হয়তো "নরেন্দ্র মমোদী" এই ব্যর্থতার জন্যই জনগণের নিকট তিনি গ্রহণযোগ্য।

হয়তো  “নরেন্দ্র মমোদী” এই ব্যর্থতার জন্যই জনগণের নিকট তিনি গ্রহণযোগ্য।

“নরেন্দ্র মোদী”
লেখক : Sakib Ahmed Roni (ঢাকা, বাংলাদেশ )

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই ঘৃণিত এক রাজনৈতিক নেতার নাম। এমনকি খোদ ভারতে তাকে নিয়ে সমালোচনার অভাব নেই। তবে লোকটিকে আমি পছন্দ করি। শুধু সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে কেউ বার বার জিতে আসতে পারেনা। ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও লোকটা প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যখন ফিরে এলেন তখন অকারণে সমালোচনাকারীদের মুখ বন্ধ হওয়া উচিৎ।

মোদী বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। ছিটমহল সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান মোদীই করলেন স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর। অবশ্য এই সমস্যা সেই ১৯৪৭ থেকেই বিদ্যমান। কেউ সাহস করেনি, মোদী করলেন। এরপর তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেবার জন্য লোকসভায় বিলও পাশ করলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির অনুমোদনের অভাবে তা আটকে রয়েছে এখনও।

মোদীর বিরুদ্ধে আমরা সমালোচনা শুনেছি সেই ২০০২ সাল থেকেই। গুজরাট দাঙ্গার পর। তবুও গুজরাটে পর পর ৪ বার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। প্রতিবারই প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। খুব ভালো শাসক না হলে এবং জনগণ সত্যি সত্যি ভালো না বাসলে নির্বাচনের পর নির্বাচন দুই তৃতীয়াংশ মেজরিটি পাওয়া যায়? তারপর প্রধানমন্ত্রী হলেন। প্রথমবার পেলেন ৩৩৬ আসন। এবার ৩৫০ ছাড়িয়েছে। যদিও এবারের জয় আরো অনেক মহত্তর। মুখ্যমন্ত্রী হবার আগেও মোদী যখন বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক বা সাধারণ সম্পাদক এসব পদে ছিলেন তিনি তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। তার প্রতি কর্মীদের ভালোবাসায় ঈর্ষান্বিত হয়ে গুজরাটের বড় বড় বিজেপি নেতারা তাকে দিল্লীতে নির্বাসনেও পাঠিয়েছিল। অথচ দল যখন দুঃসময়ে তখন নির্বাসন থেকে ফিরে এসে সেই ঈর্ষান্বিত সিনিয়র নেতাদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে বিজেপিকে ৭০% আসনে জিতিয়ে ক্ষমতায় আনলেন মোদী। সময়টা ১৯৯৮। তারপর আবার নির্বাসন। আবার দিল্লীতে।

সাংগঠনিক সম্পাদক হবার আগে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মোদী আরএসএসের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮-২০ বছর বয়সে ঘর ছাড়েন। বিয়ে করেছিলেন, সংসার করলেন না। সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। হিমালয়ের পাদদেশে ও বিভিন্ন গুহায় ধ্যান করলেন কয়েক বছর। বলছি ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। স্ত্রীকে বলেছিলেন, মাফ করে দিও। আমার দ্বারা সংসারধর্ম হবেনা। এরপর কপর্দকহীন মোদী আরএসএস কর্মী হিসেবে সংগঠনের অফিস ঝাড়ু দিতেন প্রথমদিকে। চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেও নীতিতে অটল ছিলেন। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন, প্রচুর পড়ালেখা করতেন। ম্যাট্রিক দেবার পর দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোদীর পড়ালেখা এগোয় নি। গুজরাটের এক প্রবীণ অকৃতদার আরএসএস কর্মী উকিল সাহেবের অনুপ্রেরণায় মোদী আবার পড়তে শুরু করলেন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উন্মুক্ত শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে স্নাতকোত্তর করলেন মোদী ধীরে ধীরে। নিজ যোগ্যতায় আরএসএসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠলেন ৩০ বছর বয়সেই। ৩৫ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিলেন বিজেপিতে। এ ছিল তার যোগ্যতার পুরষ্কার।

