হেফাজতী ভাটুজ্জে মশাই তার গুরুবাবার লুঙ্গি বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে এখন অনাবশ্যক বাংলা ভাষা মুসলমানদের সৃষ্টি বলে বাংলা ভাষাকে সাম্প্রদায়িকভাবে যে বিতর্ক লাগাতে চেষ্টা করছেন তা নিছক মিথ্যা অপহরণের অভিযোগ তুলে ফেইসবুকে গুজব তোলার মত গুরুত্ব অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা মাত্র। ব্লগার কিলিং থেকে শুরু করে জঙ্গি উত্থানে লুঙ্গি গুরুবাবা ও তাদের চ্যালাদের জড়িত থাকার বিষয়ে একদিন নিশ্চয় সত্য প্রকাশিত হবেই। এই বিষয়ে আরো দুটো কথা বলার আগে বাংলা ভাষা নিয়ে এই বরাহটির অপপ্রচারের কিছু জবাব দেয়া যাক-।
বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো রূপ হচ্ছে চর্যাপদ। অনেকটা মানব বিবর্তনের মতই চর্যাপদ থেকে পরবর্তীকালে তিনটি ভাষা নিজস্বতা তৈরি করে আলাদা হয় যায় যথা- বাংলা, ওড়িয়া, অহমিয়া। এ কারণেই এই তিনটি ভাষাই তাদের আদি পিতা হিসেবে চর্যাপদকে দাবী করে থাকে।
এই চর্যাপদ ছিল বৌদ্ধদের ধর্মীয় সংগীত। এসব লিখিত হয়েছিল সুদীর্ঘকাল ব্যাপী। আশ্চর্য যে আধুনিক কালের পন্ডিতরা এই চর্যাপদ আবিস্কার করেছিলেন বাংলাতে নয়, নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরি থেকে! হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৯ (কয়েক জায়গায় ১৯১৬ বলে উল্লেখ করা হয়েছে) সালে প্রথম বই আকারে চর্যাপদের গানগুলো নিয়ে বই প্রকাশ করেন। গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে চর্যাপদ বাংলাতে না পেয়ে কেন নেপালে পাওয়া গিয়েছিল? ঐতিহাসিক কারণ এক্ষেত্রে দুটি শাসনকে অভিযুক্ত করছে। একটি ব্রাহ্মণবাদী সেনা বংশের শাসন, অপরটি মুসলিম শাসনকাল।
চিরকালই ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকরা সাম্প্রদায়িক খেলা খেলেছেন। তাই হিন্দু মুসলিম উভয় ঐতিহাসিকই বিপক্ষ শাসনামলকে এক্ষেত্রে দায়ী করেছেন। কিন্তু দুই পক্ষে ইতিহাস পাঠ করে বুঝতে কষ্ট হয় না প্রকৃত কাজটি ঘটেছিল সুদীর্ঘ কালব্যাপী। সেন শাসনে বৌদ্ধরা নেপালে আশ্রয় নিয়েছিল সত্য। সঙ্গে করে তাদের ধর্মীয় বইপুস্তক নিয়ে যাবারই কথা। একইভাবে মুসলিমদের আগমণের সময়ও বৌদ্ধরা আক্রমনের শিকার হয়। বখতিয়ার খিলজির নালন্দা পুড়িয়ে দেবার ঘটনা তো সকলেই জানা। শত শত বৌদ্ধ পন্ডিত সে সময় মারা পড়ে মুসলিম বাহিনীর হাতে। বৌদ্ধরা প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে নেপালে আশ্রয় নেবার ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। চর্যাপদের শ্লোকগুলোর কিছু পড়লে বুঝা যায় সেন আমলে বৌদ্ধরা তখনো তাদের সাহিত্য সাধনা বাংলাতে বসেই করছিলেন। যেমন এই শ্লোকটিতে সেন আমলের জাতপাতের উঁচু নিচু সমাজের কথাই বলছে- ‘নগর বারিহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িয়া/ ছই ছোই যাই সো বাহ্মণ নাড়িআ’ মানে নগরের বাইরে বাস করে ডোমনী আর নেড়ে বাহ্মণ তার ছঁই ছুয়ে যায়…।
চর্যাপদের পরবর্তী দুশো বছরের মধ্যে কোন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এর কারণ হিসেবেও ঐতিহাসিকদের মিশ্র মত। ঐতিহাসিকরা এই সময়কালে মুসলিমদের আগমনে বৌদ্ধদের দেশত্যাগ, অত্যাচার অরাজকতাকে দায়ী করেছেন। চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্য বা বাংলা ভাষার আদি রূপ কেমন ছিল তার সবচেয়ে প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। ঐতিহাসিকদের সাম্প্রদায়িক অবস্থানের যে কথা আগে বলেছিলাম তার একটি নিদর্শন হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চেয়ে পুরোনো হিসেবে ইউসুফ জুলেখা কাব্যকে দেখানো। কারণ ইউসুফ জুলেখা একজন মুসলমান কবির লেখা। কিন্তু এই দাবী যে সঠিক নয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনই যে চর্যাপদের পর সবচেয়ে পুরোনো আদি বাংলা রূপ তাতে এখন আর কেউ দ্বিমত নয়। ভাষাবিদরা ইউসুফ জুলেখার ভাষা রীতি পরীক্ষা করে দেখেছেন এটি বহু পরের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরিবর্তিত রূপ ছিল।
বাংলায় সুলতানী আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত ঘটেছিল কারণ বাংলার মুসলিম সুলতানদের এই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আর পৃষ্ঠপোষকতা। এই আমলে প্রচুর কাব্য কাহিনী রচিত হয় রাজদরবারের অনুকূলে। এ সময় কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম, আলাওল, কাশীরাম দাস, ভারতচন্দ্র প্রমুখ কবিদের রচনায় বাংলা ভাষা এক উচ্চ আসনে স্থান লাভ করে। সুলতানী বা মোগল আমলে দরবারী ভাষা ছিল ফারসী। এ কারণে বাংলা ভাষাতে এই সময়কালে আরবী ফারসী ভাষা অনুপ্রবেশ ঘটে। মনে রাখতে হবে সে যুগের সুলতানদের ব্যক্তিগত ভাল লাগা থেকে কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা না হওয়াতে সমস্ত দরবারী কাজ চলত বিদেশী ভাষাতেই।
উপরের এই যে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বয়ান এতে কি আলাদা করে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমানকে বাংলা ভাষার জন্য ক্রেডিট দেয়া চলে? নাকি এ এক মিলিত ঐতিহাসিক প্রচেষ্টার ফসল? বিদেশী মুসলিম শাসকরা সুলতানী আমলে বাংলা ভাষার জন্য যে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, যে কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তার মধ্যে উভয়ের কি কোন সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র আছে? তাহলে হেফাজতী ভাটুজ্জে মশাই কেন আজকে বাংলা ভাষা মুসলমানদের সৃষ্টি বলে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছেন?
ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে বাংলা ভাষাকে মৃত করতে চেয়েছিল পাকিস্তানীরা। আর এর বিরুদ্ধে যিনি প্রথম সোচ্চার হয়েছিল তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।