১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস।

১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস: ১৯৪৭ এর পর থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত কেন ৫ বছরে পূর্ববঙ্গের হিন্দুর সংখ্যা ২৯% থেকে ২২% এ নেমে এল তার ইতিহাস কোথাও পাওয়া যাবে না, কোন সেকুলার বা মুসলিম ঐতিহাসিক সেই ইতিহাস লিখবেন না, কেন না তাহলে তো আয়নায় নিজের মুখ দেখতে হয়। হিন্দুদের সেই ইতিহাস জানা দরকার, যা জানলে আপনাদের শরীরে শিহরণ জাগবে।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবী উত্থাপনের পর ১৯৪৬ সালের ১৬ই থেকে ১৯শে আগস্ট মুসলিম লীগ পাকিস্তান আদায়ের জন্য কলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশন পালন করে। ২০ হাজার অসহায় নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করে, হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ, ভাংচুর, লুঠপাট করে এবং অসংখ্য হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করে, হিন্দুদের প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরেরও চেষ্টা করে। এরপর আক্রমণ শুরু হয় নোয়াখালিতে, সেখানে নৃশংসভাবে খুন করা হয় ১ হাজার হিন্দুকে, ধর্ষণ করা হয় ১২ থেকে ৪২ এর সব হিন্দু নারীদের, বলপূর্বক ধর্মান্তরণ করা হয় প্রায় সবাইকে। নানা চাপে পড়ে জন্মভিটা থেকে বিতাড়িত হয় বেশীর ভাগ হিন্দু।
হিন্দুদের এই রক্তপাতের ওপর দেশ ভাগ হল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে প্রাণ গেল ২০ লাখ হিন্দু ও শিখের, ধর্ষিতা হল ১ লক্ষ নারী, উদ্বাস্তু হলো কয়েক কোটি হিন্দু ও শিখ! কিন্তু এত কিছু পেয়েও মুসলমানরা খুশি হল না। তাদের আরও চাই, বাকি হিন্দুদের বাড়িঘর, জমিজমা সব কিছু। এজন্য হিন্দুদের মারতে হবে, কাটতে হবে, মেয়েদের ধর্ষণ করতে হবে, তাদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে, পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের সংখ্যা যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে এনে ওদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে হবে।
এই পরিকল্পনা থেকেই শুরু হল ১৯৫০এর হিন্দু বিতাড়ন। অনেকেই এটাকে বলে ১৯৫০ এর দাঙ্গা, কিন্তু দাঙ্গা মানে দুই দলের মারামারি, এই ধরণের দাঙ্গা বাংলায় কখন হয় নি। ১৯৪৬ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার হিন্দুরা শুধু মুসলমানদের হাতে মারই খেয়েছে, একজন মুসলমানকেও হিন্দুদের হাতে প্রাণ দিতে হয়নি বা মার খেতে হয়নি। তাই কোন যুক্তিতেই এই হিংসাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না, প্রকৃতপক্ষে এসব ঘটনাকে দাঙ্গা নাম দিয়ে মুসলমানদের অত্যাচারকে যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করা হয়। ব্যাপারটা ওরাও মেরেছে তাই আমরাও মেরেছি, এতে দোষের কিছু নেই। বাংলায় কখন হিন্দু মুসলমান মারামারি হয় নি, মুসলমান সবসময়ই মেরেছে আর হিন্দু মার খেয়েছে।
শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সাল থেকে আর বলি হয়েছিল  নোয়াখালি, কুমিল্লা ও ঢাকার হিন্দুরা, পরবর্তী ঘটনাগুলি ১৯৪৬ এর সম্প্রসারিত রূপ। অনেকে ভেবেছিল দেশ ভাগ হয়ে গেলে এই সমস্যাগুলো মিটে যাবে। কিন্তু যারা এটা ভাবত তাদের মুসলমানদের মানসিকতা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। এই অজ্ঞানতার কারণে বার বার বাংলার হিন্দুদের হতে হয়েছে মুসলমান আক্রমণ এর শিকার এবং এখনও হতে হচ্ছে।
১৯৪৬ সালে কলকাতা ও নোয়াখালির পর উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৯৫০ সালে। ১৯৪৬ এর ঘটনা ঘটানোর জন্য যেমন ১৯৪০ সাল থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল এবং ক্ষেত্র প্রস্তত করা হচ্ছিল, ঠিক তেমনি ১৯৫০ সালের ঘটনার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিল।
এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে ঘটে এই ঘটনাটি: বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার দীঘারকুল গ্রাম, একজন হিন্দু নদীতে মাছ ধরছিল। সেই সময় সেখানে একজন মুসলমান নৌকা বেয়ে এসে তার সামনে জাল ফেলার প্রস্তুতি নেয়। এতে হিন্দু মুসলমানকে বাধা দেয় এবং তার মাছ ধরার স্থানে জাল ফেলতে নিষেধ করে। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, এতে আল্লা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করা মুসলমানটি মনে করে তার জেদ বজায় থাকছে না এবং এক হিন্দুর কাছে তার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিকটবর্তী মুসলমান গ্রামে গিয়ে ঐ মুসলমানটি রটিয়ে দেয় হিন্দুরা তার  নৌকায় থাকা এক মুসলমান মহিলাকে আক্রমণ করে অসম্মান করেছে। ঐ সময় গোপালগঞ্জের এস ডি ও নৌকাযোগে ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, এই অভিযোগ তাঁর কানে যায় এবং তিনি কোনরূপ তদন্ত না করেই মুসলমান ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে হিন্দুদের শায়েস্তা করার জন্য সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠালেন। স্থানীয় মুসলমানরা পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে হিন্দুদের বাড়ী ঘরে  হামলা করে এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে নির্মমভাবে প্রহার করার পর বাড়ীর সব মূল্যবান দ্রব্য লুঠ করে নিয়ে যায়। নির্মম প্রহারের ফলে ঘটনাস্থলে এক গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় হিন্দুদের উপর মুসলমানদের এই পৈশাচিক অত্যাচার বিশাল এলাকা জুড়ে  হিন্দুদের মনে ভয়ংকর ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করে।
এর পরের ঘটনাটি ঘটে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানায়। এখানকার ইউনিয়ন বোর্ডে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি সমস্যা হয়। কিছু হিন্দু ছিল কমিউনিস্ট, যে কমিউনিস্টরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই শুরু হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে কমিউনিস্ট বিতাড়ন। মুসলমানদের এই তাড়া খেয়েই পূর্ববঙ্গের সব হিন্দু কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গে হিজরত করেন এবং পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় বামেদের রমরমা।
যা হোক, ওখানে হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য এই কমিউনিস্ট সূত্রকেই কাজে লাগানো হয়। গৌরনদী থানার উপর কমিউনিস্টরা আক্রমণ করতে পারে, এই গুজব ছড়িয়ে চারিদিকে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয় এবং বরিশাল সদর থেকে গৌরনদী থানায় সশস্ত্র বাহিনী পাঠান হয়। তারা ঐ অঞ্চলের বহু হিন্দু বাড়ী লুঠ করে মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে যায়। যেসব বাড়ির মালিক কমিউনিস্ট হওয়া তো দূরের কথা রাজনীতিও করত না, এমনকি বাড়িতেও থাকত না, সে সব বাড়িও আক্রমণ করে লুঠ করা হয়। ঐ অঞ্চলের বহু হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয় এবং স্কুলকলেজের বহু হিন্দু ছাত্র শিক্ষককে কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে অযথা হয়রানি করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে লিখিত আবেদন করে কোন প্রতিকার পাননি। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমায় আর একটি ঘটনা ঘটান হয়। স্থানীয় মুসলমান ও পুলিশ মিলে হিন্দুদের বাড়ী ঘরে হামলা করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুঠ করে নিয়ে যায় এবং এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার নামে মিলিটারী চৌকি বসান হয়। এই মিলিটারি চৌকিতে খাবার সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয় হিন্দুদের, রাতের বেলা হিন্দু মেয়েদেরও ক্যাম্পে পাঠাতে বাধ্য করত মিলিটারী।
এরপরই ঘটে রাজশাহী জেলার নাচোলের ইলা মিত্রের সেই বিখ্যাত ঘটনা। কমিউনিস্ট দমনের নামে পুলিশের সাথে স্থানীয় মুসলমানরা মিলে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে এবং তাদের সম্পত্তি লুঠ করে। ওখানকার সাঁওতালরা সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে।
