অরবিন্দ দত্ত: এক রাষ্ট্রবাদের চিন্তাধারা নিয়ে যখনই এই পুণ্যভূমি ভারতের কল্পনা করি তখনই এই সংস্কৃতের অনাদি কালের শ্লোকটির কথা মনে পরে যায়। যার অর্থ উত্তরের উপরিভাগ থেকে দক্ষিণের সমুদ্রের শেষ সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত যেই ভূখণ্ড আছে তাহার নাম ভারত এবং এই ভূমিতে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকের ভারতীয়। এই পুণ্যভূমিতে যুগে যুগে বিভিন্ন ক্রান্তিকারী, সাধক মহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁহাদের মধ্যেই একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সংগ্রামী নেতা এবং বিশিষ্ট তাত্ত্বিক অরবিন্দ ঘোষ। যিনি সকলের কাছে ঋষি অরবিন্দ ঘোষ নামে খ্যাত।
আজ থেকে ঠিক সত্তর (৭০) বছর আগে ভারতবর্ষে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। শত শত বর্ষের সংঘর্ষ তথা লাখো রাষ্ট্র ভক্তের বলিদানের পরে ১৪-১৫ আগস্টের অর্ধরাত্রিতে আমাদের দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। ১৫ আগস্টের ভোর ছিল একক ভাবে দেশকে গড়ার স্বপ্ন। একক ভাবে চলার আনন্দ।আর তখন থেকে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছি আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার সাথে বিভাজনের বিষাদ নিয়ে চলতে হয়েছে। লক্ষ লক্ষ নির্দোষ দেশবাসীর জন্য এই স্বাধীনতা অভিশাপ হিসাবে আশে। যেখানে পাঞ্জাব এবং বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে পাকিস্তান পেলো পূর্ব বঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুস্থানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিভাজন লক্ষ লক্ষ নির্দোষ নর-নারী প্রাণ কেরে নেয়। যাকে বাংলার বুকে গ্রেটার “ক্যালকাটা কিলিং” বলেও জানা যায়।
যুগনায়ক ঋষি অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট মাতা স্বর্ণলতা দেবীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ পেশায় ছিলেন বিলেত ফেরত ডাক্তার। অরবিন্দ ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং জাতীয়তাবাদী নেতা রাজনারায়ণের দৌহিত্র। বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন অরবিন্দ। পাশ্চাত্য ভাবধারায় গড়ে তুলার লক্ষ্যে পিতার একান্ত ইচ্ছায় অরবিন্দ উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত চলে যান। কিন্তু আই সি এস পরীক্ষাতে ভালো ফল করার পরেও সুযোগ না পাওয়ায় মন খারাপ হয়ে যায় এবং ভারতে ফিরে এসে তিনি বরোদা কলেজে সহকারী অধ্যক্ষের পদে চাকরি গ্রহণ করেন। এই কলেজে চাকরি করার সময়েই তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং চিন্তা এবং চেতনায় তিনি চরমপন্থী মতবাদের দিকে ঝুঁকে পরেন। সেই সময় দুই সেরা বাঙ্গালী মনীষী তাঁহাকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁরা হলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ।
স্বামীজির বাঙলা ঐতিহ্য এবং আত্মনির্ভরশীলতার আদর্শ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠের’ আদর্শ এবং উপন্যাস বর্ণিত সন্ন্যাসীদের আত্মত্যাগের আদর্শ ও তাদের সংগ্রামের নিষ্ঠা ও সততা তাঁকে প্রবল ভাবে মুগ্ধ করেছিল। তিনি নিজেকে দেশসেবক সন্তান আনন্দমঠের সন্ন্যাসীদের একজন ভাবতে শুরু করেছিলেন।
তিনি আপোষের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তাই তিনি কংগ্রেসের কার্যক্রমকে নিন্দা করে বলতেন কংগ্রেস ইংরাজদের সাথে আপোষের হাত মিলিয়েছে। আপোষ করে দেশমাতার মুক্তি আসবে না। এই স্বাধীনতার জন্য চাই শক্ত হাতে রক্ত ছিটিয়ে। তিনি বলতেন বিদেশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদেশেকে বিজাতীয় সংস্কৃতি মুক্ত করতে হবে। তারপর তিলকের আদর্শ ভিত্তিক দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে দেশ গড়তে হবে। যেখানে হবে প্রাচীন ঋষিদের সত্য আদর্শ মত। তিনি বলতেন স্বার্থপরতা, ভীরুতা, পরনির্ভরশীলতা ও ভাবাবেগ ত্যাগ করতে হবে। তবেই জাতির উন্নতি হবে এবং তিনি তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্যে তীব্র গতিতে কাজ করে চলছিলেন। তিনি দিনের বেলা কলেজ অধ্যাপক এবং রাত্রিবেলা স্বদেশী আন্দোলনের পরিকল্পনা এবং ট্রেনিং দিয়ে চলছিলেন , সঙ্গে নিয়মিত ‘ইন্দু’ পত্রিকা ( ১৮৯৩-৯৪), যুগান্তর, বন্দেমাতরম, কর্মযোগ, লিখে চলেছিলেন।