মন্দিরে হামলা

খুলনায় হিন্দু মন্দিরে হামলা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত কি?-সুষুপ্ত পাঠক

খুলনায় হিন্দু মন্দিরে হামলা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত কি? খুলনায় এই যে বড় রকমের সাম্প্রদায়িক আক্রমন ঘটলো, আজকের একজন নাগরিক এই পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক দেশভাগকে যদি মূল্যায়ন করতে বসে তাহলে বহু পন্ডিতের বহু তত্ত্ব মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা- সহ সমগ্র যশোর অঞ্চল বাংলাদেশের এই এলাকাগুলি ছিলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ।

খুলনায় হিন্দু মন্দিরে হামলা

নিয়ম অনুসারী এগুলো ভারতের ভাগে পড়েছিলো। আবার মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি হওয়ার পরও ভারতের ভাগে পড়ল। মালদা হিন্দু মুসলমান সমান সমান হওয়ায় ভাগ করে ভারত পাকিস্তানকে দেয়া হলো। দিনাজপুরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ভাগ করে পাকিস্তানে দেয়া হলো, আর জলপাইগুড়ি দার্জিলিং ভারতে যোগ দিল।

মুর্শিদাবাদ, মালদা বা দিনাজপুরে দেশভাগের সময় কোন রকমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেনি। তবু সেখান থেকে মুসলমানরা পাকিস্তানের খুলনা অঞ্চলের বসবাস শুরু করে। প্রায় বিশ লাখ মুসলমান দেশভাগের সময় এসব অঞ্চলে এসে নতুন করে বসবাস শুরু করে। তাদের কোন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে উঠতে হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে এরকম কোন ক্যাম্পের অস্তিত্বই ছিলো না।

উল্টো দিকে বরিশাল, হিজলা, নোয়াখালী, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাটসহ পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যায় সরকারী হিসেবে যাদেরকে ৮৫ লাখ বলা হয় যারা বেসরকারী হিসেবে সংখ্যায় অনেক, তাদের সকলের স্থান হয় রানাঘাটের কুপারস ক্যাম্প, ধুবুলিয়া ক্যাম্প, অশোকনগর ক্যাম্প, বিজয়গড় ক্যাম্প। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ট্রমা নিয়ে এই মানুষগুলি দেশ হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো।

তাই খুলনা বাগেরহাটে আসা মুসলমান আর রানাঘাটে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া হিন্দুদের দেশভাগের অভিজ্ঞতা এক নয়। দেশভাগ যদি হিন্দুর জন্য বেদনার হয় মুসলমানের জন্য সেটি শাপেবর। এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সাহিত্যে দেশভাগ স্থান পায়নি।

আলোচনাটা যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, খুলনা রূপসার লোকজন যদি এখন মনে মনে আফসোস করে কেন তারা দেশভাগের সময় ভারতে পড়ল না তাকে ঐতিহাসিকভাবে কিভাবে মোকাবিলা করবেন? ‘অখন্ড বাংলাদেশ’ স্বাধীনের জন্য শরত বসু ও সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টা যদি সফল হত তাহলে বাঙালী হিন্দুদের পরিণতি কি হত? খুলনা বাগেরহাটে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও খান এ সবুর কি করে হিন্দুদের জন্য ত্রাস হতে পারে?

কারণ হিন্দুরা যেখানে সম্প্রদায় ও নানা ভাগে বিভক্ত সেখানে মুসলিমরা ধর্মগতভাবে মুসলিম পরিচয়ে এক ধরণের আবেগময় জাতিসত্ত্বায় বিশ্বাস করে। যদিও সেটি ভুল ও অবৈজ্ঞানিক। পাকিস্তান ভেঙ্গে গিয়েছিলো বাঙালী জাতীয়তাবাদের কাছে মুসলিম জাতীয়তাবাদ পরাজিত হয়ে। কিন্তু তারপরও বাঙালী মুসলমানের কাছে ধর্মগত কারণেই মুসলিম জাতীয়তাবাদ চর্চিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যত কি? দেশভাগের সময় মুসলিম লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মুসলমানরা ধরেই নিয়েছিলো পশ্চিমবঙ্গ আসাম নিয়েই পূর্ব পাকিস্তান হবে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হবে কোলকাতা। “পাকিস্তান” আন্দোলন ছিলো ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমানের নিজস্ব দেশ নির্মাণের সেখানে পশ্চিমবঙ্গ আসাম নিয়ে পাকিস্তান গঠনের পর হিন্দু মুসলমানদের পরিণিত কি হবে সেকথা কেউ না বললেও যদি পাকিস্তানের ২৩ বছর দেখি সেটার ভবিষ্যত স্পষ্ট হয়।

পাকিস্তান আন্দোলন মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুদের কথিত ছোট জাত ও বিভিন্ন আদিবাসীরাও যোগ দিয়েছিলো। তাদের পরিণতি কি হয়েছিলো সেটা জানতে ৫০, ৬৪, ৬৫, ৭১ সালের ইতিহাস ঘাঁটলে বুঝা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও সাম্প্রদায়িক চোখ রাঙানী এতটুকুও কমেনি। যদি মুসলমানদের অধিনে পাকিস্তানে কোলকাতা আসাম ভালো থাকবে তাহলে আদমজীতে তফসিলি হিন্দুদের লাশ পথে ঘাটে কেন পড়েছিলো? পাকিস্তানের আমলের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশে ৯০ এর হামলাসহ গত ৫০ বছরের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আমাদের সামনে কি সত্য সামনে নিয়ে আসে?

আমি দেশভাগের পক্ষে কখনোই ছিলাম না আজো নেই। দেশভাগের কথা উঠলে ‘অখন্ড বাংলা’ বলে যে ইতিহাসের ছোট্ট পরিস্থিদের কথা চলে আসে তার বাস্তবতা কতটুকু আমি কেবল সেরকম কিছু প্রশ্ন তুলি। এই যে খুলনার রূপসায় সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটল এ মধ্যে কি দেশভাগের বির্তক নাই? ‘বাংলা আমার আসাম আমার ত্রিপুরা আমার এইগুলি না পাইলে আমার বাংলাদেশ পরিপূর্ণ হবে না’ ভাষানী এই আক্ষেপ কি মানুষ নাকি মাটির জন্য? ইতিহাস কিন্তু ভাষানীর হয়ে জবাব দিয়েই যাচ্ছে…।

-সুষুপ্ত পাঠক
#সুষুপ্তপাঠক