১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মোল্লারহাট থানার কালশিরা থেকে তিন মাইল দূরে ঝালরডাঙ্গা গ্রামে কমিউনিস্টদের খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ এক অভিযান চালায়। এই গ্রাম থেকে কিছু যুবক পালিয়ে গিয়ে কালশিরা গ্রামে জয়দেব ব্রহ্মের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শেষরাতে পুলিশ জয়দেবের বাড়িতে হানা দেয়, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে যুবকরা আবার পালিয়ে যায়। পুলিশ কাউকে না পেয়ে জয়দেবের স্ত্রীকে মারতে শুরু করে।  জয়দেবের স্ত্রীর চিৎকার শুনে ঐ যুবকরা আবার ফিরে আসে এবং পুলিশকে মারতে শুরু করে। ঘটনাস্থলে এক পুলিশ মারা যায় এবং অন্যরা আহত হয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ খুন হওয়ায় জয়দেব এবং তার কিছু প্রতিবেশী বিপদ আঁচ করতে পেরে পালিয়ে যায় এবং অন্য সাধারণ গ্রামবাসী, যারা নির্দোষ ছিল তারা গ্রামে রয়ে যায়। পরদিন বিকালে  খুলনার পুলিশ সুপার একদল সৈন্য এবং সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ঐ গ্রামে গিয়ে গ্রামের হিন্দুদের পাইকারি ভাবে প্রহার করা শুরু করেন এবং প্রতিবেশী মুসলমান দের হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ করতে উৎসাহ দেন। লুঠ হয় হিন্দুদের সম্পত্তি, মারা যায় বেশ কয়েক জন হিন্দু, অনেক নারী ও পুরুষকে জোর করে মুসলমান বানান হয়, মন্দিরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং মন্দিরকে অপবিত্র করা হয়। পুলিশ, মিলিটারী এবং স্থানীয় মুসলমানরা অনেক হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ করে।
১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এই গ্রামটি পরিদর্শনে যান পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। তিনি গিয়ে দেখেন  গ্রামটি জনশূন্য ও বিধ্বস্ত,  ৩৫০টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ৩টি বাড়ি অক্ষত আছে, বাকি সব বাড়ি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুদের নৌকা, গরু, ছাগল সব লুঠ করে নেওয়া হয়েছে। কালশিরার এই অত্যাচারিত, গৃহহীন হিন্দুরা এক দিনে পথের ভিখিরিতে পরিণত হয়ে কলকাতায় পালিয়ে যায় এবং অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। তাদের এইসব কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই সাম্প্রাদায়িক উত্তেজনার খবর পূর্ববঙ্গের পত্রিকাগুলিতে অতিরঞ্জিত করে ছাপান হয়, যদিও পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর পুলিশ ওমুসলমানদের যৌথ আক্রমণ এর সময় পত্রিকাগুলো চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।
কালশিরা ও নাচোলের ঘটনার জন্য পূর্ববঙ্গ বিধানসভার হিন্দু বিধায়করা সংসদে একটি প্রস্তাব এনে আলোচনা করতে চান, কিন্তু সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে হিন্দু বিধায়করা  সংসদ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। হিন্দু সাংসদদের এই ওয়াক আউটে মুসলিম লীগ সরকার ভালরকম রুষ্ট হয় এবং  ১৯৪৬ সালের পর হিন্দুদের আরেকবার শায়েস্তা করার জন্য প্ল্যান তৈরি করে। কলকাতার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে পূর্বববেঙ্গর পত্রিকাগুলোর অপপ্রচার এবং উস্কানি তো ছিলই, এর সাথে ১৯৫০ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঘটানো হয় আরেকটি ঘটনা।
ঘটনাটি এরকম: একজন মহিলার  কাপড়ে লাল রং মাখিয়ে তাকে ঢাকার সচিবালয়ে ঘোরান হয়  এবং প্রচার করা হয় যে ঐ মহিলার দুটি স্তন কলকাতার হিন্দুরা কেটে নিয়েছে। এই প্রচার বিশ্বাস করে সচিবালয়ের সমস্ত মুসলিম কর্মচারী কাজ ফেলে হিন্দুদের ওপর বদলা নেওয়ার জন্য শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। নির্বোধ মুসলমানরা এটা চিন্তা করে দেখল না, কলকাতায় কারো স্তন কেটে নিলে তার পক্ষে সুস্থ ভাবে ঢাকায় এসে হাঁটা সম্ভব নয় এবং তা থেকে তাজা রক্ত ঝরাও সম্ভব নয়। ১৯৫০ এ কলকাতা থেকে ঢাকায় যেতে লাগত প্রায় ২৪ ঘন্টা। তাহলে