বঙ্গভঙ্গ_আন্দোলন_রবীন্দ্রনাথ_ও_রাখিবন্ধন_উৎসব।

#বঙ্গভঙ্গ_আন্দোলন_রবীন্দ্রনাথ_ও_রাখিবন্ধন_উৎসব

ভারতীয় উপমহাদেশ, একটি বিরাট এলাকা যার আয়তন ছিল ১,৮৯,৯০০ বর্গ মাইল, লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি ৮৫ লাখ, তার প্রতি নজর রাখা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ছিল এক কঠিন ব্যাপার। তাই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রায় অর্ধশতক বছর পূর্বেই ইংরেজ শাসকদের কাছে এ প্রদেশ বিভক্তি করণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল।

১৮৫৩ সালের চার্লস গ্রান্ট প্রশাসনিক সুবিধার জন্য প্রদেশটিকে ভাগ করার প্রস্তাব দিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তখন তা হয়ে ওঠেনি।

অবশেষে লর্ড কার্জন ভারতে বড় লাট হয়ে আসার পর তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেন। তার প্রচেষ্টায় ১৯০৩ সালে সরকারি গেজেটে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। নতুন প্রদেশের রাজধানী নির্বাচিত হয় ঢাকা। ১৯০৩ সালের সরকারি গেজেট প্রকাশিত হলে ও বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হয় ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর।

বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে মুসলমানদের সমর্থন ছিলো। লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে তার বক্তৃতায় বললেন, নতুন প্রদেশ গঠিত হলে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের প্রভূত উন্নতি হবে।

অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদও ১৯০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্টার থিয়েটারে রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অধিবেশনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে প্রস্তাবটি বিরোধিতা করে।

কার্জন স্বভাবতই এইসব চেঁচামেচিতে বিরক্ত বোধ করেছেন। ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভারতসচিব ব্রডরিককে লিখলেন, ‘বাঙালীরা নিজেদের একটা মহা জাতি মনে করে এবং তারা এমন একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন দেশ থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়েছে এবং জনৈক ‘বাবু’ কলকাতার লাট-প্রাসাদে অধিষ্ঠিত। এই সুখ-স্বপ্নের প্রতিকূল যে-কোনও ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই ভীষণভাবে অপছন্দ করবে। আমরা যদি দুর্বলতাবশত: তাদের হট্টগোলের কাছে নতি স্বীকার করি তবে কোনও দিনই আর বাংলার আয়তন হ্রাস বা বাংলা ব্যবচ্ছেদ সম্ভব হবে না। (এ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে) আপনি ভারতবর্ষের পূর্ব-সীমান্তে এমন একটা শক্তিকে সংহত ও সুদৃঢ় করবেন যা এখনই প্রচণ্ড, এবং ভবিষ্যতে যা সুনিশ্চিতভাবেই ক্রমবর্ধমান অশান্তির উৎস হয়ে উঠবে।”

কার্জনরা ভারতে তাদের ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করতে একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আয়োজন করলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন– উনিশ শতকের জাগরণ, ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাসের উদার পাঠ এদেশের মানুষের চেতনার বন্ধ দরোজায় আঘাত হানছে। পুরনো অন্ধকারের মধ্যে হাজার সূর্যের আলো পড়তে শুরু করেছে। রাজনীতি কেবলমাত্র আর সামন্তশ্রেণীর মধ্যে আটকে থাকছে না। প্রজাসাধারণের মধ্যেও শাসনতান্ত্রিক অধিকারবোধটি জাগ্রত হয়ে উঠছে। তারা আর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না। আত্মশক্তির বোধটির জন্ম হচ্ছে।

এরই অংশ হিসাবে কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে চলে গেলেন। তিনি ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহকে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দিলেন এবং নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করার মারাত্মক অস্ত্রে পরিণত করলেন। পাকিস্তানের বীজ রোপিত হল। এবং এক ধরনের হিন্দু নেতাদেরও হিংসার প্রবল বিষবৃক্ষ হিসাবে তৈরি করা হল। দেশের নতুন জাগ্রত চৈতন্যের মধ্যে পাপের জন্ম হল।

