এক বছরে ১২ মাস ৬৪ জেলায় যদি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তাহলে লেখকের জন্য কঠিন হয়ে যায় লেখা। সংখ্যালঘু নির্যাতন: সমগ্র বাংলাদেশ-এ এক লাইন লিখে দিলেই চলে। ভূমি সংক্রান্ত ঘটনা, চাঁদা দাবি, খুন, ধরে কোপানো, গণহামলা কি নেই রে বাবা! তাও করছে বেশিরভাগ সরকারদলীয় লোকেরা। ভালোই তো, ভোটও দিতে হবে আবার ডানা কেটেছেঁটেও দেবে।
যেমন দেখা যাক কয়েকটা নমুনা: শেরপুর জেলায় ১৪ সেপ্টেম্বর ঝিনাইগাতী উপজেলার গীতা রাণী বর্মন নামের পনের বছরের কিশোরীকে সদর থানার হামিদুল ওরফে আকাশ অপহরণ করে। অপহরণের ৪৬ দিন পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঝিনাইগাতি থানা পুলিশ নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার সহযোগিতায় রূপগঞ্জ থেকে কৌশলে গীতা রাণী বর্মনকে উদ্ধার করে। এরপরের খবর কিন্তু আমরা পাই না, ৪৬ দিন অপহরণকারীর ডান হাতের অধিকারে থেকে সে কি অক্ষত ছিল?
গত বছর প্রতিমা ভাঙার মহাউৎসব গেছে। প্রতিমা ভাঙতে ভাঙতে মোমিনরা ক্লান্ত হয়ে গেছে। শালার এত প্রতিমা কেউ তৈরি করে? মূর্তি ভাঙার বছর শুরু হয় (জানুয়ারিতে) ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার ভাজনডাংগা পালবাড়িতে গভীর রাতে প্রায় শতাধিক স্বরস্বতী প্রতিমা ভাংচুর করে। সুকুমার পাল জানান আসন্ন স্বরস্বতী পুজা উপলক্ষে তারা মূর্তিগুলো বানিয়েছিলেন বিক্রির জন্য। ভেঙে ফেলায় তার প্রায় এক লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছিল। বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলায় মালিপাড়া দুর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর করা হয়, রাতের অন্ধকারে মন্দির থেকে লক্ষ্মী প্রতিমা তুলে নিয়ে ভাংচুর করে নিকটস্থ পুকুর পাড়ে ফেলে রাখে অবশিষ্টাংশ। প্রমথ ঢালী জানান এ ঘটনা ঘটে লক্ষ্মীপুজার পরে। মানিকগঞ্জ জেলায় নভেম্বর মাসে ঘিওর উপজেলায় সিংজুরি গ্রামে মন্দির ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল, জড়িতে সন্দেহে স্থানীয় ইউপি সদস্য আক্কাস আলী ও তার ছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কালিবাড়ি মন্দির কমিটির সভাপতি গৌড় চন্দ্র দত্ত বলেন ঐ জমির মালিকানা নিয়ে ইউপি সদস্যের ছেলের সঙ্গে মামলা চলছিল, আদালত মন্দিরের পক্ষে রায় দেন তবে ঐ মন্দিরের জমি দখল করার জন্য তারা চেষ্টা করছে। তারই সূত্র ধরে এ ভাংচুরের ঘটনা। তিনটি প্রতিমাও ভাংচুর করা হয়। একই মাসে গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব হাটবাড়িয়া ইউনিয়নে সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। দুর্গার গলায় টাকার মালা, পাঁচটি পিতলের ঘট ও কাপড়সহ পুজার সরঞ্জাম লুট হয়ে যায়। দুর্গার হাত ও অসুরের ঘাড় ভাঙা হয়। একই মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের নাবা গ্রামের সার্বজনীন পুজা মন্দিরে আসন্ন দুর্গাপুজা উপলক্ষে তৈরি করা প্রতিমা ভাংচুর করা হয় গভীর রাতে। মৌলবাদীরা দুর্গার তিনটি হাতের ও সিংহের মুখের অংশবিশেষ ভাংচুর করে। বীরেন্দ্রনাথের পুত্র দিলীপ কুমার বৈরাগী এ ব্যাপারে থানায় মামলা করেন। আরো একটি ঘটনা ঘটে নভেম্বর মাসে, দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার ডাবোর ইউনিয়নের উত্তর মহেশপুর গ্রামের সিংড়া কালী মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর করা হয় ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ছয়টি হাতবোমা উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান মন্দিরে পালাগান চলার সময় ১০/১৫ জন অতর্কিতে মন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমার মাথা ভাংচুর করে, প্রতিমার সঙ্গে থাকা ২০ ভরি স্বর্ণ ও ১০ কেজি রূপা নিয়ে যাওয়ার সময়ে এলোপাতাড়ি রামদা দিয়ে কুপিয়ে চারজনকে আঘাত করে, আতঙ্ক সৃষ্টি করতে ঘটনাস্থলে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এর আগে সেপ্টেম্বরে সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার শেয়ালকোল কর্মকার পাড়া শ্মশান কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর করা হয়, কালী প্রতিমাটির পুরো কাঠামোটি উল্টে দেওয়ায় কালী প্রতিমা ও ডাকিনী-যোগিনীসহ তিনটি প্রতিমা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চাঁদাবাজির ঘটনা দেখি। সাভার জেলার আশুলিয়ায় মে মাসে একটি হিন্দু সংখ্যালঘু পরিবারের উপর স্থানীয় প্রভাবশালীরা চাঁদা দাবী করে, চাঁদা দিতে অসম্মত হওয়ায় পরিবারটির উপর হামলা করা হয়, বসতবাড়িতে ভাংচুর চালানো হয়। এতে বৃদ্ধাসহ ছয়জন আহত হয়। ঘটনার তদন্তে জানা যায় স্থানীয় একটি অনুষ্ঠানের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রলীগকর্মীরা চাঁদা সংগ্রহ করছিল। সংখ্যালঘু পরিবারটি চাঁদা দিতে না চাইলে ছাত্রলীগকর্মীরা বাড়িতে থাকা টিভি, ফ্রিজ, দরজা-জানালা ভাংচুর করে। পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনার পর আসে। একই মাসে মে মাসে ঝিনাইদহের শৈলকূপায় ৬ নং সারুটিয়া ইউনিয়নের নাদপাড়া গ্রামে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের ভয়ে ৩ সংখ্যালঘু পরিবারের ১০ সদস্য নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। অন্যদের তালা লাগানো ঘরবাড়ির মাঝে স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে থেকে গেছেন বৃদ্ধা নির্মলা রাণী। নির্মলা রাণী এখন ঘুরছেন প্রতিবেশীদের দ্বারে দ্বারে আর জানাচ্ছেন: অব্যাহত চাঁদার দাবীতে প্রতিদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই সন্ত্রাসীরা মটর সাইকেলযোগে বাড়ির বারান্দায় অবস্থান নিয়ে নেশা করে, আড্ডা দেয়, গালিগালাজ করে।