কলকাতায় স্তন কেটে নিলে কিভাবে কারো স্তন থেকে ২৪ ঘন্টা পর তাজা রক্ত ঝরে? কিন্তু দূরাত্মার ছলের অভাব হয়না, সচিবালয় থেকে শুরু হওয়া হিন্দুবিরোধী মিছিল বড় হতে হতে ১ মাইল দীর্ঘ হয় এবং ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে দুপুর ১২টায় একটি বিশাল জনসভার রূপ নেয়। ঐ জনসভায় মুসলিম লীগের নেতারা হিন্দুবিরোধী বক্তব্য রেখে উপস্থিত মুসলমানদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে আরো ক্ষেপিয়ে তোলেন এবং জনসভা শেষ হতে না হতেই পুরো ঢাকা শহরে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়।
শহরের সব জায়গায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও দোকানে অগ্নিসংযাগ ও লুঠপাট শুরু হল। যে যেখানে পেল সেখানেই হিন্দুদের খুন করতে লাগল। উচ্চপদস্থ সকল পুলিশ কর্মকর্তারা এই লুটতরাজ, খুন, অগ্নিসংযোগকে শুধু নীরব দর্শকের মতোই দেখলেন না,  তাঁরা দাঙ্গাকারী দের বুদ্ধি দিয়ে, কৌশল শিখিয়ে মুসলমানদের আরও উৎসাহ দিতে লাগলেন।
পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ওইদিন করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছলেন এবং ১৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু তাঁর কথায় কোন কর্ণপাত করা হয়নি, হিন্দু নির্যাতন চলতেই থাকে।
এই সময় সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “ঢাকায় ৯ দিন অবস্থানকালে আমি ঢাকা ও তার পার্শ্ববতী এলাকার সব দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করি। ঢাকা নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথে শত শত নিরপরাধ হিন্দুর হত্যালীলার সংবাদ আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে।”
ইসলামী জিহাদ সবসময়ই একটি লাভজনক ব্যাপার। কারণ এর সাথে গনিমতের মাল অর্থাৎ লুঠের সম্পত্তির বিষয়টি জড়িত। ঢাকায় যখন হিন্দুদের উপর হত্যালীলা, অগ্নি সংযোগ ও তাদের ধনসম্পত্তি লুঠ চলছে  এবং ঢাকার মুসলমানরা লাভবান হচ্ছে, তখন বরিশালের মুসলমানরা এই লাভ থেকে পিছিয়ে থাকবে কেন?  বরিশালে সেই সময় মুসলিম লীগের আরেক নেতা এবং পাকিস্তান আদায়ের বলিষ্ঠ নায়ক এ কে ফজলুল হক, কলকাতায় তাঁর ঝাউতলা রোডের বাড়ি বিক্রি করার জন্য কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। হিন্দুদের ওপর মার এবং লুঠপাট শুরু করতে হবে, কিন্তু এর জন্য একটা ইস্যু দরকার। বরিশাল শহরে মিথ্যা গুজব ছড়ান হল যে কলকাতায় হক সাহেবকে হিন্দুরা খুন করে ফেলেছে। রং মাখান কাপড়কে যারা স্তন কাটা রক্ত ধরে নিয়ে ঢাকা এবং তার আশেপাশে হাজার হাজার হিন্দুকে খুন করতে পারে, তাদের সম্পত্তি লুঠ করতে পারে, বাড়িঘর দোকানে আগুন দিতে পারে, মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারে, সেই মুসলমানদের কাছে হক সাহেব বেঁচে আছেন না সত্যিই মারা গেছেন তার সঠিক তথ্যের কোন দরকার ছিল না। শুরু হয়ে গেল বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালি ও পিরোজপুর, বড়গুণা জেলায় খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুঠপাট। খুন করা হল ৭ হাজার হিন্দুকে। এর সাথে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুঠপাটের বিষয়টি কল্পনা করে নিন।
ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে হত্যা, ধর্ষণ, লুঠ, অগ্নিসংযোগ আগে থেকেই চলছিল, বরিশালের সাথে সাথে তা সম্প্রসারিত হল কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালি, সিলেট, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এবং  মাদারীপুর জেলায়। এই সবগুলো জেলা মিলিয়ে ১৯৫০ এর  ফেব্রুয়ারি মাসে খুন করা হল ৫০ হাজার হিন্দুকে। আবার অনুরোধ করব, এর সাথে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট এবং ধর্মান্তর কল্পনা করে নিন।
বরিশাল শহরে এরকম পরিস্থিতির খবর পেয়ে বাড়ি বিক্রি বন্ধ রেখে ফজলুল হক তড়িঘড়ি বরিশাল ফিরে শহরে ও তার আশে পাশে ১৬ টি জায়গায় জনসভা করে বললেন, “তোমরা দেইখ্যা যাও, আমি মরি নাই। কিন্তু তোমরা এইটা কী করলা?” 