মোদীর পরিবার নিয়ে দু’টো কথা বলবো। মোদীর পিতা দামোদরদাস মোদী গত হয়েছেন অনেক আগেই। তিনি চা বিক্রি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু মা হীরাবেন এখনও বেঁচে আছেন, ৯৯ বছর বয়স তার। পুত্রের বিজয়ে তিনি খুব খুশী। কিন্তু এই মহিলা এখনও গুজরাটের সেই আটপৌঢ়ে বাড়িতেই বাস করেন। খুবই সাধারণ ঘরদোর। মোদীর আরো ৪ ভাই, ১ বোন আছে। বোনটি গৃহিণী। বড় ভাই সোম মোদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। এখন পেনশনভোগী। আরেক ভাই অমরুত মোদী ছিলেন মেশিন অপারেটর, এখন অবসরপ্রাপ্ত। আরেক ভাই প্রহ্লাদ মোদী মুদি দোকানদার। সর্বশেষ ছোটভাই পংকজ মোদী তথ্য বিভাগে কর্মরত একজন কেরানী। আর মোদীর স্ত্রী যার সাথে তিনি কখনও সংসার করেন নি সেই আনন্দীবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা, পেনশনভোগী। মোদী ২০১৪ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন তার পরিবার, ঘরদোরের ছবি দেখেছিলাম। দেখে চোখ কপালে উঠার জোগার। এত সাধারণ! মোদীর ভাই, ভাতিজা, তাদের নাতিপুতিরা সমাজে কোন স্পেশাল স্ট্যাটাস পায় না। তাদের ঘর যেমন সাধারণ, পোশাক আশাক আরো মলিন। বাড়িতে বেশি অতিথি আসলে চেয়ার দেয়াই মুশকিল। দেখে বিস্মিত হলাম। আমাদের দেশে ছোটখাটো চেয়ারম্যান হলে তার পরিবারের ভাগ্য বদলে যায়। আরো মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েও পরিবারের জন্য কিছু করতে পারেন নি। হয়তো এই ব্যর্থতার জন্যই জনগণের নিকট তিনি গ্রহণযোগ্য। পরিবারতন্ত্র, নেপুটিজম, জাতিভেদ এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি জাতপাতের রাজনীতি ও গান্ধীদের বংশবাদী রাজনীতির বুকে পেরেক ঠুকেছেন। গান্ধীরা ভারতের অলিখিত রাজ পরিবার নয়, এটা প্রতিষ্ঠিত করাই মোদীর বৃহত্তম অর্জন।

মোদীকে নিয়ে মুগ্ধতার শেষ নেই। যারা মোদীর সম্পর্কে জেনেছে তারা লোকটাকে সম্মান না করে থাকতে পারবে না। ঘৃণা, সমালোচনা যারা করে এরা মোদীর ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানেনা। পুরো ব্যাপারটাই হুজুগে। মোদী গতবার জিতেছিলেন ৩৩৬ আসনে, তখন বিরোধীরা আলাদা আলাদা ছিলেন। এবার অনেক বিরোধীদল একজোট হয়ে লড়েছে। উত্তরপ্রদেশ থেকেই বিজেপি ২০১৪ সালে ৮০ টির মধ্যে ৭৩ টি সিট জিতেছিল। সেখানে এবার বিজেপির বিরুদ্ধে প্রায় সর্বদলীয় জোট হয়েছিল। অবশ্য সব দল সমর্থন দিয়েও উত্তরপ্রদেশের আমেথি আসন থেকে রাহুল গান্ধীকে জেতাতে পারে নি। এছাড়া সম্প্রতি বেশ কয়েকটা রাজ্যে বিজেপি একটু খারাপ ফল করলো। রাহুল গান্ধী ভেবেছিল যে সব তার নিজের সাফল্য। আসলে ওসব আসনে দীর্ঘদিন ধরে বিজেপি ক্ষমতায় থাকায় এন্টি-ইনকামবেন্সি ছিল। আর জনগণের ক্ষোভ যা ছিল স্থানীয় নেতাদের প্রতি, মোদীর প্রতি নয়। তাই দেখা গেল ওসব রাজ্যের প্রায় ৯৫% আসনই মোদী জিতে গেছে। তাছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানায় বিজেপি আগেরবারের মত জোট করে লড়তে পারেনি। তবুও আগের বারের চেয়ে প্রায় ৬-৭% ভোট বেশি পেয়েছে বিজেপি। আসনও বেড়েছে। এসব মোদীর ক্যারিশমা আর সুশাসনের জন্যই হয়েছে। অন্যায্য সমালোচনা লোকে পছন্দ করেনা তার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গের রেজাল্ট। বামপন্থীরা ফিরেছে শূণ্য হাতে। ওদের শাস্তি দিয়েছে জনগণ। সত্যি বলতে কি সকলেরই ন্যায্য সম্মান, শ্রদ্ধা পাওয়ার অধিকার আছে। আপনি তাকে বঞ্চিত করলে তিনি আরো সম্মানিত হবেন অন্যদিক থেকে, আপনিই অসম্মানিত হবেন। কথাটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয় অংশের জনগণের উদ্দেশ্যেই বললাম।