শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুর একটি ছোট্ট কর্তব্য: ভাগলপুর এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
১৯৪৬, ৫০, ৬৪ সালে পূর্ববঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার ও গণ হিন্দু নিধন হয়েছিল তখন এপার বাংলায় তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি।
তখন পত্রপত্রিকা আজকের মত এতটা সেক্যুলার ছিল না। তাই ওই অত্যাচারের খবর প্রকাশ হয়েছিল। তাও এপার বাংলার হিন্দুরা নিশ্চুপ ছিল। এর প্রতিবাদে একটা মিছিল পর্যন্ত বের করেনি। তারা (মানে আমাদের পূর্বপুরুষরা) দোল দুর্গোৎসব রবীন্দ্রজয়ন্তী তে ব্যস্ত ছিলেন।
সেই সময় বিহারের ভাগলপুরের বিহারী হিন্দুরা আশ্চর্যজনক ভাবে পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের উপর অত্যাচারে, হিন্দুনারীর উপর অত্যাচারে ব্যাথা পেয়েছিলেন।
তাঁরা ভাগলপুরে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। হিন্দুরাই শুরু করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই যাদবরা। মুসলমানরা শিক্ষা পেয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী, পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা থামাতে ভাগলপুরের দাঙ্গার সুস্পষ্ট ভূমিকা ছিল।
তাই আসুন, ভাগলপুর কে কৃতজ্ঞতা জানাই। ভাগলপুরের হিন্দুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
ভাগলপুর সদা সচেতন। ১৯৮৯ সালে পবিত্র রামশিলা পূজার উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণেরও যোগ্য জবাব দিয়েছিল এই ভাগলপুর। আজও সে স্মৃতি অম্লান।
এই ভাগলপুর ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির চরম খারাপ সময়েও (১১৬) সুশীল মোদী কে জিতিয়েছিল। কিন্তু তারপর সুযোগসন্ধানী সুশীল মোদী (আমার প্রাক্তন সিনিয়র সহকর্মী), যিনি লালু – রাবড়ি রাজের অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে বিধানসভা ছেড়ে ক্ষমতার মধুপান করতে লোকসভায় চলে গিয়েছিলেন, তাও ওই ভাগলপুর সীট থেকে, যেই নীতিশ কুমারের সঙ্গে গটবন্ধনে নতুন জাতি-সমীকরণে (কুর্মি ভোট প্লাস হওয়ায়) আবার ক্ষমতা দখল করা গেল, অমনি লোকসভা ছেড়ে চলে এসে বিহারের উপ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসলেন।
বসেই তিনি দুটো নক্কারজনক কাজ করলেন।
১) ভাগলপুর লোকসভা সীটের উপনির্বাচনে কিষণগঞ্জের হারা প্রার্থী মোল্লা শানওয়াজ হোসেন কে এনে প্রার্থী করলেন। সে জিতল।
২) ১৯৮৯ সালের দাঙ্গা কেস, যা (হতে পারে যাদবপ্রীতিতে) লালু রাবড়ি দীর্ঘ ১৫ বছর ফাইল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন, তা আবার ওপেন করে রামেশ্বর যাদব সহ ৩০ জন যাদবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তারপর প্রেস কনফারেন্স করে গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করলেন, “হামনে ভাগলপুর কে মুসলমানো কো ন্যায় দিলায়া”।
ভাগলপুরের হিন্দুরা বুঝে গেল বিজেপির এই নেতা সুশীল মোদী কি চীজ!
