এক বাঙালি ‘পরী’র হাতেই! ‘ফ্যাশনে’র মাছ!………………………….।।।

fish-main

‘জলপরী’ মাছ! (ইনসেটে) স্বাগতা ঘোষ।


মাছও হয়ে গেল জলপরী! এক বাঙালি ‘পরী’র হাতেই!

‘ফ্যাশনে’র মাছ! ‘প্যাশনে’রও! মাছও যে ‘ফ্যাশনদুরস্ত’ হতে পারে, হয়ে
উঠতে পারে ‘স্বাস্থ্য-সচেতন জলপরী’, তা প্রমাণ করে দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন
এক বাঙালি কন্যা। স্বাগতা ঘোষ। বর্ধমানের মেয়ে। বসবাসে বেঙ্গালুরুর।

দেখিয়ে দিলেন, ঠা ঠা রোদ্দুরের হাত  থেকে চামড়া বাঁচাতে আমরা যে ভাবে
চলি, মাছও ঠিক সেই ভাবেই ব্যবহার করে- ‘সানস্ক্রিন ক্রিম’। অতিবেগুনি রশ্মি
বা আলট্রা-ভায়োলেট রে’র ঝাপটা থেকে বাঁচতে। আর মাছও সেই সানস্ক্রিন
ক্রিমটা ব্যবহার করে গরম কালেই।

আমরা যেমন সবাই কেতাদুরস্ত হই না, সব মাছও তেমন নিজেকে বাঁচাতে
সানস্ক্রিন ক্রিম বানিয়ে নিতে জানে না। কোনও একটি মাছের বিশেষ একটি
প্রজাতিই শুধু নিজেদের বাঁচানোর জন্য সানস্ক্রিন ক্রিম বানাতে পারে। সেই
বিশেষ প্রজাতির মাছের নাম- ‘ওয়ালায়ি’। উত্তর আমেরিকার এক ধরনের ‘স্পোর্ট
ফিশ’। যার বৈজ্ঞানিক নাম- ‘স্যান্ডার ভিট্রিয়াস’। আবার
ঢাকুরিয়া-গোলপার্ক-বালিগঞ্জের ফ্যাশনের সঙ্গে যেমন
শ্যামবাজার-হাতিবাগান-শোভাবাজারের ফ্যাশন মেলে না, তেমনই সব জায়গার ওয়ালায়ি
মাছের গায়েই নীল রঙের সানস্ক্রিন ক্রিম দেখা যায় না। একমাত্র উত্তর মেরুর
কাছে কানাডার হ্রদগুলির জলেই সানস্ক্রিন ক্রিম মেখে নিয়ে ওয়ালায়ি মাছেদের
ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। গরমটা একটু জমিয়ে পড়লে। আবার যখন শীতটা জমিয়ে
পড়ে কানাডার ওই সব এলাকায়, তখন কী আশ্চর্য জানেন, ওয়ালায়ি মাছের গায়ের ওই
সানস্ক্রিন ক্রিমের রং আর অতটা গাঢ় থাকে না। আপনাআপনিই অনেকটা ফিকে হয়ে
যায়। যখন যেমন দরকার। কিন্তু এটা তো হল কানাডার ওয়ালায়ি মাছেদের ‘ফ্যাশন’।
তারা নীল হয়ে উঠতে ভালবাসে! অথচ সেই উত্তর আমেরিকারই দক্ষিণ দিকে বা দক্ষিণ
কানাডায় গেলে দেখা যায়, সেই নীল রঙের ‘ফ্যাশন’-এর প্রতি কোনও ‘প্যাশন’ই
নেই ওয়ালায়িদের। সেখানে তারা কাঁচা সোনারঙা ওয়ালি। আর সেটাই তাদের আদত রং।
তাদের নীল রঙের ‘ফ্যাশন’টা শুধুই দেখা যায় উত্তর মেরুর কাছাকাছি কানাডার
নদী বা হ্রদের জলে!


কেউ ‘জলপরী’ হয়, কেউ হয় না! অথচ দু’টিই ওয়ালায়ি।

সেই ‘ফ্যাশন’ ওয়ালায়ি!

