#বিদ্যান_ঘোষার_কথা
সনাতন বৈদিক ধর্ম এমন একটি গোত্র যার প্রধান ধর্মগ্রন্থের প্রাপক ও প্রচারকদের মহামনিষীদের মধ্যে নারী ঋষিকাগণ ছিলেন যা পৃথিবীর অন্য কোন রিলিজিয়ন(ধর্ম একটিই,বৈদিক ধর্ম,বাকীগুলো মার্গ) এর পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব।চলুন দেখে নেই পবিত্র বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে কিছু শ্রদ্ধেয় নারী ঋষিকার নাম-
১)ঘোষা(ঋগ্বেদ দশম মন্ডলের ৩৯-৪১ নং সুক্তের দ্রষ্টা,ঋষি কক্ষিবান এর কন্যা) ২)লোপামুদ্রা
৩)মৈত্রেয়ী
৪)গার্গেয়ী
৫)পৌলমি
৬)রোমশা
৬)অপালা
৭)বাক(ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবীসুক্তের দ্রষ্টা), ৮)অপত
৯)কত্রু
১০)বিশ্ববর
১১)জুহু ১২)ভগম্ভ্রীনি(মহর্ষি অম্ভ্রন এর কন্যা,ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের ১২৫ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
১৩)যরিতা
১৪)শ্রদ্ধা
১৫)উর্বশী
১৬)স্বর্ণগা
১৭)ইন্দ্রানী
১৮)সাবিত্রী
১৯)দেবায়নী
২০)নোধা
২১)আকৃষ্ভাষা ২২)শীকাতনবাবরি ২৩)গণ্পায়নী
২৪)মন্ধত্রী
২৫)গোধ
২৬)কক্ষিবতী
২৭)দক্ষিনা
২৮)অদিতি
২৯)রাত্রি(মহর্ষি ভরদ্বাজের কন্যা) ৩০)শ্রীলক্ষ
বেদে স্ত্রীর অধিকার না থাকলে তিনি যজ্ঞে তাঁর পতির সাথে যজ্ঞ করবেন কি করে ? কারণ যজ্ঞে দম্পতির মন্ত্র পাঠ করে আহুতি প্রদানের কথা ঋগ্বেদ ৮.৩১.৫ -৯ এ আছে |
বেদের বিভিন্ন গৃহ্যসূত্রে আছে “ইয়ং মন্ত্রঃ পত্নী পঠেৎ”অর্থাৎ এই মন্ত্রটি পত্নী পাঠ করবে। নারী বেদ শিক্ষা নিয়ে, বেদ মন্ত্র পাঠ করতেন শুদ্ধভাবে ।পবিত্র বেদ কি বলে বেদ পাঠ সম্পর্কে? যজুর্বেদ ২৬/২ স্পষ্টত ঘোষণা করছে,
ওঁ য়থেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য়ায় চ স্বায় চারণায় চ।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু ।।
অনুবাদ: হে মনুষ্যগন আমি যেরূপে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র, স্ত্রীলোক এবং অন্যান সমস্ত জনগনকে এই কল্যাণদায়িনী পবিত্র বেদবাণী বলিতেছি,তোমরাও সেই রূপ কর।যেমন বেদবাণীর উপদেশ করিয়া আমি বিদ্বানদের প্রিয় হয়েছি ,তোমরাও সেরূপ হও।আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যা প্রচার হোক। এর দ্বারা সকলে মোক্ষ এবং সুখ লাভ করুক।
-যজুর্বেদ ২৬
ঘোষার জন্ম হয়েছিল সপ্তর্ষির অন্যতম ঋষি অঙ্গীরার বংশে | তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন ঋষি দীর্ঘাত্মা | বাবা‚ ঋষি কাক্ষিবন | ছোট থেকেই বিদ্যার প্রতি তীব্র আগ্রহ ছিল ঘোষার | কিন্তু এই বিদুষী কন্যার ভাগ্য বিশেষ সুপ্রসন্ন ছিল না | শৈশবে তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন |
সমাজে অপাংক্তেয়‚ অবহেলিত ঘোষা আশ্রয় খুঁজে নেন বিদ্যাশিক্ষার ছত্রছায়ায় | কিন্তু ধীরে ধীরে কুষ্ঠর মতো চর্মরোগ তাঁকে কুৎসিৎ করে তোলে | এই রোগের প্রকোপে অঙ্গহানি হয় ঘোষার | এদিকে বিবাহযোগ্যা হলেও বিয়ে হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই তাঁর |
বিদুষী ঘোষা তখন স্তোত্র লিখলেন | তাঁর মানসিক অবস্থা প্রতিফলিত হয় ওই কাব্যে | ঋগ্বেদের দুটি স্তোত্র ঘোষার নামে উৎসর্গীকৃত | একটি স্তোত্র ছিল দেবতাদের চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদের উদ্দেশে | অন্য দুটি ছিল বিবাহ নিয়ে |
ঘোষার ঠাকুরদা এবং বাবা‚ দুই প্রজন্মই ছিল অশ্বিনীকুমারদের উপাসক | সেই পথ অনুসরণ করলেন ঘোষা নিজেও | কঠোর তপস্যা করলেন অশ্বিনীকুমারদের স্মরণে | তাঁদের পরিবারের তিন প্রজন্মের তপস্যায় প্রীত হলেন অশ্বিনীকুমার ভ্রাতৃদ্বয় |
তাঁরা ঘোষাকে শেখালেন মধুবিদ্যা | এই বিদ্যায় উপশম হল ঘোষার কুষ্ঠ রোগের | তিনি লাভ করলেন রূপ-যৌবন | কুষ্ঠমুক্ত হওয়ার পরে বিবাহ হল ঘোষার | অশ্বিনীকুমারদের কৃপায় রূপযৌবন এবং সুস্থদেহে বৈবাহিক জীবন লাভ করেন কাক্ষিবন-পুত্রী ঘোষা | পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র সুহস্থ্যও বড় কবি হন |
