মুসলিম সম্প্রদায়ের মঙ্গলার্থে, কল্যাণের জন্য যে শব্দবিভেজিত বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা ছিলো তা থেকেই উৎসারিত।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে ‘মুসলমান লেখক’ ‘মুসলমান শিল্পী’ ‘মুসলমান সাংবাদিক’ ‘মুসলমান অভিনেতা’ ‘মুসলমান বুদ্ধিজীবী’- এরকম বিভাজন করে দেখতেন যারা তারা সবাই যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেই কাজটা করতেন তা না। দেশভাগের আগে মুসলমানদের মধ্যে যারা আধুনিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করত তারা স্বসম্প্রদায়কে আধুনিক চিন্তা চেতনায় টেনে আনার জন্য আলাদাভাবে প্রমোট করতেন। মুসলমানদের মধ্যে যাতে ভাল লেখক জন্মায় তার জন্য মুসলমানদের জন্য আলাদা কাগজ বের করা হয়েছিলো। এটা এ জন্য না যে কোলকাতার বড় কাগজগুলো হিন্দু লেখকরা চালায় কাজেই আমরা সেগুলোতে লিখব না। এটা এ জন্য যে, মুসলমানদের মধ্যে সে মাপের লেখক বের হচ্ছে না যাদের লেখা ভারতী’র মত কাগজে ছাপা হতে পারে। নজরুল ইসলাম অনন্য প্রতিভা তার কথা বাদ। বাকীদের সওগাতের মত কাগজে লিখে নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে…। কিন্তু এই ‘মুসলমান’ তত্ত্ব পরে অশিক্ষিত ধার্মীকদের হাতে পড়ে, শিক্ষিত ইসলামপন্থিদের হাতে পড়ে, জ্ঞানী সাম্প্রদায়িক মুসলমানের হাতে পড়ে ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক দানবে পরিণত হয়।

দেশভাগের প্রাক্কালে এই ‘মুসলমান’ চেতনা মুসলিম লীগের হাতে রক্তের ফিনকি ছুটিয়ে ছিলো। বদরুদ্দিন উমারের বাবা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগের অন্যতম কান্ডারী। তিনি শেখ মুজিবদের ডেকে বুঝিয়েছিলেন, দেখো হিন্দুদের শত্রু বানিয়ো না, বরং তাদের বোঝাও যে, পাকিস্তান আসলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের জন্যই মঙ্গল হবে। আমরা পাকিস্তানের দাবী করছি সেটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে আন্দোলন না…। মুসলিম লীগে আবুল হাশিমের কন্ঠস্বরটি ছিলো হিন্দু বিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িক আরো অসংখ্য কন্ঠস্বরের কাছে পরাজিত আর ক্ষীণ। রক্তাক্ত দাঙ্গার মধ্য দিয়ে দেশভাগ সম্পন্ন হয়েছিলো। আর এই দাঙ্গা একদা পিছিয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের মঙ্গলার্থে, কল্যাণের জন্য যে শব্দবিভেজিত বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা ছিলো তা থেকেই উৎসারিত।

দেশভাগের পর বাঙালী মুসলমানের ‘মুসলিম’ পরিচয়টি ক্রিয়েটিভ কাজকর্মে জড়িত লোকজনের জন্য প্রয়োজন ফুরিয়েছিলো। কেননা পাকিস্তানে তখন ‘মুসলিম’ পরিচয়ে বৈষম্য কিংবা প্রভাব বিস্তার কোনটাই সম্ভব ছিলো না। তারপর পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হলো। নতুন দেশটি রাষ্ট্রীয় নাম আর পতাকা পরিবর্তন ছাড়া পাকিস্তান থেকে কোন কাঠামগত সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় পরিবর্তন হওয়ার সুযোগই ছিলো না। তবু আজতক ঢাকার এক শ্রেণীর ক্রিয়েটিভ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা, কবিতা লেখকরা, সিনেমার কারিগররা কেন নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়? তারা কি এরকম সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বিপদটা জানে? এখন আর হিন্দুরা সামাজিকভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বি হবার সম্ভাবনা নেই। দেশভাগের মাধ্যমে সেই মাজাটা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। তাই এখনকার বুদ্ধিভিত্তিক লেবেলের এই ধরণের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের কারবারিরা সেক্যুলারিমজকে দুর্বল করে নিজেরাই ভিকটিম হতে যাচ্ছে। তখন এই প্যান ইসলামিজম কচুকাটা হবে ফান্ডামেন্টালিজম মুসলমানের হাতে।