রাশিয়ার পক্ষে কেন সম্ভব নয়, চীনের সঙ্গে সামরিক জোট গঠন করা। যারা কথায় কথায় চীন-রাশিয়া সামরিক জোট গঠনের ঘোষণা দেয়, তারা না জানে ইতিহাস, না জানে ভূগোল। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সীমান্ত বিরোধ ও কূটনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস অত্যন্ত পুরানো। এখন পর্যন্ত এমন কোনো নাটকীয় ঘটনা ঘটেনি- যাতে উভয় দেশ সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাবে। তাছাড়া চীন সম্প্রতি রাশিয়ার বিশাল ভূখণ্ডের মালিকানা দাবি করে বসেছে।
বিশ্ব ইতিহাসে রাশিয়ার যে সামরিক বিক্রম প্রদর্শন ও সাফল্যের খতিয়ান – সেই গৌরবের ধারেকাছেও পৌঁছার সুযোগ হয়নি, পৃথিবীর কোন কালের অন্য কোন পরাশক্তির। মধ্যযুগে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পরাশক্তি ছিল তুরস্কের ওসমানিয়া সালতানাত। জার শাসিত রাশিয়ার সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে, তুরস্কের অতুলনীয় পরাক্রমশালী অটোমান শাসকদের একেবারে মেরুদণ্ড ভেঙে যায়; এবং সেই সুযোগে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মিলে, ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে পরাক্রমশালী তুরস্কের সেই অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দুই দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও এডলফ হিটলার, নাকে খত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন- রাশিয়ার কারণে।
মধ্যযুগে ইউরোপের দুই উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি ছিল, পোল্যান্ড-লিথুনিয়ান কমনওয়েলথ ও সুইডেন সাম্রাজ্য। এই দুই আঞ্চলিক শক্তি, পৃথিবীর সর্বাধিক প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী সুবিশাল রাশিয়ার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানোয়, এমন শিক্ষা পেয়েছিল- ওই দুই উদীয়মান সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। সেই রাশিয়ার মালিকানাধীন ভূমি ছিনিয়ে আনা যে মোটেও সহজ কাজ নয়, সে কথা চীন ভালো করেই জানে। তাহলে চীন কেন রাশিয়াকে উত্যক্ত করছে? উত্ত্যক্ত করার একটাই কারণ, ভারতের সঙ্গে সুদীর্ঘ কৌশলগত সম্পর্ক ছিন্ন করে, চীনের দিকে চলে যাওয়া- রাশিয়ার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়।
১৯৪৯ সালের শেষের দিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মাও সে তুং যখন মস্কো সফরে গিয়েছিলেন, তখন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ তাকে যে সম্মান দিয়েছিলেন, তাতে তার মন ভরে নি। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতা হিসেবে মাও সে তুং আরও বেশি সম্মান প্রত্যাশা করেছিলেন। সম্ভবত এই কারণেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি নিকিতা ক্রুশ্চেভ যখন ১৯৫৮ সালে চীনে আসেন, তখন তাকে যথাযথ সম্মান দেয়া হয়নি।
এমনকি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময়, মাও সে তুং কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করেছিলেন এবং অসৌজন্যমূলক ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতার সঙ্গে ক্রুশ্চেভের যৌথ সামরিক প্রকল্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীতে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে,যে সমস্ত সোভিয়েত সামরিক ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টাগণ চীনে অবস্থান করছিলেন, ক্রুশ্চেভ তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নেন। যার ফলে চীনের অবকাঠামোগত অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আমেরিকার ভেটোর কারণে জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করতে ব্যর্থ হয় চীন। এরপর আইয়ুব খানের কাছে দূতিয়ালির জন্য ব্যক্তিগত অনুরোধ নিয়ে আসেন পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত। তার জবাবে পাল্টা অনুরোধ হিসেবে আইয়ুব খান, চীন ও পাকিস্তানের ‘বিতর্কিত’ সীমানা চিহ্নিতকরণে চুক্তি করার প্রস্তাব দেন। চীনা রাষ্ট্রদূত জানালেন,সীমান্ত সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। তার জবাবে আইয়ুব খান জানালেন ‘সীমানা চিহ্নিতকরণ যদি জটিল হয়, তাহলে জাতিসংঘে চীনের সদস্য হওয়াও জটিল।