বৈদিক সাহিত্যে বেশিরভাগ স্থানেই ঘোষাকে আজীবন অবিবাহিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে | কোথাও কোথাও তাঁকে বিবাহিত বলা হয়েছে | কিন্তু স্বামীর নাম সেভাবে কোথাও বলা নেই |
গার্গী-মৈত্রেয়ীর মতো ঘোষাও ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী | গার্গী ব্রহ্মজ্ঞান সাধনার জন্য সংসারধর্ম থেকে বিরত ছিলেন | মৈত্রেয়ী বিয়ে করেছিলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে |
কিন্তু স্বামীর সঙ্গে ব্রহ্মসাধনা করবেন বলে সব সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছিলেন সতীনকে | গার্গী-মৈত্রেয়ী দুজনেই ছিলেন নিঃসন্তান | লোপামুদ্রা নিজে নগ্নিকা হয়ে স্বামী অগস্ত্য ঋষিকে আসক্ত করেছিলেন সংসারধর্মে | বুঝিয়েছিলেন ব্রহ্মজ্ঞান লাভে সংসার বাধা হয়ে দাঁড়ায় না |
লোপামুদ্রা এক পুত্রসন্তানের জননী হয়েছিলেন | ঘোষা‚ গার্গী-মৈত্রেয়ীর মতো ব্রহ্মবাদিনী | কিন্তু সংসার থেকে দূরে অবস্থান করে নয় | তিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন লোপামুদ্রার মতো‚ সংসার-সহবাস করেই | একদিকে সংসারী-জননী সত্তা‚ অন্যদিকে ব্রহ্মজ্ঞান সাধনা |
তাঁরা দেখিয়েছিলেন পুরুষ যদি সংসারধর্ম পালন করেও ব্রহ্মবাদী হতে পারে‚ তাহলে নারীর সাধনার পথেও সংসার কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে না | মনের জ্ঞানপিপাসাই আসল অনুঘটক |
এরপর অনেক তথাকথিত শিক্ষিত গণ্য মান্য ব্যক্তিগণ বলে থাকেন “বেদ ব্যাক ডেটেড, বর্তমান যুগে তা অচল।” এটি অত্যন্ত হাস্যকর কথা। সূর্যের বয়স তো পৃথিবীর চেয়ে বেশি, কিন্তু বয়স বেশি বলেই কি সূর্য ব্যাক ডেটেড হয়ে গিয়েছে?
বর্তমানে নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে আমরা সৌরশক্তিকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারছি। ঠিক সেভাবেই নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পবিত্র বেদের জ্ঞানকে আমরা আগের চেয়ে আরও কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করতে পারি। সময় গেলেও সূর্যের প্রয়োজনীয়তা যেমন কমে যায়নি, অন্য কোন কিছু যেমন সূর্যের স্থান দখল করতে পারেনি ঠিক তেমনি সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর যুগ চলে গেলেও বেদের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়নি বা অন্য কোন গ্রন্থই বেদ এর স্থান দখল করতে পারবে না।
পবিত্র বেদ এর জ্ঞান যে কখনোই পুরনো হয় না তা ঈশ্বর পবিত্র বেদে এই মন্ত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন-
অন্তি সন্তং ন জহাত্যন্তি সন্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্য়তি।।
অর্থঃ (অন্তি) নিকটে থাকার পরেও মানুষ(সন্তম্) পরমেশ্বরকে (পশ্যতি ন) দেখতে পায় না, আবার (অন্তি) নিকটে থাকার দরুণ মানুষ(সন্তম্) পরমেশ্বরকে (জহাতি ন) ছাড়তেও পারে না। (দেবস্য) দিব্য গুণ সম্পন্ন পরমাত্মার (কাব্যম্) বেদরূপী কাব্যকে (পশ্য)দেখ (ন মমার) সেই কাব্য কখনও মরেও না অর্থাৎ বাতিল হয় না, (ন জীর্য়তি) না কখনো পুরাতন বা জীর্ণ হয় অর্থাৎ তা সদা নবীন।
-অথর্ববেদ ১০/৫/৩২
কত সুন্দর উপমার মাধ্যমে ঈশ্বর বলে দিচ্ছেন বেদ যে সদা নবীন, তা কখনো ব্যাক ডেটেড হয় না। বরং অজ্ঞান অন্ধকারে নিমজ্জিত ব্যাক্তিরাই আসুরিক ভাবের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে নিজস্ব সাম্প্রদায়িক গ্রন্থ দ্বারা বেদের স্থান দখল করার ব্যর্থ প্রয়াস চালান। প্রকৃতপক্ষে তারা এভাবে বেদ বিমুখ হয়ে কলির ফাঁদে পতিত হচ্ছে।
তথ্যঃ
বৃহদারন্যক উপনিষদ