#আমি_অদৃশ্য_৩
আমি পৃথ্বীর জীবন কাহিনী লেখার সাথে সাথে বেশ কিছু প্রাচীন ইতিহাসের চর্চা করছিলাম। তাছাড়াও ভারতের নানান রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক চর্চাও নিয়মিত ছিল। কারণ বিশাল আকার চৌহান সাম্রাজ্য কে নিরঙ্কুশ ভাবে চালাতে এর প্রোয়জন অধিক ছিল। আমি গর্বিত ছিলাম শাকমভরি চৌহান বংশ নিয়ে।
দিল্লি (ইন্দ্রপ্রস্থ)-আজমিরের চৌহান রাজবংশের কূলদেবী হলেন শাকম্ভরী দেবী। হিন্দু পুরাণগাথা অনুযায়ী দেবী শাকম্ভরী আসলে দেবী পার্বতীরই এক অবতার।
দেবী শাকম্ভরী উজ্জয়নীর মহাকাল শিবের অর্ধাঙ্গিনী। ঐতিহাসিকদের মতে যেহেতু দিল্লি-আজমিরের চৌহান শাসকরা দেবী শাকম্ভরী কে বংশ পরম্পরাক্রমিক রূপে পূজিত করতেন সেই জন্যই দিল্লি-আজমিরের চৌহান বংশকে শাকম্ভরী চৌহান হিসাবেও অভিহিত করা হয়। যদিও আজমিরের চৌহান রাজবংশ সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু হিন্দু ধর্ম ছাড়াও তাঁরা জৈন ধর্মেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী সময় কালে পূর্ব ভারতে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, বাংলার পাল সাম্রাজ্য
অর্থাৎ আনুমানিক চারশত বছর, কিন্তু ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে রাজস্থানের আজমির নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এক মহান রাজপুত সাম্রাজ্য বা রাজবংশ যা বিস্তৃত হয়েছিল আনুমানিক প্রায় পাঁচশত বছর।
এই রাজপুত রাজবংশ প্রায় চারশত বছর ধরে আফগানিস্থানের ধূলি ধূসরিত মরুপ্রান্তর আর রুক্ষ পর্বত প্রান্ত থেকে ক্রমাগত ধেয়ে আসা একের পর এক বিজাতীয় আর বিধর্মী ম্লেছ তুর্কি দস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করে অখণ্ড ভারতভূমি আর্যবর্ত আর সনাতন ধর্মকে সুরক্ষিত আর সমৃদ্ধশালী করেছিল।
রাজপুতানার আরেক গৌরবশালী রাজ্য মেবারের প্রতাপশালী শিশোদিয়া রাজবংশের চেয়ে শৌর্য, পরাক্রম আর ত্যাগ স্বীকারে কোন অংশে কম নয় এই রাজবংশ। মেবারের মতোই এই রাজবংশেও ভূমিষ্ঠ হয়েছে একাধিক বীর যোদ্ধা আর অনুভবি শাসক।
দিল্লি-আজমিরের শাকম্ভরী চৌহান বংশ মানেই কেবলমাত্র তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহান নন। এই রাজবংশ জন্ম দিয়েছে গোপেন্দ্ররাজ, সিংহরাজ, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বিগ্রহরাজ, দ্বিতীয় দুর্লভরাজ, তৃতীয় গোবিন্দরাজ, চামুণ্ডারাজ, তৃতীয় দুর্লভরাজ, প্রথম পৃথ্বীরাজ, দ্বিতীয় অজয়রাজ, আর্নোরাজদের মতো মহান চৌহান বীরদের ।
এনাদের সুতীক্ষ্ণ লৌহ তরবারি , প্রাচীন অতিকায় প্রাণীর মত বাহুবল আর সিংহের ন্যায় নির্ভীক হৃদয়ের সম্মুখে বারংবার প্রতিহত ও পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে পশ্চিমপ্রান্তের বর্বর আর নির্দয় স্মেচ্ছ তুর্কি জিহাদি দস্যুগণ। এমনকি আজমিরের চৌহান বংশের দুই অন্তিম বীর তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহান আর তাঁর ভ্রাতা হরিরাজ চৌহানের বীরত্বের সম্মুখেও একাধিকবার পরাজিত ও পদানত হয়েছে তুর্কি দস্যুরা।
দিল্লি-আজমিরের প্রাচীন চৌহান রাজবংশের পোশাকি ঐতিহাসিক নাম শাকম্ভরী চৌহান রাজবংশ। স্থানীয় ভাষায় এই প্রাচীন রাজবংশকে শম্ভরের চৌহান রাজবংশও বলা হয়। শাকম্ভরীর চৌহান রাজবংশ অগ্নিবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজপুত।
রাজস্থানের জয়পুর, আজমির থেকে জালোর আর মেবারের একাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল চৌহান সাম্রাজ্যের সীমানা আর রাজস্থানের বাইরে দিল্লি, হরিয়ানা, গুজরাটের একাংশ আর ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল চৌহান সাম্রাজ্য।
চৌহান বংশের রাজারা সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচশত বছর রাজত্ব করেছেন। ১১৯৪ খ্রিষ্টাব্দে অন্তিম চৌহান নরেশ হরিরাজ চৌহানের (তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা) আত্মদাহের সাথে সাথেই প্রাচীন শাকম্ভরী চৌহান রাজবংশের যবনিকাপাত হয়।
দশম শতাব্দী পর্যন্ত চৌহান রাজবংশের শাসকরা গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের সামন্তরাজা হিসাবে রাজ্য শাসন করেছেন। সেই সময় তাঁদের প্রাচীন রাজধানি অবস্থিত ছিল বর্তমান জয়পুর জেলার অন্তর্গত শাকম্ভরী বা শম্ভর নগরে।
উত্তরপ্রদেশের প্রাচীন সমৃদ্ধশালী কান্যকুব্জ বা কনৌ নগর অধিকারের লক্ষ্যে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্য, পাল সাম্রাজ্য আর রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য নবম শতাব্দী থেকে এক দীর্ঘস্থায়ী ত্রিদেশীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে উপরিউক্ত তিন সাম্রাজ্যেরই ভয়ানক ক্ষতিসাধন হয় এবং তাঁদের সাম্রাজ্যের ভীত দুর্বল হয়ে পড়ে।
উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ভারতের তিন প্রধান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমৃদ্ধশালী অখণ্ড ভারতবর্ষের উপর ধেয়ে আসতে থাকে আরবের খলিফা সেনা থেকে গজনীর সাবুক্তিগীন আর তার পুত্র মামুদের একের পর এক বৈদেশিক ইসলামিক আগ্রাসনের ঝড়।
লুণ্ঠিত হতে থাকে ভারতবর্ষের ধন-সম্পদ, ধ্বস্ত হতে থাকে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে সুপরিচিত বহু সমৃদ্ধশালী মন্দির আর বৌদ্ধ মঠ। ঠিক এহেন দুঃসময়ে ভারতবর্ষের পরিত্রাতা হিসাবে উত্থান ঘটে আজমির-দিল্লির চৌহান রাজবংশের।
দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রতাপশালী চৌহান শাসক সিংহরাজ চৌহান দুর্বল গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের সামন্তরাজার পদে চির বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজের রাজ্যকে এক স্বাধীন রাজ্য এবং নিজেকে এক সার্বভৌম নৃপতি হিসাবে ঘোষণা করে “মহারাজাধিরাজ” উপাধি গ্রহণ করে হাজিউদ্দিন নামধারী গজনীর এক ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন সেনাপতিকে আজমির জেলায় অবস্থিত জেঠানার যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত ও নিহত করে ভারতবর্ষের সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন।
এরপর দ্বাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মহারাজ দ্বিতীয় অজয়রাজ চৌহান একটি সমৃদ্ধশালী নতুন নগরের পত্তন ঘটান এবং চৌহান রাজ্যের রাজধানি শাকম্ভরী নগর থেকে এই নতুন নগরে স্থানান্তরিত করেন।।
নিজের নামানুসারে সেই নগরের নাম রাখেন অজয়মেরু যা পরবর্তীকালে লোকমুখে আজমির নামে পরিচিত হয়। মহারাজ দ্বিতীয় অজয়রাজের শাসনকাল থেকে তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের শাসনকাল পর্যন্ত এই অজয়মেরু বা আজমির নগরই প্রাচীন চৌহান সাম্রাজ্যের রাজধানি ছিল।
ইতিহাস বলছে গুর্জর-প্রতিহার, গুজরাটের চালুক্য, দিল্লির তোমার আর মালওয়ার পারমার রাজ্য সহ একাধিক প্রতিবেশী শক্তিধর রাজপুত রাজাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ ও সাম্রাজ্য বিস্তারে লিপ্ত থাকার সাথে সাথে একাদশ শতকের প্রারম্ভকাল থেকে গজনী আর দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ঘুরের তুর্কি আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক নির্ণায়ক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন চৌহান রাজারা।
বলাই বাহুল্য ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গজনী ও ঘুরের তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে সেইসব যুদ্ধে বারংবার বিজয়ী হয়েছেন তাঁরা। দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে সম্রাট চতুর্থ বিগ্রহরাজ, চৌহান তাঁদের পারিবারিক রাজ্যকে এক শক্তিশালি সাম্রাজ্যে পরিণত করেন।
১১৫২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট চতুর্থ বিগ্রহরাজ ইন্দ্রপুর বা ইন্দ্রপ্রস্থের তোমার রাজা বসন্তপাল ওরফে অনঙ্গপালকে যুদ্ধে পরাজিত করে তোমারদের রাজধানি ইন্দ্রপ্রস্থ অধিকার করে নিজের চৌহান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
চৌহান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাজা ছিলেন বাসুদেব চৌহান। তাঁর শাসনকাল আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের অন্তিম লগ্নে বা সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে। আবার ১১৭০ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজ সোমেশ্বর চৌহান (তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের পিতা) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিজোলিয়ার শিলালিপি অনুসারে শাকম্ভরী চৌহান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম শাসক ছিলেন সামন্তরাজ চৌহান।
সামন্তরাজের শাসনকাল আনুমানিক ৭২৫ খ্রিষ্টাব্দ। অনেকে বলেন তাঁর শাসনকাল আনুমানিক ৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
বহু শতাব্দীকাল ধরে অখণ্ড ভারতবর্ষের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসাবে তুর্কি আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরারত থেকে নিজেদের কর্তব্য পালন করেছেন আজমিরের বীর ও মহান চৌহান রাজারা।
ক্রমশঃ….
তথ্যঃ
Cynthia Talbot (2015). The Last Hindu Emperor: Prithviraj Cauhan and the Indian Past, 1200–2000