কিন্তু একমাঘে তো শীত যায় না! এল ২০১৪। লোকসভা নির্বাচন। সারা দেশে প্রবল মোদী হাওয়া। বিহারেও। বিজেপির বিপুল জয়ে। বিহারেও। ইতিমধ্যে নীতিশ ছেড়ে গিয়েছে বিজেপি জোট। তা সত্বেও বিহার ঢেলে দিল মোদীজি কে, বিজেপিকে। কিন্তু আশ্চর্য! বিজেপির ট্র্যাডিশনাল সীট, চিরকালের যেটা সীট ভাগলপুর বিজেপি হেরে গেল। শানাওয়াজ হেরে গেল। ভাগলপুর শিক্ষা দিল বিজেপিকে। সুশীল মোদীর পাপের বোঝা বিজেপিকে বইতে হল। শুধু তাই নয়, যখন দেশের হাওয়া বুঝে নীতিশ আবার হাত মেলালো, ২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনে আবার বিজেপি নীতিশ জোট জিতল, কিন্তু আশ্চর্য, ভাগলপুর, গোটা ভাগলপুর জেলায় একটাও বিধানসভা সীট বিজেপি জিততে পারল না। সবগুলো হারল। তারা শাহনাওয়াজ কে মেনে নেবে না। হিন্দুর পিঠে সুশীল মোদীর ছুরি মারা তারা মেনে নেবে না।
কিন্তু ভাগলপুরের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা সেজন্য নয়। ১৯৪৬-৫০ শে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের প্রতি তাদের সমবেদনা ও সহমর্মিতার জন্য।
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। তবু এ প্রসঙ্গে একটা স্মৃতির কথা না বলে পারছি না।
২০০১ সাল অক্টোবর মাস। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়ে ফল বেরিয়েছে ১লা অক্টোবর। আমি তখন বজরং দলের উত্তর ভারতের দায়িত্বে দিল্লীতে। বাংলাদেশ থেকে ভয়ংকর খবর আসতে লাগল। বেগম খালেদা জিয়া জেতার পর হিন্দুদের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার শুরু হয়েছে। বরিশালের ভোলাতে একজন হিন্দু নারীরও সম্ভ্রম বাঁচেনি। বহু মন্দির ভাঙ্গা হচ্ছে। ১৯৪৬ ও ১৯৯২ এর অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
আমি দিল্লীতে বসে ছটফট করছি। কলকাতায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের নেতৃত্বকে বার বার আবেদন জানাচ্ছি, বাংলাদেশে এতবড় অত্যাচার হচ্ছে, কলকাতায় একটা প্রতিবাদ মিছিল করুন। বাংলাদেশ হাই কমিশনে একটা ডেপুটেশন দিন। তাঁদেরও ইচ্ছা করার। কিন্তু তাঁরা সবাই আমাকে কাতর স্বরে জানলেন, পুজো এসে গিয়েছে। সবাই পুজোর বাজার কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। এসময় কার্যক্রম করার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না।
ঘৃণা এসে গেল নিজের উপর বাঙালি বলে।
দিল্লীর বজরং দলের ছেলেদেরকে বললাম, বাংলাদেশে এই অত্যাচার হচ্ছে, তোমরা কিছু করবে? সবাই বলল, হাঁ জী, জরুর করেঙ্গে।
১৯ অক্টোবর দিল্লীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে আমরা বজরং দল বিক্ষোভ দেখালাম। গুগল সার্চ করুন। পাবেন। তারপর শ্রদ্ধেয় অশোক সিংহল কে জানালাম। তিনি আর এস এসের সঙ্গে কথা বললেন। আর এস এসের সহযোগিতায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে ৫ ই ডিসেম্বর যন্ত্রর মন্তরে ৫০০০ লোক নিয়ে আবার বিরাট বিক্ষোভ দেখানো হল। তারপর মাননীয় আশোকজীর নেতৃত্বে আমরা ১০ জনের প্রতিনিধি দল পার্লামেন্টে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী জীর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁকে অনুরোধ জানালাম বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। সে অন্য কাহিনী।
তাই বলছি, সেই ১৯৪৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত একই কাহিনী। বাংলাদেশে হিন্দুর উপর যত অত্যাচারই হোক, আমাদের আহার নিদ্রা মৈথুন, ভ্রমণ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী তে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। কিন্তু ওই খোট্টা বিহারীরা প্রতিবাদ করবে, প্রতিকার করবে। আর আমরা বাঙালিত্বের অহংকার নিয়ে ঘরে বসে থাকব।
ভাগলপুরের প্রতি, ভাগলপুরের হিন্দুদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে, বাঙালিদের পক্ষ থেকে নয়, আমার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।