লেখকঃ জয়ন্ত কর্মকার
খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় যোগেনকে নিয়ে লেখা তাঁর উপন্যাসের নাম দিয়েছেন ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’। আমার এই লেখার বেশীরভাগ তথ্যই সে বই থেকেই নেওয়া।
প্রান্তিক জনপদ বাকেরগঞ্জ (বর্তমানে বাংলাদেশে) থেকেই নমশূদ্র যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল একদা পুরো অবিভক্ত ভারতবর্ষে নতুন এক ‘সর্বজনবাদী/বহুজনবাদী’ (Inclusive) রাজনীতির সূচনা ঘটিয়েছিলেন। বাকেরগঞ্জ থেকে সূচিত যোগেন মণ্ডলের রাজনীতি তাকে একাধিকবার প্রদেশের মন্ত্রিত্ব দিয়েছে; কেন্দ্রেও একাধিকবার মন্ত্রী ছিলেন তিনি। হিন্দুদের মূলধারা এবং দলিত এই দু’ভাগে ভাগ করে, বাংলাদেশের একটা বড় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বাংলাদেশের মধ্যেই রেখে দেওয়াই এই বহুজনবাদী রাজনীতিকের সবচেয়ে বড় অবদান।
যোগেন মণ্ডল এর রাজনীতির গোড়ার কথা ছিল ‘বহুজনের অংশগ্রহণমূলক’ সমাজ। ১৯১১ সালের লোকশুমারিতে দেখা যায়, বাকেরগঞ্জে হিন্দুসমাজের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগই ছিল নমশূদ্র, তথা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। আজকে প্রশাসনের ভাষায় যারা ‘তফসিলি জাতি’। এদেরই কণ্ঠস্বর ছিলেন যোগেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে কংগ্রেসের চৌহদ্দিতেই ছিলেন। সুভাষ বসুকে ঘিরে নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখতেন তিনি। একই সঙ্গে নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক-দার্শনিক অবস্থাও তাঁর তৈরি হচ্ছিল তখন। যোগেনের পৃথক সেই অবস্থানের মূল দিক হলো নিপীড়িত বর্গগুলোর ঐক্যের তাগিদ। সুভাষের বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের প্রতি চূড়ান্ত মোহভঙ্গ ঘটেছিল তার।
পূর্ববঙ্গের অভিজ্ঞতার পাটাতনে দাঁড়িয়ে এ সময় তিনি ভাবতে শুরু করেন, ভারতবর্ষে দলিত ও মুসলমানরা হলো প্রধান দুই নিপীড়িত বর্গ। এদের ঐক্য প্রয়োজন। উপনিবেশমুক্ত নতুন দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ণব্যবস্থার বাইরে থাকা অচ্যুত ‘তফসিলি হিন্দু’ এবং ‘অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণি’র সঙ্গে ‘ম্লেচ্ছ’ মুসলমানদের ঐক্যের মধ্য দিয়ে ‘বহুজন’বাদী রাজনীতি গড়ে তোলা না গেলে ব্রিটিশ-পরবর্তী সম্ভাব্য যেকোনো ‘সমাধান’-এ ঔপনিবেশিক আলোকপ্রাপ্তরাই নেতৃত্বে ও নীতিনির্ধারণে থেকে যাবে। এই রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়েই বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন সাড়া ফেলতে পারেনি দক্ষিণ বঙ্গে। আর এইরূপ রাজনৈতিক-দার্শনিক অবস্থান থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে চমকে দিয়ে যোগেন মণ্ডল ১৯৩৭-এর বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে বাকেরগঞ্জ-ভোলা থেকে অশ্বিনী কুমারের ভাতিজা সরল কুমার দত্তকে হারিয়ে দেন এবং পরে আরও এক ধাপ এগিয়ে মুসলিম লীগকে সহযোগিতা করার নীতি নেন।
