অরুন্ধতী রায়ের লেখা আমাদের কাছে যতই একপেশে মনে হোক তিনি কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের কাছের মানুষ। কিন্তু অরুন্ধুতীর ছাপাপোনাদের এদেশের সংখ্যালঘুরা ‘চুতিয়া’ বলে মনে করে কেন?
দেশে যখন শরৎকালীন মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি শুরু হয় তখন আমাদের প্রতিবাদ করা লেখাগুলো কারা শেয়ার লাইক কমেন্ট করে? বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ যারা আঘাত পাচ্ছে তাদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে। কিন্তু যারা লিখছে ‘মূর্তি ভাংচুরের দায় জঙ্গি বা ইসলমাপন্থিদের উপর দেয়ার আগে খোঁজ নেন মন্দির কমিটির নিজেদের দ্বন্দ্ব কতখানি ছিলো। এরকম বহু ঘটনা আছে নিজেদের ক্ষমতায়নের জন্য হিন্দুরা নিজেরাই মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি করে থাকে…’। এরকম লেখায় হাজারখানেক লাইক। তিন-চারশো শেয়ার আর শত শত কমেন্টে ‘সহমত ভাই, ঠিক বলেছেন ভাই, এদেশে হিন্দুরা যতটা স্বাধীনতা পায় ভারতে মুসলমানরা তেমনটা পায় না, মুসলমানদের তো ভারতে গরুর মাংস খেলেই হিন্দুরা পিটিয়ে মেরে ফেলে…। স্বাভাবিকভাবেই এই লাইক কমেন্ট আর শেয়ারকারীদের মধ্যে ভিকটিমরা থাকে না। এই লাইক কমেন্ট্ শেয়ারকারীরা মূলত ফ্যানাটিক, রেসিস্ট, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী, মুসলিম ব্রাদারহুড, প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাসী লোকজন।
এই ফ্যানাটিক, রেসিস্ট, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী, মুসলিম ব্রাদারহুড, প্যান ইসলামিজমে বিশ্বাসীরা কেমন করে আপনাদের লেখার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সহমত হতে পারছে? কেন একটা আদিবাসী, একটা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনাকে চুতিয়া বলছে? আমরা সবাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিখি। এই প্রেক্ষাপটে, এই রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরুগিরি, প্রতিনিয়ত জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে বঞ্চিত হবার ঘটনা থাকার পরও আপনাদের লেখায় কেন একজন পাহাড়ী, হিন্দু, বৌদ্ধর না বলা কথাগুলো বলে উঠে না? কেন পরাজিত মানুষগুলো আপনাদের লেখায় সান্ত্বনা পায় না?
ফরহাদ মজহারের কথাই ধরুন। যত রাজ্যের সাম্প্রদায়িক ইসলামিক লোকজন তার পোস্টের ফলোয়ার। লোকটা লিভটুগেদার করুক যাই করুক- তিনি বখতিয়ার খিলজীর ঘোড়ায় চেপে বিপ্লব করতে চান, তিনি সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে এটাই তাদের সমর্থনের কারণ। পিনাকী- নামে পদবীতে হিন্দু তাই সে যখন হিন্দু নির্যাতনকে একটা মিথ বলে এবং হিন্দুদের দেশত্যাগটাকে হিন্দুদের বাপের দেশে চলে যাওয়া অর্থ করে তখন এদেশের রেসিস্ট ফ্যানাটিক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি তাকে হিন্দু, তার মুসলিম স্ত্রী সব জানার পরও চোখ বন্ধ করে সমর্থন দিযে যায়। এদিকে সংখ্যালঘু ভিকটিমরা এদের চুতিয়া বলে গায়ের ঝাল মেটালেও ওপারের অরুন্ধতীদের ওখানকার সংখ্যালঘুরা ঠিকই পুজা করে! অরুন্ধতীরা কিন্তু সেক্যুলার বিরোধী না। তারাই সেদেশে ‘সেকুমাকু’ বলে উপহাসের শিকার হোন। তারা কিন্তু তাদের লেখায় সেক্যুলারিজমকে আঘাত করেন না। উদ্ভূত না? ভারতীয় কিংবা পশ্চিমের সেক্যুলারদের ছাপাপোনারা এদেশের সেক্যুলারদের বিরোধী! কেউ ইসলাম বিদ্বেষী খোঁজে, কেউ মুহাম্মদের ইজ্জত রক্ষা করে চলে, কেউ সুফিবাদী কমিউনিস্ট পীর সাজে…।