১৯০৪ সালের সীমানায় হস্তান্তরযোগ্য জেলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় রংপুর, বগুড়া ও পাবনা (৬ এপ্রিল), পাঁচমাস পরে (১৩ সেপ্টেম্বর) ভারত গভর্নমেন্ট রাজশাহী, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার হস্তান্তরের সুপারিশ করে। কিন্তু এগুলি হয়েছিল গোপনে, কার্জন তখন ভারতসচিব ও অন্যান্যদের মন থেকে দ্বিধার কাঁটা তুলে ফেলতে ব্যস্ত। ফলে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে জনসাধারণের বিক্ষোভও স্তিমিত হয়ে আসে। এটা ছিল কার্জনের একটি কৌশল।

কিন্তু কার্জন অন্যভাবেও বিক্ষোভ জাগিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। দীর্ঘ নীরবতার পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সুপ্রীম কাউন্সিলে একটি বিল আনেন। বিলটি আনার আগে তিনি ১৯০২ সালে ২৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ কমিশন নিয়োগ করেন। কার্জনের ‘এফিসিয়েন্সি তত্ত্বের’ মাধ্যমে শিক্ষা সংকোচনের নীতির প্রস্তাব রিপোর্টে করা হয়।

সিনেটে সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ইংরেজ সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, বেসরকারী কলেজে আইন-পড়ানো বন্ধ করা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজগুলির অবলুপ্তি, শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে পাশ মার্ক ও বেতন বৃদ্ধি, সিন্ডিকেটের হাতে স্কুল-কলেজের স্বীকৃতিদান বা এফিলিয়েশন ও প্রত্যাহারের অপার ক্ষমতাদান প্রভৃতি সুপারিশও কার্জনের রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়।। কমিশনের অন্যতম সদস্য ডঃ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই রিপোর্টের সঙ্গে দ্বিমত ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র প্রতিবাদী মন্তব্য পেশ করেন। আগস্টের গোড়ায় এই রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে নেই। কারণ নানা পারিবারিক সমস্যায় তিনি জর্জরিত ছিলেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা ওরফে বেলার বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে। শান্তি নিকেতনের বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। এবং তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন ২৩ নভেম্বর ১৯০২ সালে।

১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মজফ্ফরপুরে। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোণামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও য়ুনিভার্সিটি বিল দুটি বিষয়েই তার নিজস্ব মত প্রকাশ করলেন।

কার্জন কিছুদিন নীরব থাকলেন এবং প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে আন্দোলনকারীরাও নিরব হয়ে গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ সরব হলেন। এই নিরবতার সময়টিকেই কবি কথা বলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, আন্দোলন যখন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছিল আমরা তখন কোনো কথা বলি নাই; এখন বলিবার সময় আসিয়াছে।

তিনি এই দীর্ঘ আন্দোলন-মুখর সময়ে দূরে থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ছেন। নিজের লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তিনি বললেন, এই বঙ্গবিচ্ছেদ আন্দোলন অপূর্ব। অর্থাৎ এ ধরনের আন্দোলন এ দেশে পূর্বে হয় নি। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দেশে রাজনৈতিক উত্থান পর্বের সুচনা হয়েছে। দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে রাজশক্তির তীব্র আঘাতে।

এই অপূর্ব আন্দোলনটিকে স্বাগত জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মনে করেন, পরের কাছ থেকে সুস্পষ্ট আঘাত পেয়ে পরতন্ত্রতা শিথিল হলে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে উঠবে। ‘আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা আমাদের কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।

এই দেশ প্রেম একটা শক্তি, তার নাম দেশ প্রেম। এই শক্তি যখন হৃদয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা পরিণত হয় এক মহাশক্তিতে। এই মহাশক্তি দিয়ে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াই করা যায়–সেই লড়াইটারই সূচনাপর্ব রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন। এর আগে বাংলায় এই দেশপ্রেমের উন্মেষ রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ এভাবে দর্শন করতে পারেন নি।

১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।”