সেই ‘ফ্যাশন’ ওয়ালায়ি!

কানাডার ওয়ালায়িদের নীল রঙের প্রতি ‘প্যাশন’টা প্রথম নজরে পড়েছিল এক
সাহেবের। বিশিষ্ট বায়োলজিস্ট, ওয়াশিংটন কাউন্টির উইস্‌কনসিন
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েন স্ক্যাফারই প্রথম দেখেছিলেন, নিজেদের নীল রঙে
সাজিয়ে তোলার একটা প্রাকৃতিক ‘প্যাশন’ রয়েছে কানাডার ওয়ালায়িদের, রয়েছে
নিজেদের নীলবর্ণ করে তোলার স্বাভাবিক, সহজাত ক্ষমতা।

বাঙালি কন্যা স্বাগতার কেরামতি কোনখানে জানেন?

কানাডায় গা পোড়ানো গরমে ওয়ালায়িদের ‘প্যাশনে’র রং কেন নীল, তার কারণ
খুঁজে বের করেছেন এই বাঙালি কন্যা। বিশ্বে এই প্রথম। গর্বের কথা নয় কি!
স্বাগতাদের অনুমান, হয়তো ওই নীলই দূষণ-যন্ত্রণার যাবতীয় ‘নীল’ (বিষাক্ত
আলট্রা-ভায়োলেট রে)-এর ঝাপটা থেকে বাঁচিয়ে রাখছে ওয়ালায়িদের। স্বাগতাদের
চোখে এও ধরা পড়েছে, ওই ওয়ালায়িদের নীল শুধুই নীল নয়, ওই নীলই উগরে দেয়
হাল্কা লাল আলোর বিকিরণ। রঙে রঙে ভরে যায় ‘জলপরী’ ওয়ালায়িদের জীবন, যৌবন!


এনসিবিএসের ল্যাবরেটরিতে স্বাগতা ঘোষ। বেঙ্গালুরুতে।

‘ব্লু প্রোটিন উইথ রেড ফ্লুরোসেন্স’ শিরোনামে স্বাগতা (মূল গবেষক বা
‘লিড অথর’) সহ আট গবেষকের ওই গবেষণাপত্রটি এই অক্টোবরেই ছাপা হয়েছে
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞান-জার্নাল ‘পিএনএএস’-এ। আর তা বেরনোর পরেই
আলোড়ন শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে।


আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘পিএনএএস’-এ স্বাগতার (লিড অথর) গবেষণাপত্র

কেন?

আসলে স্বাগতারা আবারও দেখিয়ে দিতে পেরেছেন, প্রকৃতির ‘রুদ্র রোষ’-এর
(দূষণ বা অতিবেগুনি ও মহাজাগতিক রশ্মির ঝাপটা) হাত থেকে প্রাণকে (উদ্ভিদ ও
প্রাণী) বাঁচাতে প্রকৃতিই তাদের হাতে তুলে দেয় ‘অস্ত্র’! অসুরবিনাশী হওয়ার
জন্য যেমন দশভূজার হাতে দশ দিক থেকে এসে পড়তে থাকে অস্ত্র, যেন তেমনই!

দু’বছর আগেকার গবেষণাপত্রে বায়োলজিস্ট স্ক্যাফার দেখিয়েছিলেন, একটু একটু
করে গরম পড়লে, সূর্যের তাপটা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকলে, সানস্ক্রিন
ক্রিমের মতো এক ধরনের ‘ব্লু পিগমেন্ট’ বা নীল রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নেয়
কানাডার ওয়ালায়িরা। যত গরম বাড়ে, যত বাড়ে রোদের তাত, ততই নীল রঙের
‘ফ্যাশন’ বাড়ে ওয়ালায়িদের। শীত পড়লে আর তা বাড়তে থাকলেই সেই রং ফিকে
থেকে আরও ফিকে হয়ে যায়। স্ক্যাফারের মনে হয়েছিল, সূর্যের আলো থেকে যে
আলট্রা-ভায়োলেট রে বেরিয়ে আসে, হয়তো তারই সঙ্গে কোথাও না কোথাও জড়িয়ে
রয়েছে ওয়ালায়িদের নীল রঙের প্রতি ‘প্যাশন’-এর কারণ।


