অনন্ত শান্তি-সমাধির বুকের ওপরেই এমন সৃষ্টি চাঞ্চল্য,

কালী কালো। কালীর বর্ণ কেন কালো, তা’ শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তিতেই স্পষ্ট। ‘সে দূর বলে। কাছে গেলে কোনও রংই নাই’। কালো বর্ণ দুরধিগম্যতার প্রতীক। কালীর বাইরের বর্ণ কালো, – কিন্তু নিকট-দৃষ্টিতে, – ভক্তের অন্তরে তিনিই চিৎ-প্রভাময়ী – জ্ঞান-ভাস্বরতায় উজ্জ্বলা। আবার তাঁর কালো রঙের আরও একটি রুপক ব্যাখ্যা আছে। অসুরদের প্রতি ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডল মসীবর্ণ, অর্থাৎ কালো হয়ে আছে। “কোপেন চাসা বদনং মসীবর্ণং অভূৎ তদা” – (শ্রীশ্রীচণ্ডী)। কিন্তু এই ‘কোপ’-ও সাধারণ কোপ নিশ্চয়ই নয়। মায়ের কোপ বা ক্রোধও সন্তানের মঙ্গলহেতু। কালী জ্ঞানখড়গ দিয়ে অসুরদের মুণ্ড ছেদন ক’রে, – অর্থাৎ, তাদের অসুরত্ব নাশ ক’রে, তাদের কল্যাণ-গতি প্রদান করে থাকেন। বাইরে তাঁর ক্রোধ-দৃপ্ত ভয়ঙ্করী রুপ – সমর-নিষ্ঠুরতা, কিন্তু অন্যদিকে বর-অভয়-করুণা। দুই হাতে তাই খড়গ ও নরমুণ্ড, – কিন্তু অপর দুই হাতে সন্তানের প্রতি বরাভয়। তাঁর গলায় মুণ্ডমালা, – অসুর-সন্তানদের মুণ্ডগুলো নিজেই কেটেছেন, অথচ নিজের কণ্ঠেই আবার ধারণ করে রয়েছেন। সন্তানকে শাসন করেন, কিন্তু বর্জন করেন না; – শাস্তি দিয়েও কণ্ঠলগ্ন করে রেখেছেন, – নিজের বুকের শোভা ক’রে, সঙ্গে নিয়ে ফেরেন! মুণ্ডমালিনী তাই দয়াময়ীও বটে, – ভীষণা হয়েও স্নেহ-পাগলিনী! কালী জগৎ-জননী, – বিশ্ব-প্রসবিনী। তাই তো তিনি উলঙ্গিনী। প্রতি ক্ষণে যিনি অসংখ্য অসংখ্য সৃষ্টি করে চলেছেন, – পলে পলে যিনি প্রসব করেই চলেছেন, – অবিরাম জনন-নিরতা যে জননী, তাঁর আর বসন পরার অবসর কোথায়? তাই কালী উলঙ্গা – বিবসনা। মাত্র ত্রিগুণই যাঁর উপাধি, – অন্য উপাধি বা বসন-ভূষণের, অথবা অধিকন্তু আবরণের, লেশও যাঁতে নেই, তিনি তো দিগ্‌বসনাই হবেন। – যিনি বিশ্বোদরা অনাবৃতা, তাঁর আবার বস্ত্র পরিধান কী হবে? “বিশ্বোদরস্য বস্ত্রং কুতঃ! … রম্যস্য আভরণং কুতঃ!!” পরাপূজা স্তোত্রে আচার্য শঙ্কর ঠিকই বলেছেন – ব্রহ্মাণ্ডই যাঁর উদরে, তাঁর বসন পরা কেমন করে হবে! যিনি স্বয়ংই সৌন্দর্যস্বরুপ, তাঁর আবার কোন্‌ আভরণের প্রয়োজন!!

অনন্ত শান্তি-সমাধির বুকের ওপরেই এমন সৃষ্টি চাঞ্চল্য, – অগুণ-অক্রিয় প্রশান্তির বক্ষেই এমন ত্রিগুণ-নর্তন, তাতেই যেন মা কিঞ্চিৎ লজ্জমানা। কালী তাই বুঝি দাঁতে জিভ্‌ কেটে, একটু ব্রীড়াময়ী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিস্তরঙ্গ-নির্বিশেষ সমুদ্রে, সৃষ্টির তরঙ্গ ও ক্ষোভ সঞ্চারের জন্যেই কি এ লজ্জা? হয়তো বা তাই! অথবা, ঐ লোহিত লোল রসনা বুঝি রজোগুণের প্রতীক, – শুভ্র