কার্জনের শিক্ষা সংকোচন বিল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, বিলিতি য়ুনিভার্সিটির ব্যয়বহুল আয়োজন দেশীয় জীবনযাত্রার জন্য সংগতিপূর্ণ নয়, ‘আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল—দেশের উচ্চনিচ্চ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্রণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। কিন্তু বিলিতি আদর্শে শিক্ষা যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অত্যন্ত বৃহৎ হয়ে উঠবে।”
অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে ছাত্র ও অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যবধান নেই, তাই শিক্ষাদানের উন্মুখতা ও বিদ্যালাভের জন্য প্রস্তুতি মানসিক সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়। তিনি এক্ষেত্রে বিদেশী শিক্ষা অধিকর্তা পেডলারের সঙ্গে সেই মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করা অতি দুরুহ ও অনিষ্টকর বলে ঘোষণা করেন, ‘হৃদয়ে হৃদয়ে যেখানে স্পর্শ নাই, যেখানে সুস্পষ্ট বিরোধ ও বিদ্বেষ আছে, সেখানে দৈববিড়ম্বনায় যদি দানপ্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তবে সে-সম্বন্ধ হইতে শুধু নিষ্পলতা নহে, কুফলতা প্রত্যাশা যায়। জাপানের মতো সুযোগ ও আনুকূল্য পেলে সহজেই ভারতীয়রা সেই শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লাচন্দ্রের সাধনা ও সাফল্য উল্লেখ করেন।

সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেছেন, এ স্থলে আমাদের একমাত্র কর্তব্য, নিজেরা সচেষ্ট হওয়া, আমাদের দেশে ডাক্তার জগদীশ বসু প্রভৃতির মতো যে-সকল প্রতিভাসম্পন্ন মনস্বী প্রতিকূলতার মধ্যে থাকিয়াও মাথা তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগকে মুক্তি দিয়া তাঁহাদের হস্তে দেশের ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার স্বাধীন অবকাশ দেওয়া; অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা-অনাদরের হাত হইতে বিদ্যাকে উদ্ধার করিয়া দেবী সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা করা; জ্ঞানশিক্ষাকে স্বদেশের জিনিস করিয়া দাঁড় করানো; আমাদের শক্তির সহিত, সাধনার সহিত, প্রকৃতির সহিত তাহাকে অন্তরঙ্গরূপে সংযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বভাবের নিয়মে পালন করিয়া তোলা।‘

বঙ্গভঙ্গ, য়ুনিভার্সিটি বিল ও দেশের কথা এই তিনটি সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্য ও আত্মশক্তির কথা বলেছিলেন। তাকেই তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকারে হাজির করলেন স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে।

এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন বাঙালির চিত্ত ঘরমুখ নিয়েছে। স্বদেশের শাস্ত্র, স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়ে উঠছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হল—স্বদেশের শিল্পদ্রব্য নিজেদের কাছে আদর পাচ্ছে, স্বদেশের ইতিহাস বাংলার গবেষণাবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলছে।

এ সময় রাজনৈতিক সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে ধারণ করাই সকলের কর্তব্য। সে হৃদয়কে ধারণ করার জন্য করণীয় তিনি নির্ধারণ করেছেন–
১. কৃষিমেলার আয়োজন
তিনি বিলেতি ধরনের সভার বদলে দেশী ধরনের মেলা করার প্রস্তাব করেন। সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্ত হতে একত্র হবে। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হবে। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদেরকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশসুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের যা কিছু বলার কথা আছে, যা-কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলে সহজ বাংলা ভাষায় করতে হবে।

২. হিন্দু-মুসলমান মিলন
প্রত্যেক জেলার ভদ্র শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহাদের জেলার মেলাগুলিকে যদি নবভাবে জাগ্রত, নবপ্রাণে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন, ইহার মধ্যে দেশের শিক্ষিতগণ যদি তাহাদের হৃদয় সঞ্চার করিয়া দেন, এই-সকল মেলায় যদি তাহারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করেন—কোনোপ্রকার নিষ্ফল পলিটিক্সের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি প্রভৃতি সম্বন্ধে জেলার যে-সমস্ত অভাব আছে, তাহার প্রতিকারের পরামর্শ করেন, তবে অতি অল্পকালের মধ্যে স্বদেশকে যথার্থই সচেষ্ট করিয়া তুলিতে পারেন।

