হায়দ্রাবাদ: ভারত কি হায়দ্রাবাদ, সিকিম বা গোয়া উদ্ধার করেছে নাকি দখল? ভারতের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত হায়দ্রাবাদ, সিকিম এবং গোয়াকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখানে বলে রাখা ভালো বালুচিস্তান ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত আলাদা দেশ ছিল। যা পাকিস্তান ১৯৮৪ সালে দখল করে নেওয়।
*১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হয় সেসময় হায়দ্রাবাদ ছিল একটি প্রিন্সলি স্টেট । অর্থাৎ হায়দ্রাবাদ ইংরেজদের শুধুমাত্র কর প্রদান করলেও একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিরাজমান ছিল। হায়দ্রাবাদের শাসন ব্যবস্থা ছিল নিজামের হাতে। স্বাধীন হায়দ্রাবাদ এর সর্বশেষ নিজামী ছিলেন নিজাম ওসমান আলী খান।
১৯৩৭ সালে আমেরিকার টাইমস ম্যাগাজিন তাকে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয় হায়দ্রাবাদের নিজস্ব ব্যাংকিং এবং ডাক ব্যবস্থার পাশাপাশি নিজস্ব সেনাবাহিনী ও ছিল। সাতচল্লিশ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে হায়দ্রাবাদ সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান না করে বরং তারা স্বতন্ত্র একটি দেশ হিসেবেই থাকবে।
কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিবিদরা এই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেননি। কারণ হায়দ্রাবাদের অবস্থান ছিল ভারতের পেটের ভিতর। স্বাধীন হায়দ্রাবাদকে ভারতের পেটের ‘ক্যান্সার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এ কারনে ভারতের লৌহ মানব সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দ্রুত হায়দ্রাবাদ দখল করার হুকুম দেন।১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন পোলো’ পরিচালনা শুরু করে। ৫ দিনের সংঘর্ষের পর ১৮ সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদের সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং হায়দ্রাবাদ ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়।
*১৯৫০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার পর্তুগিজ সরকারের সাথে আলোচনায় বসে। কারণ গোয়া তখন পর্তুগিজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোগল আমল থেকেই গোয়ায় পর্তুগিজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের স্বাধীনতার সময় এটি যেহেতু ভারতের কোন রাজ্য ছিল না তাই এটিকে অন্তর্ভুক্ত করার কোন অধিকার ভারতের ছিলনা। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিবিদগণ সে সময় ভারতের অংশকে বাহিরের কোন উপনিবেশিক শক্তির অংশিদারিত্ব দিতে চাইছিলো না।
এ কারনে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর গোয়াতে প্রবেশ করে। স্থল,নৌ এবং আকাশপথে একযোগে হামলা চালানো হয়। মাত্র দুই দিনের মাথায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়া দখল করে। পর্তুগিজ বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে গোয়া অভিযান সমাপ্ত হয়।
*এবার আসা যাক সিকিম অন্তর্ভুক্তি। ভারতের ইতিহাসে সিকিম অন্তর্ভুক্তি ছিল সবথেকে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি।
১৯৬২ সালে চীনের কাছ থেকে শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পরে ভারত বুঝতে শুরু করে চীনকে হারাতে হলে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতকে কৌশলগতভাবে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। অর্থাৎ ভারতকে যদি চীনের মোকাবেলা করতে হয় তাহলে এমন জায়গা থেকে রণাঙ্গন পরিচালনা করতে হবে যেখানে ভারত সুপিরিয়র হবে এবং চীনকে কোণঠাসা করা সহজ হবে।
সে সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ছিল অনেক অশান্ত। স্বাধীনতার পর থেকে নাগাল্যান্ডের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ভারতের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল। এদের প্রত্যক্ষভাবে মদত দিচ্ছিল চীন এবং পাকিস্তান। এ কারনে চীনকে মোকাবেলায় ভারতের দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করার তাগিদ দেখা দেয়।
এক্ষেত্রে সিকিমের অবস্থান ভারতের জন্য কিছুটা আশার আলো হয়ে দেখা দেয়। কারণ সিকিমে একমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান করলে সেখান থেকে চীনকে মোকাবেলা করা ভারতের জন্য সহজ হবে। কিন্তু সিকিম ছিলো একটি স্বাধীন দেশ ।
ভারত চাইলেই সেখানে সরাসরি অবস্থান করতে পারত না। তাই ভারত নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সিকিমকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। র এর প্রধান অশোক রায়নার লেখা “ইনসাইড র” বইটিতেও সিকিম অপারেশনের ব্যাপারে অনেক তথ্য দেওয়া রয়েছে।
তার তথ্য মতে ১৯৭০ সালেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা অপারেশন সিকিমের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। এ জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করেছিল সিকিমের প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জিকে।
- কেন ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল? দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রবর্তক আসলেই কি জিন্নাহ?
- মোদিকে সমর্থন করে এমন কোনো মুসলমান আছে কি?
লেন্দুপ দর্জির সহায়তায় ভারত চোগিয়াল রাজবংশের শাসন ক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করতে সফল হয়। ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ লেন্দুপ দর্জি কেবিনেট মিটিংয়ে রাজতন্ত্র বিলোপের প্রশ্নে গণভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অচিরেই চারদিক থেকে গণভোটের ফলাফল আসতে শুরু করে যে, “জনগণ আর রাজতন্ত্র চায়না“। অবশ্য অভিযোগ আছে, পুরো বিষয়টিই ছিল সাজানো।
ভারতীয় সেনাবাহিনী জনগণকে বাধ্য করেছিল রাজতন্ত্রের বিপক্ষে ভোট দিতে। অবশেষে ভারতীয় সংসদ ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত করার সাংবিধানিক সংশোধনীর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। ১৫ মে ১৯৭৫ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ একটি সাংবিধানিক সংশোধনী অনুমোদন করেন যা সিকিমকে ভারতের ২২ তম রাজ্যে পরিণত করে।এর সাথে সমাপ্তী ঘটে চোগিয়ালের রাজতন্ত্রের। বিশ্বের বুক থেকে সিকিম নামের একটি স্বাধীন দেশ হারিয়ে যায়।