কিন্তু কে শোনে কার কথা? ঐ সময় ফজলুল হকের কথা শুনে এ্যাকশন বন্ধ করার চেয়ে হিন্দুদের মেরে লুঠের মাল হস্তগত করা ছিল নীতিহীন মুসলমানদের কাছে অনেক বেশী জরুরী। ফজলুল হক স্বশরীরে বরিশালে উপস্থিত হয়েও হিন্দুদের হত্যা করা থেকে মুসলমানদের নিরস্ত করতে পারেননি। যদিও এই সময়  হিন্দু হত্যা বন্ধে তার ফজলুল হকের সদিচ্ছা ছিল, এজন্য তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না হক ছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির একনিষ্ঠ সমর্থক, যে পাকিস্তানের জন্য হিন্দুদের এত রক্ত ঝরিয়েছিল মুসলমানরা। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ফজলুল হকই প্রথম পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলেন, ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডের তিনি ছিলেন নীরব সমর্থক এবং ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির ঘটনায় যে দুচার জন মুসলমানকে এ্যারেস্ট করা হয়েছিল, ফজলুল হক তাদের ছেড়ে দেবার জন্য সুপারিশ করেছিলেন।
বরিশালের এই সংবাদ পেয়ে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ঢাকা থেকে বরিশাল গেলেন।
সেখানাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “ইং ২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ আমি বরিশাল পৌঁছলাম এবং সেখানকার দাঙ্গার ঘটনাবলী শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই জেলা শহরে প্রচুর হিন্দুবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক হিন্দুকে খুন করা হয়েছে। এই জেলার প্রত্যেকটা দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা আমি পরিদর্শন করি। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না কী করে জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল পরিধির মধ্যে মোটর রাস্তা দ্বারা যুক্ত কাশীপুর, মাধবপাশা এবং লাখুটিয়ার মতো স্থানে মুসলিম দাঙ্গাবাজরা বীভৎস তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারে! মাধবপাশার জমিদারবাড়িতে ২০০ জনকে হত্যা ও ৪০ জনকে আহত করা হয়। মুলাদী নামক একটি স্থানে নরকের বিভীষিকা নামিয়ে আনা হয়। একমাত্র মুলাদীতেই ৩০০ জনের বেশি লোককে খুন করা হয়েছে। মুলাদী গ্রাম পরিদর্শন কালে আমি স্থানে স্থানে মৃত ব্যাক্তিদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। দেখলাম নদীর ধারে কুকুর শকুনেরা  মৃতদেহগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমি জানতে পারলাম সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে পাইকারি হারে খুন করার পর সব যুবতী নারীকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। রাজাপুর থানার অন্তর্গত কৈবর্তখালি গ্রামে ৬৩ জনকে একদিনে হত্যা করা হয়। ঐ থানা অফিসের কাছেই অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলি লুঠ করে জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের কেটে ফেলা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সমস্ত হিন্দুর দোকান প্রথমে লুঠ করে পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিস্তারিত বিবরণ যা এসেছে, তা থেকে খুব কম করে ধরলেও একমাত্র বরিশাল জেলাতেই খুন করা হয়েছে ১০ হাজার হিন্দুকে। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের দাঙ্গার বলির সংখ্যা মোট ৫০ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। গভীর দুঃখে আমি কাতর হয়ে পড়লাম। প্রিয় পরিজন হারান, স্বজন  হারান নারীপুরুষ ও শিশুদের সব হারান কান্না, বেদনা, বিলাপে আমার ভগ্ন হৃদয় হাহাকার করে উঠল। আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, “ইসলামের নামে কী আসছে পাকিস্তানে?” 
