্রশ্নও তোলা যায়।

দিনটার নামই তো ‘বকরী ঈদ’ ! তো, ‘বকরী’ মানে কী? ঊষর তৃণহীন শুষ্ক মরুতে গরু কি ছিল? মহম্মদ সারা জীবনে কোন গরুর ডাক শুনেছে বলে মনে হয় না। যতটুকু জানি, কুরবানীর অর্থ নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গ করা। আর একেবারে গূঢ় তত্ত্ব না খুঁজলে উট বা দুম্বা কুরবানী দেওয়ার কথা। তাহলে এই উপমহাদেশেই মুসলমানদের গরু নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন? গরুই খেতে হবে – এই জিদ কেন?

আমার তো মনে হয় – কোন ধর্মীয় নির্দেশ নয়, এই উপমহাদেশে হিন্দুদের উপর আধিপত্য দেখাতেই, সংখ্যাগুরুদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার জন্যই জিদ দেখিয়ে এদেশের মুসলমানরা গরু খাচ্ছে। এ খাওয়া শুধু মাংস খাওয়া নয় , আশপাশের হিন্দুদের কতটুকু সন্ত্রস্ত করে দিয়ে বা কতটুকু দাপটের সঙ্গে খেতে পারছে, খেতে গিয়ে কোন বাধা আসছে কি না, এলে সেটা কতটুকু – মোদ্দা কথা মুসলমানদের কাছে গরু খাওয়াটা হল এদের দাপট এবং হিন্দুদের সহনশীলতা পরীক্ষা করার মিটার। সংখ্যা, পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে বুঝে এরা এই মিটারের কাঁটা কমিয়ে বাড়িয়ে পরীক্ষাটা চালিয়ে দেখে অনবরত। সেভাবেই কোথাও জবাইটা করে একটু রেখে ঢেকে, কোথাও বা অভিযোগ ওঠে জবাই করা গরুর রক্ত এলাকার টিউব ওয়েল বা জলের অন্যান্য উৎসে মিশিয়ে দেবার, মাংস বা হাড় ছড়িয়ে দেওয়ার । ফেসবুকে গরু জবাইয়ের বিভৎস দৃশ্যগুলি, গরুর রক্ত মাখা বাচ্চাদের ছবিগুলি পোষ্ট করে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে এ খাওয়া যে শুধু খাওয়া নয়, পেছনে রয়েছে আরও কিছু। খ্রীষ্টানরাও তো গরু খায়, তাদের এই দেখনদারীটা নেই কেন? বহিরাগত বর্বর মুসলিম দস্যুরাও গরুকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে সবসময়। কোন জনপদ দখলের পর লুটপাট, ব্যপক ধ্বংস যজ্ঞ, নির্বিচার হত্যা, গণধর্ষণ, যৌনদাসী বানানোর পাশাপাশি গরু কেটে মন্দির সহ জনপদের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত এবং মাংস ছড়িয়ে দেওয়া হত, জোর করে মানুষের মুখে গুঁজে দেওয়া হত। নিকট অতীতেও ছেচল্লিশের নোয়াখালীর হিন্দু নিধন যজ্ঞ সহ বহু ক্ষেত্রেই গরুর মাংসকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানেও মুসলিম অধ্যুষিত নানা জায়গায় এই সংক্রান্ত নানা রকম অভিযোগ ওঠে প্রায়ই । অবশ্য হিন্দু তালিবানের দেশে সংখ্যাগুরুদের ভয়ে একেবারে কুঁকরে থাকা সংখ্যালঘুরা মাঝে মাঝে এরকম করতেই পারে।