৩.ধর্মীয় দূষিত মেলা সংস্কার
কবি দেখেছেন আমাদের দেশে যে-সকল মেলা ধর্মের নামে প্রচলিত আছে—সেগুলোর অধিকাংশই লোকশিক্ষার অযোগ্য হয়ে উঠে হয়েছে—কুশিক্ষারও মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তিনি এইসব কুৎসিত আমোদের উপলক্ষ এই ধর্মীয় মেলাগুলোকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। তার বদলে দেশী মেলার আয়োজন করতে হবে।

৪. নতুন ধরনের নেতৃত্ত্ব সন্ধান : জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের রূপরেখা
স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে উপলদ্ধির কথা বলেন। শর্করারস যেমন একটি সূত্রকে অবলম্বন করে মিছরির দানায় পরিণত হয়, তেমনি সমাজের বিচ্ছিন্ন শক্তি ও কর্মপ্রয়াসকে সংহত করার জন্য তিনি একজন সমাজপতি মনোনয়নের কথা বলছেন। তিনি বলেন, এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।

এজন্য একজন সমাজপতি দরকার। তার সঙ্গে তার পার্ষদসভা থাকবে। তারা সবাই মিলে সমাজের সমস্যা, সমাজের মানুষের জন্য করণীয়-কর্তব্য নিরূপণ করবে। সেখানে সকলে আলোচনা করবেন। লোকসাধারণ প্রাণ খুলে তাদের কথা বলতে পারবেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গৃহীত হবে এবং সেগুলো সমাজপতির নেতৃত্ত্বে বাস্তবায়ন করা হবে। এইভাবে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এটাকে একটি স্বাধীন জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, “বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ়—তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত অধিকার করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে। এখান সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে হইলে অত্যন্ত নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাঁড় করাইতে হইবে।”

সমাজপতির হওয়ার মতো এমন লোক পাওয়া কঠিন। একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়ে তোলা না করা গেলে এই সমাজপতি নির্বাচন করা কঠিন। এ সমস্ত সমস্যা থাকা সত্বেও তিনি লিখেছেন, যদি সমাজপতি-নিয়োগের প্রস্তাব সময়োচিত হয়, যদি রাজা সমাজের অন্তর্গত হওয়াতে সমাজ অধিনায়কের যথার্থ অভাব ঘটিয়া থাকে, যদি পরজাতির সংঘর্ষে আমরা প্রত্যহ অধিকারচ্যূত হইতেছি বলিয়া সমাজ নিজেকে বাঁধিয়া তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্য ইচ্ছুক হয়, তবে কোনো একটি যোগ্য লোককে দাঁড় করাইয়া তাঁহার অধীনে এক দল লোক যথার্থভাবে কাজে প্রবৃত্ত হইলে এই সমাজ-রাজতন্ত্র দেখিতে দেখিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিবে—পূর্ব হইতে হিসাব করিয়া কল্পনা করিয়া আমরা যাহা আশা করিতে না পারিব, তাহাও লাভ করিব—সমাজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি এই ব্যাপারের চালনাভার আপনিই গ্রহণ করিবে।

এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুরে। কলকাতায় ফিরেই তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে পড়ে শোনালেন। অন্য কিছু ব্যক্তিকেও তাঁর স্বদেশভাবনা বিষয়ক পরিকল্পনার কথা জানালেন। চৈতন্য লাইব্রেরী এন্ড বীডন স্কোয়ার লিটারেরি ক্লাবের উৎসাহী সম্পাদক গৌরহরি সেন ২২ জুলাই ১৯০৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠের ব্যবস্থা করেন।

প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে জানাচ্ছেন যে, চৈতন্য লাইব্রেরীর এই প্রবন্ধপাঠের বিষয়বস্তু মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার জন ছাত্র ও জনসাধারণ সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে সভাস্থলে ও সভার বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়—কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে মারামারি ও ইঁটপাটকেল ছোঁড়া কিছুই বাদ যায়নি।