‘জলপরী’ মাছের গায়ের মিউকাসের সেই ব্লু পিগমেন্ট, মেমব্রেনের দেওয়ালে বন্দি

‘জলপরী’ মাছের গায়ের মিউকাসের সেই ব্লু পিগমেন্ট, অণুবীক্ষণের নীচে

‘জলপরী’ মাছের গায়ের মিউকাস, হিস্টোলজিক্যাল ক্রস সেকশনের পর

তা হলে কি আলট্রা-ভায়োলেট রে’র বেগুনি বা নীল রং ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েই ‘বিষে-বিষে নীলকণ্ঠ’ হয়ে ওঠে ওয়ালায়িরা?

না, একেবারেই না। সূর্যের আলো থেকে গরল (আলট্রা-ভায়োলেট রে) শুষে নিলেও
সেই গরল বা বিষ দিয়েই নিজেদের বাঁচানো বা সাজানোর জন্য ওই সানস্ক্রিন ক্রিম
বানিয়ে ফেলে ওয়ালায়িরা। গরমে চামড়া বাঁচাতে আমরা যেমন মাখি সানস্ক্রিন
ক্রিম, ঠিক তেমনই। সেটাই ওয়ালায়িদের ‘ব্লু পিগমেন্ট’ বা নীল রঙের ‘ফ্যাশন’।
যখন ওয়ালায়িরা হয়ে ওঠে ‘জলপরী’!

কিন্তু ওয়ালায়িদের ওই সানস্ক্রিন ক্রিম বা পিগমেন্টের রংটা নীল হয় কেন?


‘জলপরী’ মাছের ডরসাল ফিন

স্বাগতা বলছেন, ‘‘কানাডার ওয়ালায়িদের গায়ের মিউকাসে তৈরি হওয়া
পিগমেন্টের রং কেন নীল হয়, তা আমরাই প্রথম দেখাতে পেরেছি। আমরা জানি,
দূষণের জন্য বায়ুমণ্ডলের ওজোনের স্তর ক্রমশই পাতলা হয়ে

যাচ্ছে, ওজোনের ‘চাদর’ ফুটো হচ্ছে। আলট্রা-ভায়োলেট বা মহাজাগতিক রশ্মির
ঝাপটা থেকে আমাদের বাঁচায় ওই ওজোনের ‘চাদর’ই। সেই ‘চাদর’ যত ফুটো হয়, ততই
হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আলট্রা-ভায়োলেট বা মহাজাগতিক রশ্মি। যা শুধুই
বিষাক্ত নয়, প্রাণঘাতীও বটে।’’

কিন্তু ‘রাখে হরি তো মারে কে?’ দূষণের মাত্রা বেশি বলে কানাডার
ওয়ালায়িদের আলট্রা-ভায়োলেট রে’র ঝাপটা সইতে হয় বেশি। তাই ‘হরি’ প্রকৃতিই
তাদের হাতে তুলে দিয়েছে ‘বাঁচার হাতিয়ার’।