একই দেশ ভেঙ্গে সৃষ্টি হওয়া আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কী করে? সংখ্যাগুরুদের ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়ে শূয়োর বা কাছিমের মাংস খাওয়া দূর নামও মুখে আনে না । যে মাংস খায়, সেটাও হালাল মাংস। রোজার মাসে বাইরে খায় না। সেদেশের সংখ্যালঘুরা যদি এদেশের মতো করে সংখ্যাগুরুদের ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্যই ঐ সব মাংস বা বিনা হালাল মাংস জিদ ধরে খেতে চাইত, রোজ কত ‘আখলাখ’ মরতো কে জানে ! এমনিতেই যা অবস্থা, তেমন হলে একজন হিন্দুরও আর সেখানে থাকা সম্ভব হত না। লাথি ঝাঁটা খেয়ে কোনমতে টিঁকে থাকার মধ্যেই সেসব দেশের সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ চাহিদা সীমাবদ্ধ। এখানেই পার্থক্য মানসিকতার । এভাবেই মুসলিম প্রধান দেশের সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে মিশে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে একসময় টিঁকে থাকার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর অমুসলিম প্রধান দেশে অমুসলিমদের উদারতার সুযোগ নিয়ে মুসলমানরা নিজেদের রীতি নীতি সংখ্যাগুরুদের উপর চাপাতে চাপাতে একসময় হয়ে যায় নিয়ন্ত্রক ।

কিভাবে…?

লক্ষ্য করেছেন কি, সম্পূর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত হলেও আমাদের এলাকার মাংসের দোকান গুলিতে যে মাংস বিক্রি হয়, সেটা কিন্তু হালাল করা, অর্থাৎ এক কোপে না কেটে মুরগি বা পাঁঠাটাকে ইসলামী রীতিতে গলায় পোঁচ দিয়ে কাটা। কেন বলুন তো? হালাল না হলে যে ক’জনই হোক, মুসলমান খদ্দের তো আসবে না ! কিন্তু যেভাবেই কাটুক, হিন্দুরা আসবে ঠিকই। বোকা হিন্দুদের তো এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই – হালাল, বিনা হালাল সবই কিনবে । এভাবেই সংখ্যালঘু হয়েও এরা হয়ে যাচ্ছে সংখ্যাগুরুদের নিয়ন্ত্রক, প্রাধান্য পাচ্ছে এদের ইচ্ছাই। তিনজন মুসলমানের ধর্মান্ধ ইচ্ছা দশজন হিন্দুর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কারণ ওরা ওদের ধর্মান্ধতায় অনড়, সংঘবদ্ধ আর হিন্দুরা উদাসীন, একতরফা সেক্যুলারিজমের নেশায় বুঁদ । কিন্তু আজকে তিনজন মুসলমানের দিকে চেয়ে জবাই করা হালাল মাংস দশজন না হোক, পাঁচজন হিন্দুও যদি কিনতে অস্বীকার করতো, দোকানী তখন কোনটা করতো? কাজেই দোষ ঐ মাংস দোকানীর নয়, দোষ আমাদের। দোষ তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস বা সিপিএম এর নয়, দোষ আমাদের। কারণ রাজনীতিও ঠিক সেই হিসাবেই চলছে। ত্রিশ শতাংশ মুসলমানদের প্রতি নির্লজ্জ সীমাহীন তোষণ যদি সত্তর শতাংশের মধ্যে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশকে ক্ষুব্ধ করে তুলতো, সংঘবদ্ধ করে তুলতো – রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই তোষণ করার সাহস পেত ? আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও তো আছে রাজনীতি, সেখানে কি হয় সংখ্যালঘু তোষণ? আর এ জন্যই ওদেশে সংখ্যালঘু হয়ে হিন্দুরা হালাল মাংস খেতে বাধ্য, এদেশে সংখ্যাগুরু হয়েও । এজন্যই ওদেশে হোক আর এদেশে, সংখ্যাগুরু হোক আর সংখ্যালঘু, ও পারে যারা নাসিরনগর, রংপুর বা মালোপাড়া করে, এ পারেও তারাই ধুলাগড়, বাদুড়িয়া বা দেগঙ্গা করে। ও পারে যারা মার খায়, সব ফেলে এ পারে পালিয়ে এসে তারাই এ পারেও মারই খায়।

যাই হোক, মাংসে আসি। এবার বামপন্থীরা বলবে যে মাংস তো মাংসই, হালাল করা হলেই কী আর না করা হলেই বা কী, হিন্দুদের আপত্তি করার কী আছে ! আমি একমত, কিন্তু ঠিক এই কথাটাই এরা এদের তুতুভাই মুসলমানদের বলবে কি? এদের সঙ্গের মুসলিম কমরেডরা মানে কি?

