দেশভাগ এই উপমহাদেশের যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দেশপ্রেমের সূচনা করেছে তা অখন্ড ভারতবর্ষ কিছুতে হতে দিতো না।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয়। বন্দুকের কার্তুজে গরু ও শুকরের চর্বি লাগানো হয়েছে এমন প্রচারণায় সিপাহীরা বিদ্রোহ করে উঠে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। শুকর ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে গরুর নিষিদ্ধ খাদ্য। সিপাহীরা নিজেদের ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে শেষতক ইংরেজদের দেশছাড়াই করতে বিদ্রোহ করে বসল। যে সংগ্রাম এইরকম ধর্মীয় ভাবাবেগে সংঘঠিত হয়ে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে তার ভবিষ্যত কি হতে পারত? মানে সিপাহীদের বিদ্রোহ সফল হলে কোন ভারতবর্ষ দৃশ্যপটে চলে আসত?

একদল খুনে লুটেরা সৈনিক স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে তাদের সম্রাট বলে ঘোষণা করল। সম্রাট তখন ইংরেজদের কাছ থেকে বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা ভাতা পান। সেকালের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ। ইংরেজরা দয়া করে মুঘল এই সম্রাটকে তখনো ভারতের শাহেনশাহ করে রেখেছে। বাদশাহও সব মেনে নিয়ে সারাদিন নাচ গান সুরা নর্তকী আর কবিতা নিয়ে মুশগুল থাকেন। বাদশাহী সমস্ত ঠাট তখনো চালু আছে। বাহাদুর শাহ জাফরের জন্য প্রতি বেলা ৮০-৯০ পদ পরিবেশন করা হতো। দুহাতে মোসাহেবদের বখসিস দিতেন। এসবই সাবেক কালের মুঘল সম্রাটদের পদঙ্ক অনুসরণ করার সামান্ত ঐতিহ্য। সম্রাট আকবরের জন্য একটি লুচি ভাজতে এক কেজি ঘি প্রয়োজন হতো। ভাজা শেষে সেই কড়াই ভর্তি ঘি ফেলে দেয়া হতো। এই ঘি কোন সাধারণ মানুষের ব্যবহারের অনুমতি ছিলো না। এভাবে প্রতিটি লুচির জন্য এক কেজি করে ঘি প্রয়োজন হতো। মুগলদের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ একজন কবি, উদাসিন মানুষ। রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ ঠাকুর সিপাহি বিদ্রোহের কিছুকাল আগে দিল্লি সফরে গিয়ে বোটে চড়ে যেতে যেতে এক অভিনব দৃশ্য দেখে অভিভূত হলেন। দেখেন নদীর ধারে একটা মাঠে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন আর জনতা তা চেয়ে চেয়ে দেখছে…। এরকম এক উদাসিন, কবি, ভাবুক, ইংরেজিদের কাগুজে সম্রাটকে সিপাহিরা তাদের নেতা ঘোষণা করল।

নিতান্তই বাধ্য হয়েই বাহাদুর শাহ সিপাহিদের কথায় রাজি হয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের বিচারের জন্য করা আদালতে আসামী হিসেবে সম্রাট নিজের জবানবন্দীতে স্বীকার করেছিলেন সিপাহিদের সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন না। বরং তাকে যথেষ্ঠ অপমান করা হতো। তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাদের হাতের পুতুল! চরম মূল্য দিতে হয়েছিলো এ জন্য সম্রাটকে। তার পুত্রদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো। আর তাকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিলো বার্মাতে। বিনা চিকিৎসাতে মারা যান ভারতের শেষ সম্রাট…।

ইংরেজ আমলেই ‘ভারত’ যে একটা গোটা দেশ এটা ভারতবাসী বুঝতে পেরেছিলো। তাই ভারতের স্বাধীনতার দাবী এসেছিলো অখন্ড জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। তার মাঝখানে ধর্ম এসে গেলে কি হয় সেটা দেশভাগের ফলই বলে দিচ্ছে। কাজেই সিপাহীদের ধর্মরক্ষার ডাককে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলার কোন কারণ নেই। এটা ছিলো হটকারীতা।

রাজা রামমোহন রায়, স্যার সৈয়দ আহমদ ভারতের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের আরো কিছুকাল ভারতবর্ষে থাকাকে নিজেদের জন্য সাপেবর মনে করতেন। ভারত একটি দেশ হিসেবে, সুশৃঙ্খল প্রশাসন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে উঠতে, বহুজাতি ও ভাষার বিচিত্র এই যে বিশাল ভারতবর্ষ- তাকে প্রতিটি ভারতবাসী উপলব্ধি করতে যতটুকু পাশ্চত্য দর্শন ও চিন্তাধারা প্রয়োজন তা ভারতের দুই প্রধান ধর্ম সম্প্রদায় হিন্দু মুসলমানের ছিলো না। বঙ্কমচন্দ্র আনন্দ মঠ উপন্যাসেও সেরকম কথা বলেছিলেন। সৈয়দ আহমদ তো মুসলমান সমাজকে ব্রিটিশভক্ত হতে বলেছিলেন রীতিমত। আর এসই হতে হবে ভারতের স্বাধীনতার জন্য। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিই অচেনা ছিলো। দেশভাগ এই উপমহাদেশের যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দেশপ্রেমের সূচনা করেছে তা অখন্ড ভারতবর্ষ কিছুতে হতে দিতো না। ৪৭ সালের বেদনাক্ত দেশভাগ দেখে মনে হয়, বোধহয় ভারতবাসী আরো একটু তৈরি হয়ে স্বাধীনতার ডাক দিলে ভাল হত।

Scroll to Top