রবীন্দ্রনাথ বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে বলে উপসংহারে প্রবন্ধ-লেখক স্বদেশের পূজার জন্য সকলকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায় আহ্বান করেছিলেন। কলকাতা শহরের অনেক গণ্যমান্য লোক কবির এই প্রবন্ধপাঠ শুনে চিত্রার্পিতের ন্যায় নীরবে শুনেছিলেন।

যারা প্রবন্ধটি শুনতে পারেননি তাদের অনুরোধে মিনার্ভা হলে কবি আবার প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে ৩০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি ২০০০ কপি ছেপে বিতরণ করা হয়েছিল পাঠের আগে। প্রবন্ধটিতে কিছু বক্তব্য সংযোজন করেছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথের গায়ে জ্বর ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। একটি চেয়ারে বসে প্রবন্ধটি পাঠ করেন।

সভাভঙ্গের আগে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আরও কিছু কথা বলেন লিখিত বক্তব্যের বাইরে। বলেন, “আজ সমবেত ব্যক্তিগণকে সমবেত ব্যক্তিগণকে সাহিত্যরস দেওয়ার জন্য আমি দাঁড়াই নাই। শুধু উদ্দীপনায় কোনো কাজই হয় না; আগুন জ্বালাইতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়িও চড়াইতে হইবে।..আমরা যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষুদ্রভাবে দেশের জন্য কাজ করিতে পারি। আমার প্রস্তাব—প্রত্যেকে নিজেদের গৃহে স্বদেশের জন্য যদি প্রত্যহ কিছু উৎসর্গ করিয়া রাখেন তবে ভবিষ্যতে সেই সঞ্চয় কাজে লাগিবে। তাহা ছাড়া উহা আমাদের একটা চেতনা প্রবুদ্ধ করিয়া রাখিবে। …আমাদের স্বদেশ ভক্তিও যেন সেইরূপ কোনো সভা-সমিতির তাগিদের প্রতীক্ষা না করিয়া নীরবে আপন কার্য সমাপন করে। স্বদেশের কাজ যেন বৃহৎ বাহ্য অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়।”

প্রবন্ধপাঠের পরে তিনি কলকাতার বিদ্বজ্জনের কাছে এই বার্তা নিয়ে আলোচনা করতে ছুটে বেড়ালেন। ২৯ জুলাই সকাল সন্ধ্যায় দুবার গেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে, ৩০ জুলাই গেলেন বসুপাড়ায় সিস্টার নিবেদিতার কাছে, ১ আগস্ট গেলেন নারকেলডাঙায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, ২ আগস্ট শ্যামবাজার ও কর্ণওয়ালিস স্টিটে, ৪-৫ আগস্ট গিয়েছেন পার্শিবাগান, ৬ আগস্ট আবার কর্ণওয়ালিস স্টিটে গিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্বদেশী সমাজ গঠন।

এছাড়া নিজেদের জোড়াসাঁকোতে প্রতিদিন নানাজন আসছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠিতে জানিয়েছেন, একটা সমাজ গঠনের জন্যে চেষ্টা চলছে।

স্বদেশী সমাজ গঠনের প্রথম উদ্যোগ অমল হোম অনুসন্ধান করে বের করেছেন– স্বদেশী সমাজ গঠনের কিছু তথ্য পাওয়া যায় দি ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে। ছাপা হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে স্বদেশী সমাজের একটি খসড়া সংবিধান দেওয়া হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে

“আমরা স্থির করিয়াছি আমরা কয়েকজন মিলিয়া একটি সমাজ স্থপান করিব। আমাদের নিজের সম্মিলিত চেষ্টায় যথাসাধ্য অভাব মোচন ও কর্তব্য-সাধন আমরা নিজে করিব, আমাদের শাসনভার নিজে গ্রহণ করিব, যে-সকল কর্ম আমাদের স্বদেশীয়ের দ্বারা সাধ্য তাহার জন্য অন্যের সাহায্য লইব না। এই অভিপ্রায়ে আমাদের সমাজের বিধি আমাদের প্রত্যককে একান্ত বাধ্যভাবে পালন করিতে হইবে। অন্যথা করিলে সমাজবিহিত দণ্ড স্বীকার করিব।