বিকাশ গরু খেলেও সেলিম শূয়োর কেন খেল না – এই ধরনের কথা বড় ক্লিশে হয়ে গেছে। তাছাড়া ‘আপনা রুচি খানা’ – যার যা ভালো লাগে খাবে, ভালো না লাগলে খাবে না, এটাতেও বামপন্থীদের সঙ্গে আমি একমত। তাছাড়া ভোটবাবু দের ভোটের জল মেপে চলতে হয়। এরা জানে হিন্দুরা উদার বলে বিকাশ কড়মড়িয়ে গরু খেলেও হিন্দু ভোটে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু সেলিম শুয়োর খেলে মুসলিম ভোটে একেবারে ধস ! মুসলমানরা যে হিন্দুদের মতো নয়, মুখে না বললেও এদের চেয়ে ভালো আর কে জানে !

যাই হোক, আপনা রুচি খানা !
কিন্তু এটা দিয়ে হালাল মাংস নিয়ে মুসলমানদের গোঁড়ামির কী উত্তর দেবে বামপন্থীরা? এটা কি ধর্মান্ধতা নয়, নাকি বিজ্ঞান? নাকি ইসলামের ধর্মান্ধ বর্বর মধ্যযুগীয় অমানবিক কুপ্রথা গুলি অবশ্যই মানতে হবে, এগুলির বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না! হালাল সার্টিফিকেট দেওয়া খাবারের দোকানে ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক। বিকাশ সুবোধ তো শুধু নয়, অনেক বামপন্থীই গরু খায়, খেয়ে আত্ম প্রচারও করে। তা খেতেই পারে। কিন্তু মুসলমান কমরেডরা নোংরা শুয়োর নয়, জবাই না করলে অর্থাৎ হালাল না হলে এদের পছন্দের মাংসও যে খায় না – এর উত্তর কী দেবে? সেই ধর্মীয় গোঁড়ামির হালাল মাংস যে অন্যদের খাওয়াতে বাধ্য করছে – এর উত্তর কী দেবে ! কী উত্তর দেবে কথায় যে সংবিধানকে সামনে এনে দাঁড় করানো হয়, তার ৪৮ নং ধারার? কী উত্তর দেবে বামপন্থীদের বাপের দেশ কিউবায় গো হত্যা নিষিদ্ধকরণ এর? উত্তর দেবে না, কারণ এরা বামৈস্লামিক, ইসলামের গর্ভস্রাব !

তাই গরু খেলে জাত চলে যায় কি না, সে ব্যাপারে মাথা ব্যাথা না থাকলেও যেহেতু মুসলমানরা গরুর মাংসকে খাদ্যের চেয়েও বেশি ব্যবহার করছে, করেছে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসাবে, এ নিয়ে অবশ্যই আমার মাথা ব্যাথা আছে – হিন্দু নয়, মানুষ হিসাবে । যদি ইসলাম না থাকতো, আমাকে আমার ধর্ম নিয়ে মাথাই ঘামাতে হতো না । যদি ধর্ম হীন হয়েও বাঁচতে চাই, ইসলামের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে আমার । হিন্দু ধর্ম বা হিন্দু আধিপত্য আমাকে ধর্মহীন হয়ে বাঁচতে দিলেও ইসলাম আমাকে সেই সুযোগ দেবে না, এমনকি ইসলাম নিয়ন্ত্রিত সরকার বা প্রশাসনও না।