বাংলা নববর্ষ নিয়ে বাঙালী হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধদের কোন রকম আপত্তি আছে কিনা?

আপনি হয়ত নিজেকে ভাবছেন এক দুর্ভাগ্য জাতি হিসেবে যারা কিনা নিজেদের নববর্ষ পালন নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। তার আগে আপনি চিন্তা করেন দেখুন বাংলা নববর্ষ নিয়ে বাঙালী হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধদের কোন রকম আপত্তি আছে কিনা? একমাত্র বাঙালী মুসলমান ছাড়া বাঙালী অন্যান্য ধর্মালম্বীদের কারোর কোন আপত্তি নেই। খ্রিস্টান ধর্মটাও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে। বাংলা সংস্কৃতি ভাষা উৎসব নিয়ে মুসলমানরা ছাড়া আর কেউ প্রশ্ন তুলেনি। সমস্যাটা যে কেবল বাঙালী মুসলমানের তা নয়। পৃথিবীতে এমন কোন জাতি নেই যেখানে মুসলমান সম্প্রদায়রা তাদের নিজ সংস্কৃতি, উৎসবকে হারাম বলেনি। জাতিতে মঙ্গলীয় হোন, পার্সি, হূন, মুঘল, ইউরোপীয়ান, সিংহলিজ, তামিল… যদি ধর্মে মুসলমান হোন তাহলে প্রতিনিয়ত আপনার নিজ জাতিসত্ত্বার উৎসব সংস্কৃতি ভাষাকে আপনার নয় বলে মনে হবে। ইসলামের এটাই প্রধান চরিত্র যে সে সংস্কৃতি ও ভাষার উপনিবেশ চালায়। ইসলাম আরবের সংস্কৃতিকে হারাম করেছে। এখন যে ‘ইসলামিক সংস্কৃতি’ বলতে আমরা যা জানি সেটা আরবের সংস্কৃতি নয়। আরবরা ছিলো কবি। গান কবিতার মজলিশ ছিলো তাদের রক্তে রক্তে। আরবরা তাদের প্রধান মন্দির কাবাঘরে সেরা কবিতাগুলি সাঁটিয়ে রেখে দিতো সবাইকে পড়ানোর জন্য। আরব সমাজে কবিদের কদর ছিলো সবচেয়ে বেশি। এই সুর সঙ্গীতময় একটা জাতিকে ১৪০০ বছর আগে ইসলামের মাধ্যমে তাদের মগজে সঙ্গীত বিরোধীতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আরবের সংস্কৃতিকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ বা অন্ধকার যুগ বলে তা প্রত্যাখান করা হয়। আরবরা নিজেদের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শেখে। ইসলাম যখন উপনিবেশ ছড়াতে শুরু করে মক্কা মদিনা ছেড়ে অন্যত্র- সবখানেই তাদের সংস্কৃতি ভাষার এই উপনিবেশ চলতে থাকে। একজন চাইনিজ মুসলিম তার জাতির সংস্কৃতি উৎসবকে হারাম মনে করে। বাংলাদেশের একজন মানুষ হিসেবে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে বাঙালী সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী হারাম শিরক এরকম সে কতটা শুনতে অভ্যস্থ। এটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ কোন জাতি কেন মুসলমানদের মুখ থেকে শুনতে অভ্যস্থ হবে? ইউঘুর চাইনিজ মুসলমানদের কথা ভাবুন, চাইনিজরা বৌদ্ধ খ্রিস্টান দুই ধর্মের অনুসারী হয়। কেউই চাইনিজ সংস্কৃতি জাতিসত্ত্বার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়নি। খালি ইউঘুর মুসলমানদের সমস্যা হলো কেন? কেন গোটা ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে মুসলিম ঘৃণা বাড়ছে? আপনি কেবল বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে বাকী ঘটনাগুলিকে বিচার করে দেখবেন।

বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে তবু কেউ কেউ। আনন্দের সত্যি কি কিছু আছে? দেশে বৈশাখী ভাতা চালু হয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় মুরব্বী বানানো হয়েছে একটা ধর্মান্ধ পশুকে। সেই পশু বলেছে মুসলমানরা কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দিবে না। ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলো। শেষে প্রশাসন তাদের সঙ্গে বসে কওমিদের সেই অবস্থান থেকে সরিয়ে আনে। কেন এই হাতে পায়ে ধরা? যারা মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছে আইনই তো তাদের প্রতিরোধ করবে। ইউনিস্ক যে শোভাযাত্রাকাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেটাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বুক চেতিয়ে কি করে অপরাধীরা ঘুরে বেড়ায়? তাদের সঙ্গে প্রশাসন কেন আলোচনা করতে বসে? তাহলে ঘটা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈশাখের শুভেচ্ছা জানানোর কি দরকার? আপনি এমন একটা উদাহরণ দেখান যে কোন জাতির নববর্ষকে হারাম বলে তা উদযাপনকে প্রতিহতের ঘোষনা দিয়েছে। বন্দেমাতরম গায়নি মুসলমানরা। কারণ দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করা শিরক তো বটেই সেই মায়ের পায়ের নিচে প্রমাণ করা তো আরো বড় শিরক। ভারতবর্ষ তাই কখনই ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। ভারত ভাগ হয়েছিলো সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, এখন ৮০ ভাগ মানুষ পহেলা বৈশাখকে হারাম মনে করে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতা উঠে গেছে। দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘটা করে বৈশাখ পালন উঠে গেছে। এক সময় মুসলমানরা বৈশাখের দিনে মিলাদ পড়িয়ে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াত। সেটাও বন্ধ কারণ এসব কুরআন হাদিসের কোথাও নেই। রমনায় যে বছর বোমা হামলা চালালো ইসলামিস্টরা ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, সারা দেশের সাধারণ মানুষের সেকি উল্লাস! এমন কি সেদিন রমনায় যাওয়া বখাটেরা পর্যন্ত বলাবলি করছিল, উচিত হইছে! বেয়াল্লাপণার জবাব হইছে…। এগুলি কি আমেরিকার আফগানিস্থানে বোমা ফেলার প্রতিক্রিয়া? সাম্রাজ্যবাদী কলোনিয়ান যুগের প্রভাব? যেসব বামপন্থি এরকম বিশ্লেষণ করে তারা আহম্মক তো বটেই, একই সঙ্গে তারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা ইমাম গাজ্জালি পড়েনি। এডওয়াড সাইদ ভিএস নাইপলকে ইসলামফোবিক বলেছিলেন যখন তিনি লিখেছিলেন ইসলাম ভাষা ও সংস্কৃতির উপনিবেশ চালায়। একটা জাতি যখন তার মুসলমানিত্ব রক্ষার্থে নিজের জাতি সত্ত্বার সব কিছু পরিত্যাগ করতে চায়, নিজের যা কিছু তা অন্যের বলে দাবী করে- সেটা কি ইসলামের উপনিবেশ নয়? প্রচীন সভ্যতা মহেঞ্জাদারো বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত। এজন্য কোন পাকিস্তানীই গর্বিত নয়। কারণ এসব পৌত্তলিক সভ্যতা তাদের নয়। মিশরীয়রা নীল নদের প্রাচীন সভ্যতা নিয়েও গর্বিত নয়। আশ্চর্য যে মশিরীয়রা ইসলাম গ্রহণের পর তারা মনে করে তারা মুসলমানরা এমন এক জাতি যাদের কেন্দ্র হচ্ছে মক্কা মদিনা। আমাদের বাঙালী মুসলমানদেরও কিন্তু সোনার বাংলার অল্টারনেটিভ আছে ‘সোনার মদিনা’! মুসলমান বাংলার জন্য তাই কাঁদে না, কাঁদে ‘মদিনা মদিনা’ বলে। তার ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার দাবী ধোপে টেকে না যখন সে বাংলা ভাষায় মুসলমানিত্ব আনতে ইচ্ছাকৃত আরবী উর্দু আমদানি করে। মুসলমানের কাছে দেশের মাটি পবিত্র সেরা নয়। তার কাছে মক্কার তপ্ত বালু অনেক পবিত্র। তাই সংঘাত অনিবার্য সুর ও অসুরের সঙ্গে। ইসলামের সঙ্গে প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সংস্কৃতির সঙ্গে, জাতির সঙ্গে, প্রতিটি গলিতে, গ্রামে সংঘাত অনিবার্য। আমরা অচিরে এক সংঘাতময় পৃথিবী দেখতে থাকব যেখানে জাতীয়তাবাদ উগ্র চেহারা নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ করছে। যেটা অলরেডি আমরা ঘটে দেখছি সর্বত্র। মজাটা হচ্ছে পাবলিক প্লেসে সিগারেট খেলে অর্থ জরিমানা করা হয়। তেমনভাবে পাবলিক প্লেসে মানুষকে অহেতুক ভোগান্তিতে ফেললে নিশ্চয় আইনত কিছু করার আছে। একটা জনাকীর্ণ রেল স্টেশনে মানুষের চলার পথের মাঝখানে এক মহিলা নামাজ পড়তে শুরু করে দিলো। বারবার তাকে উঠে যেতে বলার পরও সে উঠবে না। একটা সাদা চামড়ার পুলিশ যখন তাকে টেনে সরাতে গেলো তখন হাতে হাতে থাকা মোবাইলগুলো সব সক্রিয় হয়ে উঠল। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল- এক নামাজরত মুসলিম মহিলাকে পুলিশ টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে দিচ্ছে…। হায় হায় করে উঠল লিবারালরা, এ তো ইসলামোফোবিয়া!
Susupto Pathok