অতিবেগুনির নীল শুষে লাল ফ্লুরোসেন্ট আলো বিকিরণ ‘জলপরী’দের প্রোটিনের 

স্বাগতার কথায়, ‘‘বিষাক্ত আলট্রা-ভায়োলেট রে শুষে নিয়েই ওয়ালায়িরা
বানিয়ে ফেলছে নীল রঙের পিগমেন্ট। বিষ নামানোর ওষুধ। যাতে আলট্রা-ভায়োলেট
রে’র ভয়ঙ্কর ঝাপটা আর তাদের কোনও ক্ষতি করতে না পারে। মারে কে ওয়ালায়িদের?
তুলনায় উত্তর আমেরিকায় দূষণের মাত্রা কম বলে আলট্রা-ভায়োলেট রে’র ঝাপটা কম
সইতে হয় সেখানকার ওয়ালায়িদের। তাই তাদের গরম কালে নীল রঙা পিগমেন্ট বা
সানস্ক্রিন ক্রিম গায়ে মাখতে হয় না। আদতে যেমন হয়, সেখানকার ওয়ালায়িরা ঠিক
তেমনই, কাঁচা সোনা রঙের। আলাদা ‘ফ্যাশনে’র প্রতি তাদের কোনও ‘প্যাশন’ থাকে
না। আমাদের অনুমান, বড় মাছ বা অন্যান্য জলজ জীবকে ধোঁকা দিতেও হয়তো
কানাডার ওয়ালায়িরা ব্যবহার করে থাকে তাদের এই ব্লু পিগমেন্ট। যা আমরাই
প্রথম দেখিয়েছি, আদতে প্রোটিন আর বিলিভার্ডিনের একটি জটিল জৈব যৌগ। যার
নাম- ‘স্যান্ডার সায়ানিন’। শুধু তাই নয়। আমরা ওই প্রোটিন অণুর চেহারা বা
‘স্ট্রাকচার’টাও দেখাতে পেরেছি, এই প্রথম। আমরা এও দেখেছি, আলট্রা-ভায়োলেট
রে ওয়ালায়িদের গায়ের মিউকাসে থাকা সেই অণুগুলিকেও ভেঙেচুরে দিয়ে
‘ফ্রি-র‌্যাডিক্যাল’ বানায়, যে-অণুগুলি তার জীবনধারণের বিক্রিয়াগুলির মূল
চালিকা-শক্তি। ফলে ওই অণুগুলি আলট্রা-ভায়োলেট রে’র ছোবলে ভেঙে টুকরো টুকরো
হয়ে গেলে আরও বিপন্ন হয়ে পড়ে ওয়ালায়িদের জীবন। কানাডার ওয়ালায়িদের গায়ের
ব্লু পিগমেন্ট আলট্রা-ভায়োলেট রে’র সেই কু-মতলবেই বাগড়া দেয়। অণুগুলিকে
‘ফ্রি-র‌্যাডিক্যাল’-এ ভাঙতে দেয় না।’’


‘জলপরী’দের প্রোটিন অণুর চেহারা

বর্ধমানের মেয়ে স্বাগতার স্কুল স্তরের পড়াশোনার আগাগোড়াটাই বাবার
বদলির চাকরির সূত্রে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে।
তীক্ষ্ণ মেধার স্বাগতা বিশাখাপত্তনমে টুয়েলভ স্ট্যান্ডার্ডের পরীক্ষার
ফলাফলে ছিলেন সবকটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের মধ্যে ‘টপার’। গ্র্যাজুয়েশন
অন্ধ্রের সেন্ট জোসেফ্‌স কলেজ থেকে। তার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এখন বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর
বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এ (এনসিবিএস) সিনিয়র রিসার্চ স্কলার।

এই গবেষণার অভিনবত্ব এটাই, প্রাকৃতিক ‘রোষে’র হাত থেকে আমাদের এই
বাসযোগ্য গ্রহের ‘প্রাণ’-এর হাতে প্রকৃতি যে নিজেই তুলে দেয় ‘অস্ত্র’, তার
একটি সাম্প্রতিক হাতেগরম প্রমাণ দাখিল করতে পেরেছেন স্বাগতা।

