উপমহাদেশের মুসলমানরা পারস্য দরবেশদের কাছ থেকে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খেয়ে বাজি-পটকা পুড়িয়ে আনন্দ উদযাপন করা শিখল। ১৫ শাবান শবে বরাতের দিনে ইমাম মাহদী জন্মদিন ধরে পারস্য ইয়েমেন তুর্কী মুসলমানরা হালুয়া রুটি খেয়ে বাজি পটকা পুড়িয়ে আনন্দ করত। সেটাই উপমহাদেশে চালু হয়েছিলো। ছোটবেলায় আমরাও শবে বরাতের দিন বাজি পটকা ফুটাতাম। ৯০ দশক থেকে আরবী মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়। তারা শবে বরাতকে বিদাত, হালুয়া রুটিকে বিদাত, বাজি পটকা পুড়ানোকে হারাম বলতে থাকে। আস্তে আস্তে শবে বরাতের প্রভাব উপমহাদেশে কমতে শুরু করেছে। এতে কি মুসলমানদের মধ্যে মৌলিকভাবে ধর্মীয় দর্শনে কোন পরিবর্তন ঘটছে? অনেকেই বলেন ইরানী দরবেশদের হাতে উপমহাদেশে ইসলামের প্রবেশ ঘটেছিলো। তারা ছিলো সুফি। আর সুফি ইসলাম হচ্ছে উদার। আরবের স্যালাফি ইসলাম হচ্ছে উগ্র কট্টর… ইত্যাদি।
ইমাম মাহদীর জন্মদিন যারা বাজি পুড়িয়ে, পরস্পর হালুয়া রুটি বিলিয়ে উদযাপন করে তারা ইমাম মাহদীর আগমনের উদ্দেশ্য জেনেই করে। ইমাম মাহদী আসবে কাফের মুরতাদদের গলা কাটতে। এত মানুষের গলা কাটা হবে যে তার ঘোড়ার বুক রক্ত পর্যন্ত ডুবে থাকবে। ইমাম মাহদি বাইতুল মোকাদ্দেস দখল করে সেখানে ইহুদীদের কচুকাটা করে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করবে। পৃথিবীতে সাচ্চা মুসলমান ব্যতিত আর কারোর কোন অস্তিত্ব থাকবে না।… এহেন কোন রূপকথার রাজকুমারের আগমন যারা প্রতিক্ষা করে থাকে, তার কাল্পনিক জন্মদিনে বাজি পুড়িয়ে উদযাপন করে তারা কিভাবে শান্তিবাদী হয়? রক্তপাতের স্বপ্ন দেখা কোন সুস্থ বিবেকবান মানবিক বোধ সম্পন্ন সমাজে কাংখিত নয়। উপমহাদেশ যে ইসলামের প্রথম সাক্ষাৎ লাভ করেছিলো তাকে গেরুয়া রঙ দিয়ে যতই বৈরাগ্য রপ দেয়া হোক সত্য উদ্ভাসিত হবেই। সুফিদের আলখেল্লার তলে যে ঝকঝকে তলোয়ার উঁকি দেয় তা দীর্ঘকাল কল্পিত ইতিহাস দিয়ে গোপন করা যাবে না।
আসুন অসংখ্য সুফি দরবেশদের মধ্য থেকে কয়েকজন সুফির জিহাদের কথা জানি। হযরত শাহ জালাল জিহাদ করেছিলেন সিলেটের গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে। তার এই জিহাদ ছিলো কাফের শাসককে পরাজিত করে দারুল হার্বকে দারুল ইসলামের পরিণত করা। এরপর পীর বদরুদ্দীন দিনাজপুরের রাজা মহেশের বিরুদ্ধে একইভাবে সশস্ত্র জিহাদ করে তার রাজ্য দখল করেন। সুলতান বলখী রাজা বলরামের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন হরিরামপুরে। দিনাজপুরের আরেক রাজা মান নৃপতিকে জিহাদের মাধ্যমে পরাজিত করেন জাফর খাঁ গাজি। শাহ বদরুদ্দীন চট্টগ্রামে মগদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। কাত্তাল পীর নামের আরেকজন সুফি সম্রাট চট্টগ্রামের মগদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। যশোরের মুকুট রায়কে জিহাদের মাধ্যমে পরাজিত করেছিলেন সুফি পীর বড়খা গাজী। সুলতানি বলখী বগুড়ার পরশুরামকে জিহাদের মাধ্যমে উচ্ছেদ করেছিলেন…।
এরা সবাই সুফি পীর দরবেশ ছিলেন। তারা প্রত্যেকে তলোয়ার হাতে ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য দখল করতে লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। কাফের শাসনের অবসান করে আল্লার শাসন প্রতিষ্ঠাই তাদের জিহাদের উদ্দেশ্য ছিলো। এইসব পীর সুফি দরবেশরা অনেক সময় মুসলিম শাসকের শক্তি বাড়াতে তার শিষ্যদের নিয়ে সেনাদলে যোগ দিতেন। ক্ষমতা নিয়ে উত্তরাধিকার লড়াইয়ে পরাজিত কোন হিন্দু রাজ পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণও এক্ষেত্রে বিরল ছিলো না। মুসলিম শাসকদের রাজ্য বিস্তার বা স্থানীয়দের রাজনীতি ও ব্যক্তি স্বার্থ থাকলেও এইসব সুফি সম্রাটরা কেবল মাত্র ইসলামের জিহাদের আহ্বান ও দারুল ইসলাম বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এইসব আক্রমনে যোগ দিতেন।
ইরানের মুসলমানরা আমাদের শিখিয়েছিলো ‘খোদা হাফেজ’। আরবী মুসলমানরা বলল, খোদা কাফেরদেরও থাকে, মুসলমানদের কেবল আল্লাহ। তাই আমরা মুসলমানরা বলব ‘আল্লাহ হাফেজ’। উপমহাদেশ তাই খোদা হাফেজ বাদ দিয়ে আল্লাহ হাফেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই বিবর্তণ মুসলমানদের মৌলিক ইসলামী দর্শন থেকে সরিয়ে দেয়নি। সুফি, স্যালাফি, মাজারপন্থি, মডারেট… সব ক্যাটাগরির ইসলামই একটাই দর্শন অনুসরণ করে বাহ্যিকভাবে কিছু প্রথা প্রক্টিসে বিভক্ত হয়ে। সেই মৌলিক অভিন্ন দর্শন হচ্ছে এই পৃথিবীকে মুসলমানদের পৃথিবী বানানো। ইমাম মাহদীকে দিয়ে পৃথিবীকে কসাইখানা বানানো। শাহ জালাল ইয়েমন থেকে ‘খোদা হাফেজ’ বলেই ভারতবর্ষে এসেছিলো। তাই খোদা হাফেজ থেকে আল্লাহ হাফেজ মৌলিক কোন রূপান্তর নয়।