১৯৪৬-এ আবারও তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন। ইতিমধ্যে তিনি বাংলা প্রদেশে নাজিমউদ্দিন মন্ত্রিসভায় সমবায়মন্ত্রী হন এবং পরে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভায়ও বিচারমন্ত্রী ছিলেন। এ সময়গুলোয় যোগেন মণ্ডল জিন্নাহর প্রধান এক রাজনৈতিক সহযোগীতে পরিণত হয়েছিলেন। যোগেনকে পাশে পেয়ে জিন্নাহ প্রথমবারের মতো মুসলিম লীগের বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্রের দাবি উত্থাপনের নৈতিক ভিত্তি পান। আবার যোগেনও জাতীয় পরিসরে এটা তুলে ধরতে সক্ষম হন যে বাংলায় নমশূদ্ররা, দলিতরা পৃথক এক রাজনৈতিক সত্তা এবং এদের প্রতি সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া যেকোনো ‘স্বাধীনতা’ অর্থহীন।রাজনৈতিক প্রচারযুদ্ধে যোগেনের সরাসরি ভূমিকার কারণেই মুসলিম-দলিত ভোটে সিলেটের মতো অঞ্চল আসামে যুক্ত না হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছিল সেদিন।
সাতচল্লিশের ওই সময়ে পাকিস্তান সৃষ্টিতে যোগেনের অবদান সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে যিনি উপলব্ধি করতেন, তিনি জিন্নাহ। তাই তিনি যোগেন্দ্রনাথকে নবসৃষ্ট দেশের সংবিধান সভার সাময়িক প্রধান করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রীও হন যোগেন মণ্ডল। সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ে বাকেরগঞ্জের নমশূদ্র যোগেন মণ্ডল যে করাচিতে এত বড় বড় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান গ্রহণ করছেন, তা শুধুই জিন্নাহর আশ্বাস থেকে যে পাকিস্তানে, বর্ণহিন্দুদের ভারতের মতো হবে না, এখানে সংখ্যালঘু তফসিলি জাতি ও দলিতদের অচচ্ছুত বা ‘অপর’ বিবেচনা করা হবে না।
জিন্নাহর অঙ্গীকারে যোগেনের প্রবল আস্থা ছিল। আর যোগেনের আস্থার কারণেই পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ নমশূদ্র ও দলিত ভারতে পাড়ি জমায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল তারা। কিন্তু বাস্তবে কি ঘটে? পাকিস্তান সৃষ্টির সময়ে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন ঘটাতে শুধুমাত্র পাশার ঘুঁটি হিসেবেই যে তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল, এই বাস্তবতা চোখের সামনে দলিতদের ওপর পূর্ববঙ্গে মুসলমান শাসকদের অত্যাচার এর মাধ্যমে উপলব্ধি করলেও যোগেন স্বীকার করলেন না। যে লাখো লাখো দলিত তফসিলি যোগেনকে বিশ্বাস করে ভারতে না এসে পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তান তৈরির পরে সেই দলিত তফসিলিদের ওপর নিপীড়ন নেমে আসে। যোগেন রাতের অন্ধকারে সমস্ত দলিতদের হায়েনার মুখে ফেলে দিয়ে মন্ত্রিত্ব ও পাকিস্তান ভূমিও ত্যাগ করলেন। সময়টা তখন ১৯৫০-এর অক্টোবর।
এবার তিনি ফিরে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র দলিতদের বিশাল অংশ তখন বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের ‘আদরে’ পশ্চিমবঙ্গমুখী উদ্বাস্তু। যোগেন মণ্ডল এদের মাঝে গিয়ে আবার নতুন করে তার বহুজনবাদী রাজনীতির চর্চা করতে মনস্থ করেছিলেন। অর্থাৎ বাঙালি হিন্দুদের হায়েনার মুখে ছেড়ে দিয়ে এসেও, সেই উদ্বাস্তুদের মধ্যেই আবার রাজনীতি করা শুরু করেন এই মানুষটি।
নিয়তির কি নিঠুর পরিহাস। যে ভারতের সংখ্যাগুরুর বিরোধিতা করে যোগেন মন্ডল জিন্নাহর পাকিস্তানে রয়ে গেলেন, সেখানেও তিনি হয়ে গেলেন শত্রু। ১৯৫০ এ নিজের সেই ‘বন্ধু’দের কাছ থেকে পালিয়ে এসে আবার তাকে আশ্রয় নিতে হল সেই ‘শত্রু’ ভারতেই। যার জন্য পাকিস্তানের মুসলিম লীগ ১৯৫০ সালেই যোগেনকে শত্রু বলে ঘোষণা করে। আর সেই ভারতেরই বনগাঁতে ১৯৬৮ সালে মারা গেলেন লাখো কোটি তফশিলি জাতির হাহাকারের আরেকনাম, বাঙালি হিন্দুর এক অপূরণীয় ক্ষতির রুপকার।
বরিশালের যোগেন………….