‘পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। পারলে, বাঁচবে। না পারলে, মরবে। ধীরে
ধীরে হারিয়ে যাবে।’ এটাই জীবন প্রবাহের মূল মন্ত্র। বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল
সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক, গবেষক দলের অন্যতম সদস্য
সুব্রহ্মণ্যম রামস্বামীর কথায়, ‘‘অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন) আর বিবর্তন
(এভোলিউশন)- এই দু’টি উপায়েই পরিবেশের পরিবর্তনগুলির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়
প্রাণকে। বিবর্তনটা হতে সময় লাগে। অনেক অনেক বছর। যে ভাবে শিম্পাঞ্জি থেকে
আদি মানুষের জন্ম হয়, সেখান থেকে হয় হোমো সেপিয়েন্স। অন্য দিকে, অভিযোজনটা
হয় অনেকটাই তাড়াতাড়ি। তবে সেটা নানা ভাবে হয়। যে ভাবে কাঁচা সোনা রঙা
ওয়ালাইয়িরা কানাডা বা উত্তর আমেরিকার নদী, হ্রদের জলে হয়ে ওঠে নীল রঙের
‘ফ্যাশনদুরস্ত’ ওয়ালাইয়ি। ওই মাছেদের গায়ের নীল রঙা পিগমেন্ট ‘স্যান্ডার
সায়ানিন’-এর আরও একটি বিশেষ গুণ আমাদের নজরে পড়েছে। সেটা কী? ‘স্যান্ডার
সায়ানিন’-এর ওপর আলট্রা-ভায়োলেট রে (অতিবেগুনি রশ্মি) পড়লে তার একটা বড়
অংশ ‘স্যান্ডার সায়ানিন’ শুধুই শুষে নেয় না, তার একটা অংশ বর্ণালীর একেবারে
অন্য প্রান্তে থাকা উজ্জ্বল লাল ফ্লুরোসেন্ট আলো বিকিরণ (এমিশন) করে।’’


এনসিবিএসের অধ্যাপক সুব্রহ্মণ্যম রামস্বামী

এখানেও একটা অদ্ভুত ‘রহস্য’ রয়েছে ‘ফ্যাশন’ ওয়ালাইয়িদের। তারা
আলট্রা-ভায়োলেট রে থেকে শুষে নিচ্ছে বেগুনি বা নীল রং আর উগরে দিচ্ছে
বর্ণালীর একেবারে অন্য প্রান্তে থাকা লাল রং!

হচ্ছেটা কী? কেন হচ্ছে?

স্বাগতার ব্যাখ্যায়, ‘‘আলোর বর্ণালীতে যে রঙের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য সবচেয়ে
বেশি (লাল), তার কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম। শক্তিতেও সে সবচেয়ে বেশি ‘হীনবল’।
ওয়ালাইয়িদের গায়ের মিউকাসের ব্লু পিগমেন্ট ‘স্যান্ডার সায়ানিন’ নীল বা
বেগুনি রং শুষে নিচ্ছে আলট্রা-ভায়োলেট রে থেকে। মানে, বর্ণালীর যে রঙের
কম্পাঙ্ক বা শক্তি সবচেয়ে বেশি। আর বিকিরণের মাধ্যমে উগরে দিচ্ছে উজ্জ্বল
লাল আলো। যার শক্তি সবচেয়ে কম। এর অর্থ, শুষে নেওয়া আলট্রা-ভায়োলেট রে থেকে
ওয়ালাইয়িদের গায়ের ব্লু পিগমেন্ট একটা বড় অংশের শক্তি ‘গিলে নিচ্ছে’। আর
যে বাড়তি শক্তিটুকু তার দরকার নেই, সেই শক্তিটাকেই আমাদের পেট পুরে খাওয়ার
পর তৃপ্তির ঢেকুর তোলার মতো লাল আলো বিকিরণের মাধ্যমে উগরে দিচ্ছে।’’

আলট্রা-ভায়োলেট রে থেকে একটা বড় অংশের শক্তি শুষে নিয়ে কোন কাজে লাগাচ্ছে স্বাগতাদের খুঁজে বের করা ‘স্যান্ডার সায়ানিন’?

