নোয়াখালী আমার দিদার বাড়ি, বর্ধমান আমার মামার বাড়ি :
—————————————————————
কথায় ছড়া কেটে বলে :’মামাবাড়ি ভারী মজা, কিল চড় নাই !’ আংশিক সত্য, অন্তত আমার ক্ষেত্রে, কারণ বিশিষ্ট লেজধারী হওয়ার ফলে, কিল চড় না খেলেও বকা খেতাম মাঝে মাঝেই । ছোটবেলায়, ছুটিতে মামাবাড়ি বর্ধমানে এভাবেই কেটে যেত এডভেঞ্চার ময় ছুটিগুলো । দিদা একটা টিপিকাল জর্দা খেত , বিশেষভাবে দাদু ওটা দিদার জন্য আনিয়ে দিত । মা দের মুখে মুখে বলা কথায় আমরাও শিখে গেছিলাম ওটাকে গুন্ডি জর্দা বলে । বেশ ম ম করা একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছিল । রাতে সবার আগে খাবারের টার্ন থাকতো আমাদের ছোটদের । দিদা বেশিরভাগ সময়েই এক থালায় ভাত মেখে গরোস করে খাইয়ে দিত আমাদের চার ভাই-বোনকে । তারপরে আসতো দাদুর খাওয়ার টার্ন, এবং শেষে মা, মাসি মামা আর দিদা সক্কলে একসাথে বসে খাওয়া এবং খাওয়া পরবর্তীতে আড্ডা । আমাদের খাওয়ার কিছু পরেই শুতে চলে যেতে হতো, পূর্ব নির্ধারিত বিছানা অনুযায়ী । আমার জায়গা বরাবর দিদার খাটে , ঠিক দিদার পাশে । রাতে দিদা না আসা পর্যন্ত একলা বিছানায় ডিম্ আলোতে শুয়ে থাকা আমার কাছে ছিল আতঙ্কের একটা ব্যাপার । দূরে রেলগাড়ির সাইডিং এ শান্টিং ইঞ্জিনের ধাক্কায় কামরার চলমান শব্দ বুঁকে ভয় ধরিয়ে দিত, আর বিভিন্ন সময়ে এর তার মুখে শোনা ভুতের গল্পগুলো মনে করিয়ে দিত, আমি চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পরে থাকতাম আর প্রহর গুনতাম কখন দিদা আসবে……..। দিদা আসতেই একবুক স্বস্তি । দিদা ঠিক ধরে ফেলতো আর বলতো: ‘বাবন এখনো ঘুমাস নাই, কাইল থিকা আর তোরে নিয়া শুমু না ।’ দিদা পাশে শুতেই আবদার শুরু করতাম:’দিদা একটা গল্প বলোনা ।’ দিদাও প্রথমে না করলেও কোনো না কোনো গল্প শোনাতো । সেই গল্পের মধ্যেই স্বভাবত চলে আসতো নোয়াখালী, দিদার শশুরবাড়ি বিক্রমপুরের কথা । আমার দাদু নাকি দারুন লাঠি ঘোরাতে পারতেন । প্রথম বিয়ে করে যাওয়ার পর দাদু নাকি আত্মীয় কুটুম্বদের অনুরোধে বাড়ির উঠোনে সকলকে লাঠি ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন । এই গল্পটা বলার সময় দিদার মুখে কেমন একটা গর্ববোধের অভিব্যক্তি চলে আসতো । দাদু নাকি এত স্পিডে লাঠি ঘোড়াতেন শরীরের চারপাশে যে যেকোনো কিছুই সেই ঘুরন্ত লাঠির বলয়ে বাধাপ্রাপ্ত হবে ! আজ যখন নোয়াখালীর ১৯৪৬ এর ইতিহাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘেঁটে দেখছি, জানছি বার বার মনে হচ্ছে চিৎকার করে বলি : ১৯৪৬ এ নোয়াখালীতে কি দাদুর মত কোনো সংখ্যালঘু হিন্দুরা ছিলোনা এমন লাঠি গোড়াতে পারে ? তারা কি সেদিনের বাঙালি মুসলমানের জান্তব নৃশংসতার বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, নিজেদের বাঁচাতে ? অসহায় সেই সংখ্যালঘু মানুষগুলোর সেদিন কি হাল হয়েছিল তাদেরই কারুর কারুর জবানবন্দিতে আপনাদের সামনে তুলে ধরি :
নোয়াখালীর নাউলির গোবিন্দপুর গ্রাম । ১৯৪৬ এ সেই গ্রামের এক বৃদ্ধ বাসিন্দার কথায়- আমরা দু-তিনজন হিন্দু একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছি দেখলেই বাঙালি মুসলমানরা আমাদের দেখে টিটকারি দিয়ে ছড়া কেটে বলতোঃ