সমাজের অধিনায়ক ও তাহার সহায়কারী সচিবগণকে তাঁহাদের সমাজনির্দিষ্ট অধিকার অনুসারের নির্বিচারে যথাযোগ্য সম্মান করিব।
বাঙালী মাত্রেই এ সমাজে যোগ দিতে পারিবেন।”

এ সভার সভ্যগণের নিম্নলিখিত বিষয়ে সম্মতি থাকা আবশ্যক:
১) আমাদের সমাজের ও সাধারণ ভারতবর্ষীয় সমাজের কোনো প্রকার সামাজিক বিধিব্যবস্থার জন্য আমরা গবর্নমেন্টের শরণাপন্ন হইব না।
২) ইচ্ছাপূর্বক আমরা বিলাতি পরিচ্ছদ ও বিলাতি দ্রব্যাদি ব্যবহার করিব না।
৩)কর্মের অনুরোধ ব্যতীত বাঙালীকে ইংরেজিতে পত্র লিখিব না।
৪) ক্রিয়াকর্মে ইংরেজী খানা, ইংরেজি সাজ, ইংরেজি বাদ্য, মদ্যসেবন এবং আড়ম্বরের উদ্দেশ্য ইংরেজ-নিমন্ত্রণ বন্ধ করিব। যদি বন্ধুত্ব বা অন্য বিশেষ কারণে ইংরেজ-নিমন্ত্রণ করি, তবে তাহাকে বাংলা রীতিতে খাওয়াইব।
৫) যতদিন না আমরা নিজেরা স্বদেশী বিদ্যালয় স্থাপন করি ততদিন যথাসাধ্য স্বদেশীচালিত বিদ্যালয়ে সন্তানদিগকে পড়াইব।
৬) সমাজস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে যদি কোনো প্রকার বিরোধ উপস্থিত হয় তবে আদালতে না গিয়া সর্বাগ্রে সমাজনির্দিষ্ট বিচারব্যবস্থা গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিব।
৭)স্বদেশী দোকান হইতে আমাদের ব্যবহার্য ক্রয় করিব।
৮) পরস্পরের মধ্যে মতান্তর ঘটিলেও বাহিরের লোকের নিকট সমাজের বা সামাজিকের নিন্দাজনক কোনো কথা বলিব না।

এই দীর্ঘ সংবিধানে সমাজের কার্যপ্রণালীর খুঁটিনাটি, এমন-কি কর প্রদানের ব্যবস্থাদিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে সময়।

কেবল হিন্দু সমাজ প্রবলভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করল। বঙ্গভঙ্গ দিবসে কলকাতার টাউন হলে বর্ণ হিন্দুদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লাল মোহন ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ প্রভাবশালী হিন্দু নেতৃবৃন্দ যোগ দিয়ে ঘোষণা দেন যে, বঙ্গভঙ্গ রোধের জন্য তারা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু উৎসর্গ করবে।

বঙ্গভঙ্গের জন্য তৎকালীন হিন্দু পন্ডিত দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়, রজনীকান্ত সেন এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশে যে স্বদেশ প্রেমের বন্যা বইতে লাগল এবং জনসাধরণের মধ্যে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হলো ভারত বর্ষের ইতিহাসে এর পূর্বে বা পরে সেরূপ কখনো হয়নি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী উন্মাদনার প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯০৫ এর ২৮ শে সেপ্টেম্বর। অন্যটি ঘটে ১৯০৫ এর ১৬ অক্টোবর যখন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা আইন অনুসারে কার্যে পরিণত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিত্বপূর্ণ ভাষায় এ দিনটিকে উভয় বঙ্গের মিলনের চিহ্ন স্বরূপ রাখি বন্ধনের প্রস্তাব করে লিখলেন, আগামী ৩০ আশ্বিন বাংলাদেশ আইন দ্বারা বিভাজ্য হবে। কিন্তু ঈশ্বর যে বাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করেননি তাই বিশেষ রূপ স্মরণ ও প্রচার করার জন্য সেই দিবসটিকে আমরা বাঙালির রাখি বন্ধনের দিন করিয়া পরস্পরের হাতে হরিদ্রা বর্ণের সূত্র বাঁধিয়া দেব। রাখি বন্ধনের মন্ত্রটি এই, ‘ভাই ভাই এক ঠাঁই’।