১৯৫০ এর সিলেট গণহত্যা: সিলেটে অসহায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর চালান বর্বর হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাঠ, অগ্নিসংযোগের বীভৎসতা এক দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে ১৯৫০ সালে। ২০৩টি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় এবং ৮০০টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। ধামাই, বারাধামি, পুবঘাট, বরইতলি গ্রামের ৫০০টি মনিপুরী পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিম আক্রমণে।
সিলেটে যখন গণভোট হয়, তখন থেকেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয় যে হিন্দুরা যেহেতু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তাই তারা পাকিস্তানের শত্রু। ১৯৫০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে বাগ্গে ট্রাইব্যুনাল (Bagge Tribunal) রায় ঘোষণা করে। সিলেটের মুসলিমরা আশা করেছিল আসামের করিমগঞ্জ পাকিস্তানের অংশ হবে কিন্তু তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেট বার এ্যাসোসিয়েশনের কিছু আইনজীবী এবং করিমগঞ্জের কিছু মোক্তার হুমকি দেয় যে সেখানে তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। ১৯৫০ এর ১০ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মুসলিমরা সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজারে সুবিশাল একটি পোস্টার টাঙায়।
লাঠি এবং অস্ত্র হাতে হিন্দুরা একজন মুসলিমের গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি ছবি ওই পোস্টারে আঁকা ছিল যার শিরোনাম ছিল, “হিন্দুস্থানের মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতন।”
লামডিং (আসামের একটি শহর) এবং কলকাতায় মুসলিমদের রক্তের নদী প্রবাহিত হচ্ছে, এমন গুজব ছড়ান হয়। স্থানীয় মুসলিমরা খুব আগ্রহসহকারে এই পোস্টার দেখত এবং কিছু অতি উৎসাহী এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে বলে শপথ নেয়। ১১ই ফেব্রুয়ারি গোবিন্দ পার্কে আয়োজিত র‍্যালিতে হিন্দুদের রক্তের জন্য হুঙ্কার ছাড়ে মুসলিমরা। এর মাঝে গুজব ছড়ান হয় কলকাতায় এ কে ফজলুল হককে হত্যা করা হয়েছে। সিলেটের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব বাংলার মুখ্য সচিবদের নেওয়া যৌথ সিদ্ধান্ত অনুসারে সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পৃথ্বীশ দাস নামে এক হিন্দু যুবককে জিন্দাবাজারে ছুরি দিয়ে কোপান হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়ান হয় যে আসামের করিমগঞ্জে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।
আইনজীবীদের একটি সমাবেশে সিলেটের ডেপুটি কমিশনার তাঁর অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “করিমগঞ্জে ৫০০০ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেখানকার বিশালসংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী সিলেটে আশ্রয়ের জন্য এসেছে।”
সেদিন সন্ধ্যায় মতি দাস নামক একজন বাঙ্গালী হিন্দুকে জালালপুরের কাছে হত্যা করা হয়। তিনজন মনিপুরীকে কোপান হয়, যাদের মধ্যে দুজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
১৯৫০ এর ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিকেলবেলায় লামাবাজার নামক বিপণী কেন্দ্র মুসলিমরা লুঠ করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে গ্রামাঞ্চলে লুঠপাট এবং হত্যা শুরু হয়। সকাল নটায় মূর্তি নামক গ্রাম আক্রমণ করা হয়। শত শত মুসলিম হিন্দুবিদ্বেষী স্লোগান সহকারে সেনাপতি পরিবারের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যদেরকে পিটিয়ে বাড়ি ঘর লুঠ করে মুসলিমরা। উপাসনালয়ের পবিত্র ছবি ও মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং পরিবারের সকল সদস্যদের বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। এরপর মুসলিমরা আজমতপুর, দাসপাড়া, নাসিয়াঞ্জি এবং মহেশপুর গ্রামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরবর্তী দিনে মুসলিমরা পুনরায় মূর্তি গ্রামে যায় এবং সেনাপতি পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি লিখিত বিবৃতি আদায় করে যে সেনপাতি পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। রাত ৮টায় সিলেট থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে নওগ্রামের গুরুচরণ ধরের পরিবারের উপর আক্রমণ হয়। পরের দিন সকাল ৭টায় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুসলিমরা গ্রামটি ঘিরে ফেলে। কমপক্ষে ১৫০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। মুসলিমরা সম্পূর্ণ গ্রামে লুঠপাট ও অগ্নিসংযোগ করে এবং সকল পারিবারিক মন্দির, উপাসনালয় ও পবিত্র তুলসীমঞ্চগুলো ধ্বংস করে। পাশের গ্রাম মন্মথপুরের মহেন্দ্রচন্দ্র দে, কামাকান্ত ধর, অশ্বিনীকুমার দের বাড়ি সহ সকল হিন্দুর বাড়িঘর লুঠ করে তারা। তারা অশ্বিনী কুমার দের কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরের দিন ধর্ষিতা, বিকৃতা, জ্ঞানশূন্য অবস্থায় হতভাগ্য মেয়েটির দেহ বাড়িতে ফেরত পাঠান হয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাতে মুসলিমরা ঢাকা দক্ষিনের ভরত দত্তের দুইটি অবিবাহিত কন্যাকে ধর্ষণ করে। ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকালবেলায় চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদের ফেরত দেওয়া হয়। তাদের পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তাদের আদালতের বাইরে কেস মীমাংসার জন্য ১০০০ টাকা দিতে বলে। সিলেট সদর পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সব গ্রামেই অসংখ্য মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করা হয়।
১৫ই ফেব্রুয়ারি গঙ্গাজল গ্রামের দীনেন্দ্রচন্দ্র দেব পুরকায়স্থের বাড়ি লুঠ হয় এবং মুসলিম দুষ্কৃতকারীরা তা দখল করে নেয়। সকাল ৯টায় বাহুবল (পূর্বে করিমগঞ্জের একটি সাবডিভিশন ছিল) পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলানি গ্রামে আক্রমণ চালান হয়। সেখানে হিন্দুবিদ্বেষী স্লোগান দেওয়া হয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং যারা পালাতে পারেনি তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়। যারা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা দক্ষিণ এবং কাচুয়ারি থেকে অনেক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েদের বলপূর্বক অপহরণ করে মুসলিমরা। হবিগঞ্জ সাবডিভিশনের চুনারঘাট পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার কেতন দাস,অশ্বিনী নাথ, বীরেন্দ্র নাথ সহ নাম না জানা আরও অনেক হিন্দু পরিবারের সকল সদস্যদের ঘৃণ্য উপায়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। ফেঞ্জুগঞ্জের একটি স্টিমার কোম্পানি লুঠ করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ইলাসপুরে পুলিন দে নামক একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়। ফেঞ্জুগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত মাজিগাঁও এলাকার অম্বিকা কবিরাজ ও মাখন সেনের বাড়ী লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বালাগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত রুকানপুর গ্রামের দিগেন্দ্র সেন, গোপেশ সেন এবং শিবচরণ দাসের বসতবাড়ি লুট করা হয় এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা নির্মম প্রহারের শিকার হয়। মাধুরাই এবং কাঁঠালখই এলাকার হিন্দুদেরও প্রহার করা হয় এবং তারা বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের শিকার হয়। গোলাপগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের ফুলসাইন গ্রামের বৈকুণ্ঠ রায় এবং রাসবিহারী রায়ের বাড়ি লুঠ হয়। বিশ্বনাথ পুলিশ স্টেশনের দণ্ডপাণিপুরের হিন্দুরাও ভয়ঙ্কর লুঠপাটের শিকার হয়। হিন্দুদের জোরপুর্বক গরু জবাই করে তাদের সেটির মাংস খাওয়ান হয় আর সবাইকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। টুকেরকান্দি গ্রামের ঘোষবাড়ি লুঠ করে মুসলিমরা। যোগেন্দ্র ঘোষকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করা হয় এবং অনেক হিন্দুকে কুপিয়ে আহত করা হয়। সিজেরকাছ এলাকার পাল, চৌধুরী সহ সকল ব্রাহ্মণবাড়ি লুঠপাট করা হয় এবং সবাইকে ধর্মান্তরিত করা হয়। বিমল স্মৃতিতীর্থ নামে একজন সজ্জন হিন্দু পণ্ডিত ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তাঁর পবিত্র পৈতে ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং তাঁকে পা দিয়ে মাড়িয়ে উপর্যুপরি কোপান হয়। ব্রাহ্মণদের মাথার শিখা বা টিকি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং উপাসনা মন্দির ও মূর্তিগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়।