বাংলাদেশের নাস্তিক সেক্যুলারদের বিরুদ্ধে গোলাম সরওয়ার, পারভেজ আলমদের মত ব্লগাররা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। নাস্তিকরা সালাফি সেক্যুলার কিংবা নব্য এথিস্ট। ইনারা কিন্তু মহান সব কাজে ব্যস্ত। কেউ ‘বাঙালী মুসলমান সংস্কৃতির’ প্রচারক আবিস্কার করছেন। ‘ওয়াজ শিল্পী’ বলছেন কোন মোল্লাকে! ইমাম হোসনকে আজকের ফ্যাসিবাদীদের সঙ্গে লড়াই করতে অনুপ্রারণা বানাচ্ছেন- এরকম লোকজন কিভাবে এদেশের হিন্দু খ্রিস্টান কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসীদের নিজের মানুষ হবে? পাহাড়ে সেটেলার বাঙালী মুসলমান আর রোহিঙ্গা মুসলমানের দ্বৈত চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া একজন চাকমা মারমাকে রেসিস্ট বলা, গোটা জাতিগোষ্ঠির মধ্যে রেসিস্ট খোঁজা সুফিবাদী ইসলামপন্থি হিসেবে ঠিক আছে। বাংলাদেশ হয় সালাফি মুসলমানদের হবে, নতুবা সুফিবাদী মুসলমানদের হবে, নতুবা মাজারন্থি মুসলমানদের হবে, নয়ত মডারেট মুসলমানদের হবে- কিন্তু কখনই হিন্দুর দেশ হবে না। চাকমার দেশ হবে না।…
আমি এত কথা বলছি একদমই অন্য একটি বিষয়কে বলার জন্য। আমার একটা আপত্তির জায়গা আছে। বাংলাদেশে সেক্যুলার যিনি বা যারা আছেন যদি তারা সত্যিই সেক্যুলারিজম বুঝেন তাহলে তিনি অবশ্যই রাষ্ট্রকে নাস্তিক হতে হবে বলে মানেন। কাজেই এই রাষ্ট্রকে নাস্তিক হতে হবে তাহলেই এদেশটা সবার হবে। রাষ্ট্র যখন নাস্তিক হয়, ধর্মহীন হয় তখন সেটা কোন জাতি গোষ্ঠির একার হয় না। যাদের কথা বললাম তারা নিশ্চত করেই তাদের লেখা দিয়ে প্রমাণ করেছেন তারা এরকম কোন রাষ্ট্রের কথা কল্পনাও করেন না। যদিও কেউ সুইডেন, কেউ নেদারল্যান্ডের মত নাস্তিক দেশে বসেই যতসব বিল্পব ফেলানোর কথা বলেন। কেউ লিভ টুগেদার করে, কেউ সেক্যুলার ম্যারেজ এক্টে মুসলিম মেয়ে বিয়ে করে সেক্যুলার সমাজ ও রাষ্ট্রকে গালি দেয়। কাজেই এরা কে কি সেটা বলার চাইতে তারা কেউ সেক্যুলার নাস্তিক্যবাদী নয় সেটা নিশ্চিত। এটা এ জন্য বললাম যে, এদের বিরুদ্ধে কথা বললেই কিছু মানুষ এসে প্রথমে শুরু করেন ‘নিজেদের মধ্যে কাদা ছুড়াছুড়ি করা ঠিক না’। জ্বি না, ইনাদের পথ ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গেছে। কেউ ২০১৩ সালের পর, কেউ ব্লগার কিলিংয়ের পর, কেউ বিদেশে এসাইলাম পাবার পর…।
তবে এদের নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। তারা কি এদেশের একজন মানুষকেও সেক্যুলার থেকে সাম্প্রদায়িক কিংবা মুসলিম জাতীয়তাবাদী বানাতে পেরেছে? নাস্তিক থেকে প্রবল রকমের ‘ইসলাম বিদ্বেষী অন্বেষণের’ আতেঁল তৈরি করতে পেরেছে? মোটেই নয়। দেশে আগে থেকে থাকা বিপুল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মান্ধ, মুসলিম জাতীয়তাবাদী, প্যান ইসলামিস্ট, মুসলিম ব্রাদারহুড, ফ্যানাটিক, রেসিস্ট মুসলিম ও পাকিস্তানপন্থি লোকজন তাদেরকে কোলে তুলে নিয়েছে মাত্র। বাংলাদেশের নাস্তিক-সেক্যুলাররা বরং গর্বভরে বলতে পারে এই চরম ধর্মান্ধ দেশে কেবলমাত্র অনলাইনে ব্লগ আর ফেইসবুকে লিখে তারা বহু ছেলেমেয়েকে সেক্যুলার, নাস্তিক, প্রগতিশীল করতে পেরেছে।