বিশিষ্ট অধ্যাপক সুব্রহ্মণ্যম রামস্বামী জানাচ্ছেন, গবেষকদের ধারণা, ঠিক
যে ভাবে টিকা নিয়ে আমরা নানা রোগের প্রতিরোধী ব্যবস্থা শরীরেই তৈরি করে
রাখি, নীল রঙা ওয়ালাইয়িরাও ঠিক তেমন ভাবেই হয়তো শুষে নেওয়া শক্তি দিয়ে আরও
আলট্রা-ভায়োলেট রে’র ঝাপটা সইবার ধকল (পড়ুন, ক্ষয়ক্ষতি) সামলাচ্ছে।’’

এর মানে, ‘জলপরী’ ওয়ালাইয়িরা তাদের গায়ের নীল আর লালের রঙ-বেরঙের খেলা
দিয়েই আলট্রা-ভায়োলেট রে’র ‘রাবণ’কে বধ করে যাচ্ছে! প্রাণে বাঁচতে।

এই ‘জলপরী’দের গায়ের মিউকাসে যে প্রোটিনের হদিশ পেয়েছেন
স্বাগতারা, তা কি নিছকই একটি আবিষ্কারের গণ্ডীতেই আটকে থাকবে? নাকি ওই সদ্য
আবিষ্কৃত প্রোটিন ‘স্যান্ডার সায়ানিন’কে কাজে লাগানো যেতে পারে ব্যবহারিক
ভাবেও?


বায়োলজিস্ট ওয়েন স্ক্যাফার। ওয়াশিংটন কাউন্টিতে

বিশিষ্ট বায়োলজিস্ট, উইস্‌কনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েন স্ক্যাফার
আমেরিকার ওয়াশিংটন কাউন্টি থেকে ই মেলে লিখেছেন, ‘‘অমিত সম্ভাবনার দরজাটা
হাট করে খুলে দিয়েছে কানাডার ওয়ালায়িদের গায়ের মিউকাসের এই প্রোটিন
‘স্যান্ডার সায়ানিন’। বায়োটেকনোলজি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির গবেষণায়
এই প্রোটিন একটি উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।’’

আর সেটা কেন ও কী ভাবে হতে পারে, তার ব্যাখ্যা শুনে নেওয়া যাক স্বাগতার
মুখ থেকেই। মূল গবেষক জানাচ্ছেন, এই প্রোটিন ‘স্যান্ডার সায়ানিনে’র কয়েকটি
অভিনব ধর্ম রয়েছে। এক, এত ছোট আকারের লাল রঙের ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিনের হদিশ
এর আগে পাওয়া যায়নি। দুই, ওই প্রোটিনের উজ্জ্বল লাল ফ্লুরোসেন্ট আলো
বিকিরণের ক্ষমতা। তিন, সূর্যের আলো থেকে বর্ণালীর এক প্রান্তের রং শুষে
নিয়ে অন্য প্রান্তের রং বিকিরণের ক্ষমতা (‘লার্জ অপটিক্যাল শিফ্‌ট’)। চার,
আলো পড়লেই যার ‘চরিত্র’ চট করে বদলে যায় না ‘বহুরূপী’দের মতো
(‘হাই-ফোটোস্টেবিলিটি’)। পাঁচ, এই প্রোটিনের অণুগুলির আলোর নানা রং নিয়ে
খেলার সহজাত ক্ষমতা (‘ইনট্রিনসিক সেলুলার-ক্রোমোফোর’)। এই ধর্ম বা গুণগুলির
জন্য ‘স্যান্ডার সায়ানিন’কে ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন মার্কার হিসেবে ব্যবহার
করা যেতে পারে। কাজে লাগানো যেতে পারে ‘ডিপ-টিস্যু ইমেজিং’-এ। অ্যালকোহলে
আসক্তদের যে ‘গ্রিন জন্ডিস’ হয়, সেই রোগ নির্ধারণেও কাজে লাগানো যেতে পারে
এই প্রোটিনকে।’’

অতিবেগুনি রশ্মির ‘নীল বিষ’ই জন্ম দিয়েছে কানাডার ‘জলপরী’ মাছেদের গায়ের
প্রোটিনের। আর সেই বিষ থেকে জন্মানো প্রোটিন দিয়েই হয়তো-বা আগামী দিনে
আমাদের শরীরের অনেক বিষ ঝাড়ানোর ‘মন্ত্র’ দিতে পারবেন স্বাগতারা!

স্বাগত স্বাগতা!