“ওহে ,পূর্ব পাকিস্তানের বাঁশরী
দেখ বর্ণহিন্দু কথা কয়
হাত ঠারি , মুখ ঠারি”।
১৯৪৬ এর জনৈক লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর জবানবন্দিঃ “আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি । অবাক হয়ে দেখলাম, জ্বালা আমাদের বাড়িতে কাজ করত, তারা হঠাৎ আমাদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করা শুরু করলো । কলকাতা থেকে কোন আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে এলে তাদেরকে তারা বলত, ‘ কিরে কলকাতায় কটা মুসলমান মারলি ?’ এই তুই বলার মধ্যে ছিল ইচ্ছাকৃত অপমানের জিঘাংসা ।”
এইগুলো সমস্তর উল্লেখ আছে ১৯৪৬ এ প্রকাশিত Bengal Press Advisory Committee র রিপোর্টে । নোয়াখালীর বিভিন্ন থানায় Bengal Press Advisory Committee র জমা দেওয়া ডায়রি থেকে জানা যায় যে, নোয়াখালীর সংখ্যালঘু হিন্দু অনেক আগেই স্থানীয় প্রশাসনকে দাঙ্গার আশংকার কথা জানিয়েছিল, অথচ স্থানীয় প্রশাসন রহস্যজনক কারণে নির্লিপ্ত ছিল । নিরাপত্তার কারণে ডায়রীদাতাদের নাম B.P .A .C গোপন রাখে । কিছু ডায়রী আপনাদের সামনে তুলে ধরছি:
➤১৩-৯-৪৬, রামগঞ্জ থানায় জনৈকের ডায়রী বলছে:’রেশন নিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে একদল লোক আমাকে আক্রমণ করে । আমার গ্রামের লোক ওই সময়ে চলে এলে, আমি বেঁচে যাই । কিন্তু হামলাকারীরা যাওয়ার আগে আমাদের শাসিয়ে যায় যে, কলকাতার বদলা ওরা নেবেই, কেউ নিস্তার পাবেনা !’
➤১০-৯-৪৬ নোয়াখালীর সংখ্যালঘু গ্রামবাসীর জেলাশাসককে লেখা আবেদনপত্র :’আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি । কলকাতার দাঙ্গার বদলা চাই বলে এখানে রোজই মিছিল বের করা হচ্ছে । আমাদের দোকান থেকে জিনিস না কিনতে বলা হচ্ছে । আমাদের জবাই করা হবে বলে শাসানো হচ্ছে । আমাদের নিরাপত্তার জন্য গ্রামে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হোক । আমরা গ্রামবাসী হিন্দুরা পুলিশ রাখবার খরচা বহন করবো ।’
➤১৮-৯-৪৬, জনৈকের ডায়রী : ‘ আমাদের জীবন এখানে সুতোর উপর ঝুলছে । আমাদের সবাইকে খুন করা হবে বলে শাসানো হচ্ছে । শুধু হাই কমান্ডের নির্দেশ এখনো আসেনি বলে আমাদের কোতল করা হচ্ছেনা ।’
একদিকে এইভাবে সংখ্যালঘু হিন্দুদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করা হচ্ছিলো আর অপরদিকে নোয়াখালীর গ্রাম গঞ্জে মৌলবীরা ইসলামী প্রচার চালাচ্ছিল এই বলে যে, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে । পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে সকল হিন্দুকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে হবে ।
ওপার বাংলার আরবী পূর্ব পুরুষের গর্বে গর্বিত বাঙালি মুসলমানের ঈমানী জোশ সেদিন ১৯৪৬ এ তুঙ্গে । নোয়াখালীর সংখ্যালঘু হিন্দু সেদিন তাদের কাছে ল্যাবরেটরিতে এক্সপেরিমেন্ট করার করার জন্য আনা ইদুঁরের মত । এই ইঁদুরের জীবনের কোনো দাম তাদের কাছে ছিলোনা । তারা কেবল সংখ্যালঘু হিন্দুর রক্ত ঝরানোর অপেক্ষায় দিন গুনছিল…………………………..!
রেফ: Bengal Press Advisory Committee Riport 1946.
Mclnery Papers. 1976