১৬ই ফেব্রুয়ারি ৩০০ জন মুসলিমদের একটি দল আখরা গ্রাম আক্রমণ করে। গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত পালিয়ে গেলে তারা সব ছবি ও মূর্তি ধ্বংস করে। এর পর তারা হরিপদ চৌধুরী ও বিমল ভট্টাচার্যের বসতবাড়ি সহ পুরো গ্রামের সব হিন্দুবাড়ি লুঠ করে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি মুসলিম গুণ্ডারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দুদের আক্রমণ করে। তারা ব্রাহ্মণদের পৈতে টেনে ছিঁড়ে পা দিয়ে মাড়ায় এবং জোর করে তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করে। সুনাইতা এবং কুর্মা গ্রামের হিন্দু মহিলাদের উপর চালান হয় বীভৎস নির্যাতন। তাদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দেওয়া হয় এবং হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলা হয়। রাজগঞ্জ আখরা গ্রামের নীর ভট্ট এবং রাম চন্দ্র ভট্টের বাড়ি লুঠ করে মুসলিমরা। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ৫০০ থেকে ৬০০ মুসলিমের একটি দল ছাতক পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত লোকেশ্বর গ্রাম আক্রমণ করে। সেখানে হিন্দুদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের বাড়িঘর লুঠ করে এবং দুজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করে। এখানেও তারা ব্রাহ্মণদের পবিত্র পৈতে ছিঁড়ে ফেলে এবং মাথার চুলের শিখা বা টিকি কেটে দেয়। তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। মারকুল গ্রাম পুরোপুরি লুঠ করা হয় এবং গ্রামের সকল অধিবাসীদের মুসলমান বানিয়ে দেওয়া হয়। ১৯শে ফেব্রুয়ারি জকিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন সদরপুর গ্রাম আক্রমণ করা হয়।শুকলাল নমশূদ্রের বাড়ি লুঠ করে তারা। তার ভাই পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তাকে বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে জখম করে এবং লাথি মেরে পুলিশ স্টেশন থেকে তাড়িয়ে দেয়। রাতের আঁধারে গ্রামের হিন্দুরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সাঁতার কেটে নদী পার হয়। পারগ্রামের অক্রু নমশূদ্র এবং রমেশ নমশূদ্রের বাড়ি মুসলিমরা লুঠ করে এবং দখল করে নেয়।
সিলেটের এই অংশটি হুবহু উইকিপিডিয়া থেকে কপি
উদ্বাস্তু হিন্দুদের ভারতমুখী স্রোত: ১৯৪৮-৪৯ সালে বিচ্ছিন্ন দুএকটি ঘটনা যা  উপরে উল্লেখ করেছি তা ঘটলেও ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে হিন্দুদের উপর শুরু হওয়া গণআক্রমণ চলতে থাকে পুরো একমাস ধরে। এই সময় থেকেই ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য হিন্দুদের দেশত্যাগের স্রোত শুরু হয়। সেই সময় পূর্ববঙ্গে গোয়ালন্দ, পার্বতীপুর ও খুলনা, এই তিনটি জায়গা থেকে কলকাতার ট্রেন পাওয়া যেত। এজন্য ঢাকা,  ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর জেলার লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাড়িঘর, জমিজমা সর্বস্ব ত্যাগ করে একবস্ত্রে দেশত্যাগের জন্য এসে জড় হতে শুরু করে গোয়ালন্দে, উত্তরাঞ্চলের হিন্দুরা পার্বতীপুরে এবং যশোর ও খুলনাসহ পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুরা খুলনা স্টেশনে। সীমান্তের আশপাশের জেলার হিন্দুরা বাসে করে সড়ক পথে বা পায়ে হেঁটে ঢুকে পড়ে ভারতে। বরিশাল থেকে কলকাতা যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল জাহাজ। তাই বরিশাল, পটুয়াখালি, ভোলা জেলার হিন্দুরা বরিশালে এত পরিমাণে এসে জড় হতে শুরু করে যে জেটিতে স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়ে।