ইতিহাস যোগেন মন্ডল কে ক্ষমা করেনি। বর্তমান সরকার দলীয় সুবিধাবাদী হিন্দু নেতাদেরও ক্ষমা করবে না। যে যোগেন মন্ডল হিন্দুদের সঙ্গে প্রতারণা করে মুসলমানদের দেশ পাকিস্তান কে সমর্থন জানিয়েছিল, মন্ত্রী হওয়ার লোভে। সেই যোগেন মন্ডল পাকিস্তানের মন্ত্রী হয়েছিলেন ঠিকই, তবে তিনি পাকিস্তানে থাকতে পারেননি। যোগেন মন্ডল কে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে হয় ভারতে।
অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি, যিনি সমগ্র হিন্দু সমাজের অহংকার। অথচ তাকে অপমান করছে সরকার দলীয় সুবিধাবাদী হিন্দু নেতারা। কিন্তু কেন? শুধুমাত্র অর্থ, ক্ষমতা আর প্রমোশনের লোভে। ‘মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানকে’ নিন্মবর্ণের হিন্দুদের নেতা যোগেন মন্ডল সমর্থন করে ১৯৪৬ সালে বলেছিলেন, ‘হিন্দুদের আওতায় থাকিয়া ঘৃণিত
জীবন-যাপন করার চেয়ে মুসলমান অথবা অন্য কোন জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সহিত বাস করিতে তফসিলি জাতি বেশী পছন্দ করে’।
উঁচু বর্ণের হিন্দুদের শিক্ষা দীক্ষা ও প্রভাবে তফসিলি সমাজের পিছিয়ে থাকার আশংকায় তারা যদি নিজেদের আলাদা করতে চায় সেটা দোষের কিছু নয়। একইভাবে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে থাকলে তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না- এই আশংকায় যদি আলাদা করে ‘মুসলমানদের দেশ’ চায় তো সেটাও দোষের কিছু না। সেভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ গঠিত হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানে যে অবশিষ্ট হিন্দুরা থেকে গিয়েছিলো তাদের বেশির ভাগই নিম্ন বর্ণের মানুষ। ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে কম-বেশি তারা নিপীড়িত, অসন্মানিত ছিলো। পাকিস্তানে তারা ভাল থাকবে। যোগেন মন্ডল পাকিস্তানে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ইতিহাস বড়ই জটিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যের শিকার বাঙালী মুসলমানদের হাতেই আবার সংখ্যালঘু বাঙালী হিন্দুরা নিপীড়িত শোষিত হচ্ছিল। ১৯৪৭ সালের পর ১৯৫০ সালে হিন্দুদের উপর আরেক দফা যে দাঙ্গা চালানো হয়েছিলো তাতে যোগেন মন্ডলও জান বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। তার পাকিস্তানের মোহ ঘুচে গিয়েছিলো সেটা পাঞ্জাবী পাঠানদের কারণে নয়। নিজ দেশের মানুষের ভয়াবহ চেহারা দেখে। তিনি তার পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার পক্ষে এটা বলা অন্যায্য নয় যে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘নিজভূমে পরবাসী’ করা হয়েছে, আর এটাই এখন হিন্দুদের কাছে পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করাটাই এদের একমাত্র অপরাধ। সুদীর্ঘ ও উদ্বেগময় সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত আমাকে এ কথায় বলতে হচ্ছে যে, পাকিস্তান আর হিন্দুদের জন্য বাসযোগ্য নয়। তাঁদের ভবিষ্যতে প্রাণনাশ ও ধর্মান্তরকরণের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হিন্দু ও রাজনৈতিক সচেতন তফসিলি জাতির লোকেরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। যে সমস্ত হিন্দুরা এই অভিশপ্ত দেশে অর্থাৎ পাকিস্তানে থেকে যাবে, আমার দৃঢ বিশ্বাস ধীরে ধীরে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের মুসলমানে পরিণত করা হবে বা নিশ্চিহ্ন করা হবে’।
(মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, জগদীশ মণ্ডল, ১ম খন্ড)
যোগেন মন্ডলকে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী বলে কষে একটা গালি দিয়ে আসুন নিজেদের পাপটাকে ঢাকি। এছাড়া আর কোন উপায় নেই কিন্তু! ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না- শুধু গোপন করা যায়। যে ভারতে থাকাকে যোগেন মন্ডল ঘৃণিত মনে করতেন তার শেষ জীবনের নিরাপদ আশ্রয় হয়েছিলো সেখানেই এবং তিনি দেখেছিলেন দেশভাগের পর ভারত থেকে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পাশ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়ার কোনো রেকর্ড নেই। উপরন্তু পাকিস্তান শুরু থেকেই ছিলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য এক নরক। ১৯৬৫ সালে ফের ভয়াবহ হিন্দু বিরোধী দাঙ্গা ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে। হাজার হাজার হিন্দু বাড়িঘর দখল হয়ে যায় রাতারাতি। ‘এনিমি প্রপার্টি’ আইনটি সে সময় পাকিস্তান সরকার পাশ করেছিলো। এটি পরবর্তীকালে, এমনকি আজকের সময় এসেও হিন্দু সম্পত্তি দখলের একটা ফাঁদ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
তাই আমি আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী হিন্দু নেতাদের বলছি, যে লক্ষ্য নিয়ে হিন্দুদের বিরোধীতা করে ওদের পক্ষ নিচ্ছেন, আপনাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। যোগেন মন্ডলের মত আপনাদের অবস্হাও একই হবে। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নিজ জাতি ভাইয়ের বিপক্ষে গিয়ে ভালো থাকা যায় না।