পূর্ববঙ্গ ও গান্ধীজি: গান্ধীজির নামের আগে তিনি ‘মহাত্মা’ কথাটি লিখতে কখনোই রাজী হন নি। “ঢাকার হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষই বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ’র মধ্য দিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষার কৌশলটা বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করে, নিজেদের শুধু রক্ষাই করেন নি, প্রতিপক্ষকে চরম আঘাতও হেনেছেন।
হিন্দুরাও যে সেদিক দিয়ে মুসলমানের খুব একটা পেছনে ছিলেন, তা মোটেই না। তার প্রমাণ আমরা দেখেছি ঢাকার নবাবপুরে রাস্তার পাশে একেবারে জেলা-কোর্টের গায়ে লাগা একটা মসজিদের ভাঙা স্তুপ দেখে।
ঢাকার হিন্দুরাও ছিলেন বেপরোয়া ও অকুতোভয়। কিন্তু দেশ বিভাগ, তথা পাকিস্তান সৃষ্টির এই আড়াই বছরের ও কিছু কম সময়ের মধ্যেই হিন্দুর সেই সাহস – সেই মনোবল একদম ভেঙে গিয়েছে। আমরা ঢাকায় থেকে ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় যা দেখেছি তাকে “দাঙ্গা” বলা ঠিক নয়। সেটা হয়েছিল একতরফা হিন্দু-গৃহ-লুন্ঠন ও হিন্দু হত্যা। [‘দাঙ্গা’ হয় উভয় পক্ষের সংঘর্ষে, এই দাঙ্গায়]। পরবর্তী কালে আমরা শুধুই দেখেছি একতরফা আক্রমণ; অপর পক্ষর কোন প্রতিরোধ তো ছিলই না – প্রকাশ্য প্রতিবাদে তাঁদের মুখর হতেও শুনিনি।
এই পরাজিত মনোভাব যে হিন্দুদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তার জন্য দায়ী কে? ঢাকার সাধারণ হিন্দুরা, না কংগ্রেস নেতারা যাঁরা সাম্প্রদায়িকতার কাছে পরাজয় স্বীকার করে দেশ বিভাগ মেনে নিয়েছিলেন? আমার মতো স্বাধীনতা সংগ্রাম র একজন ক্ষুদ্র সৈনিক র পক্ষে এই প্রশ্ন র উত্তর দেওয়া চূড়ান্ত ধৃষ্টতা ই হবে; তাই, আমার মতামত এখানে তুলে ধরতে ক্ষান্ত থেকে ভবিষ্যত ঐতিহাসিকদের উপর ই এই প্রশ্ন র মীমাংসার ভার ছেড়ে দিয়ে রাখলাম।
১৯৫০ সালের দাঙ্গায় দেখেছি হিন্দু এলাকা বলে পৃথক সত্বার অস্তিত্ব একেবারে লোপ পেয়ে গিয়েছিলো। দাঙ্গাকারিরা আমাদের বাসা র দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছিলো কিন্তু রাস্তার মধ্যে হিন্দু বাড়ি লুট করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেদিন র মতো তারা লুট র মালপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। ইতিমধ্যে আমরা খবর পাই এস-ডি-ও শ্রী ধীরাজ ভট্টাচার্য মহাশয় র বাসার আশেপাশে আক্রমণ চলতে থাকায় তিনি সপরিবারে গিয়ে ওঠেন একটি আশ্রয় শিবিরে।
সাময়িকভাবে তখন ই একটা আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছিল। গেন্ডারিয়া অঞ্চলেই তখন ঢাকার প্রখ্যাত নেতা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ছিলেন। তাঁর বাড়িও আক্রান্ত হয়েছিল। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, অন্তত এই অঞ্চলে যিনি আক্রমণকারীদের সামনে সিংহ-গর্জনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাঁর প্রতিরোধশক্তি দেখে আক্রমণকারীরা পিছিয়ে যায়। এই শ্রীশবাবু র রাজনৈতিকজীবন শুরু হয় পূর্ববঙ্গে ‘অনুশীলন সমিতি’ র স্রষ্টা পুলিনবিহারী দাশ মহাশয় র সহকর্মী হিসাবে। তিনি ঢাকার উকিল ছিলেন এবং বিপ্লবী কর্মীদের বহু মামলায় তিনি আসামিপক্ষ র সমর্থনে বরাবর এগিয়ে গিযেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ র সময়ে আসাম র গৌহাটি শহরে ফেরারী বিপ্লবীদের সাথে পুলিশ র যে খণ্ডযুদ্ধ হয় এবং যার ফলে আমরা ৫ (পাঁচ) জন ধৃত হই – আমি পুলিশ র গুলিতে আহত হয়ে কামাখ্যা পাহাড় র উপরে ধরা পড়ি এবং সেই ঘটনাকে অবলম্বন করে যখন আমাদের তত্কালীন ভারতরক্ষা আইনে ‘স্পেশ্যাল ট্রাইবুনাল’ বিচার হয়।
তখন সেই মামলায় কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার শ্রী এস.এন.হালদার ও ঢাকা থেকে শ্রীশবাবু আমাদের পক্ষ সমর্থন করতে যান। শ্রীশবাবু বরাবরই ছিলেন অত্যন্ত নির্ভীক। ১৯২১ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয় ই তাঁকে গান্ধীজি পরিচালিত কংগ্রেস র নেতৃত্বে নিয়ে আসেন।
তিনি গান্ধীজি পরিচালিত কংগ্রেসে আসেন বটে এবং জীবন র শেষ দিন পর্যন্ত (তিনি কিছুকাল আগে পশ্চিম বাংলায় এসে ৯১ বছর বয়সে পরলোকগমন করেছেন) যদিও কংগ্রেসেবীই ছিলেন তবু তিনি কোনও দিনই গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ বলতেন না। আমার রচিত – “India Partitioned and Minorities in Pakistan” ইংরাজি বইখানি র ভূমিকা তিনি ই লিখেছিলেন।
তাতেই, গান্ধীজির নামের আগে তিনি ‘মহাত্মা’ কথাটি লেখেন নি – আমি বলা সত্বেও তিনি লিখতে রাজী হন নি। এইরকম ই একরোখা তিনি বরাবর ই ছিলেন। এইটেই ছিল তাঁর চরিত্র ও স্বভাব র বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই তিনি লিখতে রাজী হন নি। এই বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই তিনি সেদিন তাঁর বাড়িতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।” (পাক-ভারতের রূপরেখা – শ্রী প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ী)
শ্রী শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্রী প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ী যৌবনে ‘অনুশীলন সমতী র সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা কংগ্রেসে যোগ দেন বিল্পবী বিচারধারা অক্ষুন্ন রেখেই। শ্রী পুলিনবিহারী দাশ র সুযোগ্য সহকারী হিসেবে তাঁরা সমগ্র পূর্ব বাংলায় অক্লান্ত পরিশ্রমে, নিষ্ঠায়, স্বীয় অর্থ খরচ করে আখড়া পর আখড়া গড়ে তোলেন যা বাঙালী হিন্দু প্রতিরোধ র সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত।
প্রভাষ বাবু পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেস র সদস্য হিসেবে কিছুকাল পূর্ব পাকিস্তান র অর্থমন্ত্রী ছিলেন, শ্রীশবাবু পাকিস্তান পার্লামেন্টে র সদস্য হন। তাঁর সঙ্গে লিয়াকত আলী র বিতর্ক পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু পরিস্থতি নিয়ে এখনো পাকিস্তান পার্লামেন্টে archive করা আছে। ১৯৬৪ সালে যখন হিন্দু গণহত্যা র রক্তস্রোতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান প্লাবিত তখন ঢাকার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা পায় শ্রী হরিদাস ঘোষ (মিঃ ইস্ট পাকিস্তান) ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্যদের জন্য।