আইয়ুব খান গর্ব করে ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার’-গ্রন্থে লিখেছেন- তার যুক্তিতর্কে চীনা রাষ্ট্রদূত খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, চীনের সৈন্য সমাবেশ দেখে আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান, ভয় পেয়ে খাইবার গিরিপথ-এর বিশাল ভূখণ্ড চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া, তার কমিউনিস্ট মিত্র চীনকে ছেড়ে ভারতকে সমর্থন দিলে, দুই দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। ক্ষুব্ধ মাও সে তুং, ১৯৬৪ সালে মস্কোর সঙ্গে চীনের সমস্ত কূটনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করেন এবং মস্কোতে কর্মরত চীনা কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেন। সেই সাথে রাশিয়ার অধীনে থাকা বিতর্কিত এলাকার মালিকানা দাবি করে বসেন। সামরিক সংঘাত এড়াতে দুই পক্ষ অনেকবার আলোচনার টেবিলে বসলেও, সবগুলো আলোচনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৯৬৮ সালে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উশুরি নদীর উভয় পাশে, দুই দেশের প্রায় দেড় মিলিয়ন সৈন্য অবস্থান নিলে, দুই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ২ মার্চ, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি, ঝেনবাও দ্বীপে সোভিয়েত সীমান্ত ফাঁড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়। এই ঘটনা থেকে চীনা-সোভিয়েত বিশাল সীমান্তজুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে- যা দুই দেশকে প্রায় সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। যুদ্ধের পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা পর্যন্ত জেগেছিল। প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, সেই যুদ্ধে ৬০ জন সোভিয়েত সৈন্য এবং ৮০০ চাইনিজ সৈন্য নিহত হয়েছিল।
চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সর্ম্পক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন, আইয়ুব খানের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। যদিও ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ও চীন তাদের সীমান্ত এলাকা চিহ্নিত করে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে- যে চুক্তির ফলে পাকিস্তান, দু’হাজার বর্গমাইলেরও অধিক ভূমির মালিকানা স্থায়ীভাবে হারায়। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘Myth of Independence’- গ্রন্থে ভূট্টো, কেনেডি প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতার সমালোচনা করেন।
তিনি যুক্তি দেখান, ‘আমেরিকা যদি চীনের উত্থানে ভীত হয়ে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখায়, তাহলে সেটা পাকিস্তানের জন্য অবমাননাকর। পাকিস্তানের উচিত ভারত- আমেরিকা ঘনিষ্ঠতাকে ভেঙে দিয়ে নতুন পথ খোঁজা’। বলাই বাহুল্য সেই পথ হচ্ছে চীন।
১৯৭১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক অদূরদর্শীতায়, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। এই সুযোগে আমেরিকার সহায়তায় চীন- ভেটো পাওয়ারসহ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়, চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। চৌ-এন লাই ঐ নিবন্ধে লিখেছিলেন, “পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণের দুঃসাহস দেখায়, তাহলে চীন ও তার জনগণ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে।”
পাকিস্তানের প্রতি চীনের সবচেয়ে বড় সাহায্য আসে জাতিসংঘ থেকে। সদ্য স্থায়ীসদস্যপদ প্রাপ্ত চীন নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে বিতর্কে অংশ নিয়ে জোরালো ভাষায় ‘তথাকথিত বাংলাদেশের’ প্রতি তীব্র ও কর্কশ ভাষায় আক্রমণ চালায়।জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে- ১৯৩১ সালে অধিকৃত চীনের মানচুকো প্রদেশে, জাপান যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা চালিয়ে ছিল, তার সঙ্গে তুলনা করেন। হুয়াং হুয়া অভিযোগ করেন, “ভারত পাকিস্তানকে বিভক্তি করে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।” শুধু তাই নয়, তিনি বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের নিকট পাকিস্তান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার পরেও, চীন ‘বাংলাদেশ বিরোধীতা’ বন্ধ করেনি। জাতিসংঘে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও সদস্য লাভের বিরোধিতা করে, চীন তিন-তিনবার ভেটো দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি চীন। সেই চীন- বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু বনে যাওয়ার মানে এই নয় যে, চীনের বন্ধু হয়ে গেছে রাশিয়া।
বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের লুঙ্গি খুলে দিয়েছিলো।
ভারত-মিয়ানমার মিলিটারি টাইজ, বনাম চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব – কৃত্তিবাস ওঝা
আইএস জিহাদীরা কি সুরা নিসার ২৪ নং আয়াত বাস্তবায়ন করেছে?
‘হিন্দু’ নোবেল পেয়েছে এরকম লিস্ট করা হলে আমরা এই বঙ্গবাসীরাই নির্ঘাৎ তাকে সাম্প্রদায়িক বলব।
আরো একবার প্রমাণ হলো বাংলার নিজস্ব্ যা তার সবই ‘হিন্দুয়ানী’!