১৬ অক্টোবর সকালে রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও হিন্দু আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করে গঙ্গা তীরে সমবেত হলো। গঙ্গায় স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি বাঁধল ।

এই উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের গান, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল-ধন্য হউক পুণ্য হউক’ সর্বত্র গীত হলো। বিকালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী নিদর্শন হিসাবে ‘বঙ্গ ভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কলিকাতায় পার্সি বাগান মাঠে ‘মিলন মন্দির’-এর ভিত্তি প্রাস্তর স্থাপিত হলো।

সভায় ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনির মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সভাপতির ভাষণ প্রদান করেন। এটি বাংলায় পাঠ করে শোনান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঘোষণায় বলা হয, ‘যেহেতু আমরা এ প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙালি জাতির একতা সংরণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙালি জাতি আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব সকলই প্রয়োগ করিব। বিধাতা আমাদের সহায় হউন।’

বঙ্গভঙ্গের পর পর হিন্দুদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তী কালে চরম পন্থী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কারণ চরমপন্থা ছাড়া অধিকার আদায়ে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথও  আন্দোলনে নিজকে জড়িয়ে ফেলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই একটি সমিতি গঠন করেন। রবীন্দ্রনাথ দেবী কালীর মূর্তি ও মড়ার মাথার খুলি সামনে রেখে গুপ্ত সমিতির সদস্য তালিকায় স্বাক্ষর দান করেন।

রবীন্দ্রনাথ তার ‘আত্মপরিচয়’ নামক পুস্তকে লিখেছেন ‘জ্যোতি দাদা এক পোড়াবাড়ীতে এক গুপ্ত সভা স্থাপন করেছেন। একটা পোড়াবাড়ীতে তার অধিবেশন। ঋকবেদের পুঁথি, মরার মাথার খুলি আর খোলা তলোয়ার নিয়ে তার অনুষ্ঠান। রাজ নারায়ণ বসু তার পুরোহিত। সেখানে আমরা ভারত উদ্ধারের দীক্ষা পেলাম।’

এ সময় গড়ে ওঠে ‘হিন্দু মেলা’। শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের মধ্যে বিপ্লবী ভাবধারা জাগিয়ে তোলাই ছিল এ মেলার উদ্দেশ্য। কিন্তু বিপ্লবের আসল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম বিদ্বেষ। হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, মুসলিমদের বিদ্বেষের ফলে বঙ্গ দেশে তথা সারা ভারতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হলো।

হিন্দুদের ধর্মীয় স্বদেশী আন্দোলন দেশে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় গভীরে প্রবেশ করিয়ে দিল। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অবসান হলো না। বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় উল্লসিত হিন্দুরা রাখি বন্ধন উৎসব পালন করল।

এই আন্দোলনকে উৎসাহিত করে তিনি ‘সুপ্রভাত’ কবিতায় লিখলেন-
‘রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি
এসেছে দুয়ার ভেদিয়া,
বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎ বাণ
স্বপ্নের জাল ছেদিয়া।’

হিন্দু রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিন্দু ধর্ম পুনরুজ্জীবন চেষ্টা ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্ন। তাই বাংলা বিভাগ কার্যকর হলে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ‘বঙ্গমাতার’ অঙ্গচ্ছেদ বলে বিভাগটির ধর্মীয় রূপ দেয়া হলো এবং সমগ্র হিন্দু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মেতে উঠল।
১৯০৬ সালে সারা ভারতব্যাপী শিবাজী উৎসব পালন করে হিন্দু ধর্ম পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করা হলো। এ উৎসব উপলক্ষে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিবাজী উৎসব’ লিখে হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবন কর্মে প্রত্যক্ষ ভাবে যোগ দেন এবং শুভ শঙ্খনাদে ‘জয়তু শিবাজী ’উচ্চারণ করে এ ‘ ধ্যান মন্ত্রে’ দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি লিখলেন-

ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন-
দরিদ্রের বল।
এক ধর্মরাজ্য হবেএ ভারতে- এ মহাবচন
করিব সম্বল।

তথ্যঃ

রমেশচন্দ্র মজুমদার, History of the Freedom Movement in India, vol. II,