শ্রী হরিদাস ঘোষ, ঢাকায় যে দুটি আখড়ায় ব্যায়াম করতেন তাদের একটি একসময় শ্যামাকান্ত বন্দোপাধ্যায় ও শ্রী পরেশনাথ ঘোষ (দুই প্রখ্যাত বাঙালী হিন্দু মল্লবীর) র আর একটি ছিল শ্রী অধর ঘোষ (প্রখ্যাত বাঙালী হিন্দু কুস্তিগীর) র – কালের নিয়মে দুটি ই জরাজীর্ণ, প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
হরিদাস বাবু অলকান্ত পরিশ্রম র দ্বারা সেগুলিকে আবার চালু করেন। ১৯৪৬ সালে, অনুরূপভাবে, ব্যায়াম ও যোগাচার্য শ্রী বিষ্ণুচরণ ঘোষ র শিষ্যরা মধ্য কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মরণপণ সংগ্রামে নামে – যাঁর দরুণ মীনা পেশোয়ারী বা বোম্বাইয়া বা খিদিরপুর র শেখ বাবু বা তালতলা র বসু মিঞা র নেতৃত্বাধীন মুসলিম গুন্ডারা দাঁড়াতে পারেনি।
বর্তমানে বহু জনকে দেখা যাচ্ছে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব র মধ্যে সমাগত – হিন্দু সংহতি কতটা তৃণমূল কংগ্রেস র বি টিম ও তাদের দালাল বা বিজেপি কতটা হিন্দুত্ব ভাবনা থেকে দূরে। দিনের পর দিন আমরা এই দ্বন্দ্বে valuable time and energy নষ্ট করছি।
অথচ রাজনীতি যা স্বার্থ স্থাপন র এক চেষ্টা – কখনো ই একমাত্রিক নয় – তা বহুমাত্রিক। বহু factors – ব্যক্তিগত, শ্রেণী ও সম্প্রদায়গত স্বার্থ (যার মধ্যে অন্যতম) সম্বলিত। তাঁর সঙ্গে আছে সম্প্রদায়গত স্বার্থে নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলন র প্রচেষ্টা।
একটি স্থানীয় বিষয়কে তীব্র গণ-আন্দোলন র মাধ্যমে তাকে এক অসামান্যতায় রূপান্তরিত করা ও সরকার বাহাদুর র বিরুদ্ধে এক প্রতিস্পর্ধা তৈরী করা – তার ভিত মাত্র। তার সঙ্গে প্রয়োজন জ্ঞানান্বেষণ এবং এই দুটি র সংযোগই একমাত্র বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন করতে সক্ষম।
বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে গেলে লড়াই র ইতিহাস (annals)র প্রয়োজন – এর অব্যর্থতা গত হাজার বছর র ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় এবং প্রত্যেক ভাবাদর্শ র ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের – হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের – ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হবে না।
যদি না করি, আজ যখন এই বাংলায় হিন্দু র সর্বনাশ র প্রত্যেক অস্ত্র ই মজুত – তখন প্রতিহত না করতে পারলে আমাদের প্রত্যেকের দশাই শ্রী চিত্তরঞ্জন দত্তরায়চৌধুরী র মতো – যিনি ১৯৪৬ সালের অক্টবর মাসে নোয়াখালী র শায়েস্তানগরে প্রায় দু-ঘন্টা একনাগাড়ে বন্দুক নিয়ে মুসল্লি আক্রমণকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর আর কোন আশা নেই দেখে প্রথমে নিজেকে মাতাকে হত্যা ও তারপর আত্মহত্যা করেন – অবস্থা হবে। আসুন আমরা প্রত্যেকেই শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রী হরিদাস ঘোষ র নব সংস্করণ হয়ে বাঙালী হিন্দু র অস্তিত্ব র এই চরমতম সঙ্কট র দিনে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
সৌজন্যেঃ শ্রী Animitra Chakraborty…
আর পড়ুন……