পতঞ্জলির যোগসূত্র: পতঞ্জলি কি সেই সুপ্রাচীন কালেই মনোবিজ্ঞান চর্চার পথটি উম্মোচন করলেন না? প্রাচীন ভারতবর্ষের সভ্যতার দ্রাবিড় শিকড়টি নিহিত হরপ্পা-মহেঞ্জদারো সভ্যতায়। ওই সভ্যতা প্রধান দেবতা ছিলেন শিব। শিবের এক বৈশিষ্ট্য হল ধ্যান। যে কারণে বলা হয় ধ্যান ও ভক্তি হল ভারতীয় চিন্তাধারায় উপাদান। আর্যরা প্রাচীন ভারতের চিন্তাধারায় যুক্ত করে ঈশ্বরতত্ত্ব, যে ঈশ্বরতত্ত্ব আর্যদের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদে প্রতিফলিত।
যোগ কি?
এক কথায় যোগ হল আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে শারীরিক এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ। তবে যোগ বলতে আমরা কেবল আসন বা যোগব্যয়াম বুঝি। এই ধারণা অতীব ভ্রান্ত। কেননা আসন বা যোগাসন যোগশাস্ত্রের একটি অংশ মাত্র। বস্তুত, যোগ হল এক আধ্যাত্মিক দর্শন । যার উদ্দেশ্য ঈশ্বরে সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে সৎ ও সুন্দর মানুষ তৈরি করা। ইসলামী সুফিদেরও লক্ষ্যও কিন্তু অভিন্ন। পাঠ করুন: When
the Ṣūfī succeeds in purifying himself entirely of the earthly world and loses himself in the love of God, it is said that he has “annihilated” his individual will and “passed away” from his own existence to live only in God and with God.যোগের উদ্দেশ্য সঙ্গে বিশিষ্ট সংস্কৃত পন্ডিত Chester Messenger লিখেছেন: Yoga means Union and the purpose is to teach the practitioner of Yoga,
called the Yogi, how to achieve Union or Spiritual Absorption into the Supreme Absolute or God. Yoga teachs us that our true self is the soul and that our self identity is an illusion to be overcome.
কিন্তু, যোগ কি শিক্ষা দেয়? এ প্রসঙ্গে কণকপ্রভা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘ত্রিগুণা প্রকৃতির পরিণাম এই সংসারে সকলই সুখ, দুঃখ ও বিবাদের আকর। পুরুষ তত্ত্ব নির্লেপ। কিন্তু অবিবেকহেতু প্রকৃতির সঙ্গে আপন তাদাত্ম্য কল্পনা করে তার দুঃখভোগ হয়। এই দুঃখকে পরিহার করার একমাত্র উপায় তার উৎপত্তির মূলটি খুঁজে বার করে তাকে বিনষ্ট করা। যোগশাস্ত্র সেই শিক্ষাই দেয়।’ (সাংখ্য-পাতঞ্জল দর্শন। পৃষ্টা ৫৫।)
তাহলে যোগের উদ্দেশ্য হল ভবসংসারের দুঃখকে এড়িয়ে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ? প্রাচীন ভারতবর্ষে যোগ সম্বন্ধে এমনই ধারণা প্রচার করেছিলেন মহাঋষি পতঞ্জলি। কিন্তু এমন ধারণা পতঞ্জলি কেন প্রচার করেছিলেন ?
মহাঋষি
পতঞ্জলির জীবন সম্বন্ধে জানা না গেলেও তাঁর সময়কাল ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব বলে অনুমিত হয়। একটি সূত্রে উল্লেখ রয়েছে পতঞ্জলির পিতার নাম আত্রি এবং মায়ের নাম অনুসূয়া। এরা বাস করতেন কৈলাস। যাই হোক। পতঞ্জলির সময়ে ভারতবর্ষে মৌর্যদের শাসন চলছিল। রাষ্ট্রক্ষমতাটি ছিল, আজকের মতোই, রাজকীয় অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে। মুষ্টিমেয়র সুখের নিমিত্তে ভূমিপুত্রদের ওপর অধিক করারোপ। নগর ও গ্রামের সাধারণ মানুষ লোভের যূপকাষ্ঠে বলি। এরও কিছুকাল আগে- অর্থাৎ বৌদ্ধযুগের সমাজেও অনুরূপ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। মানুষের জীবন ছিল দুঃখেকষ্ঠে ভারাক্রান্ত । এ বিষয়ে
Kim Knott তাঁর Hinduism A Very Short Introduction বইতে : Anyone who knows the story of the Buddha will be aware that early Indian society in his time was viewed by a spiritual seeker as a place of misery and unrest. Happiness was transitory, to be replaced all to soon by ageing, disease, and death.As scholars have shown, it was
also a time of social and political change, with towns growing up and the agrarian lifestyle and its social organization being eroded.(page,36)
এহেন বিরূপ পরিস্থিতিতে চিন্তাশীল পতঞ্জলি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি অবশ্য মানুষকে সমাজবিপ্লবের পথ দেখালেন না। বরং আত্মিক সংস্কারের মুক্তির পথ নির্দেশ করলেন। পতঞ্জলি কি escapist ছিলেন? তিনি কি উপলব্দি করেছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা যে রাজকীয় অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে তাদের শোষন থেকে নিম্নকায় ভূমিপুত্রদের রেহাই নেই যখন তখন রাষ্ট্রক্ষমতার কাছাকাছি না থেকে বরং মানসিক শান্তির জন্য ভিন্নপথ ধরাই শ্রেয়? বাংলার ভাটি অঞ্চলের বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমও কি ওই একই কারণে escapist ছিলেন? কেননা,”আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটিতে তিনি কেন লিখলেন?
বর্ষা যখন হইত/গাজীর গান আইত/ রঙেঢঙে গাইত/ আনন্দ পাইতাম/ কে হবে মেম্বার/ কে-বা গ্রামসরকর/ আমরা কি তার খবর লইতাম হায়রে? যা হোক। পতঞ্জলি ১৯৪ যোগসূত্র সঙ্কলন করে রচনা করলেন এক যুগান্তকারী গ্রন্থ: যোগসূত্র । যা আজ বিখ্যাত একটি গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। পতঞ্জলি কর্তৃক গ্রথিত যোগসূত্রটি চারটি পদে বা অধ্যায়ে বিভক্ত। এই পদসমষ্টি হল: সমাধি, সাধনা, বিভূতি এবং কৈবল্য।
আমাদের মনে রাখতে হবে প্রাচীন ভারতে বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চার বিরোধী। যে জ্ঞান মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে না সে ধরণের বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতি প্রাচীন ভারতের মণিষার আগ্রহ ছিল না। তারা মনে করতেন: জ্ঞানই মুক্তি। পক্ষান্তরে ইউরোপের প্রাচীন চিন্তাবিদেরা মনে করতেন জ্ঞানই শক্তি।
ইউরোপ আজ জ্ঞানের সে শক্তিতে বাইরের দিক থেকে বদলেছে ঠিকই তবে তার আত্মার
যথার্থ সংস্কার আজও হয়নি। এ কারণে পতঞ্জলির যোগসূত্রটি ঘিরে ইউরোপে আজ এত
কৌতূহল এত আগ্রহ। যোগ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বইটিই পন্ডিত Ernest Wood -এর লেখা। সে যাই হোক। পতঞ্জলি যোগসূত্রের শুরুতেই বললেন: Human unhappiness results from man’s acceptance of a state of servitude to the low condition of his own mind.(Ernest Wood Yoga; page 11.)
এই উক্তির মাধ্যমে পতঞ্জলি কি সেই সুপ্রাচীন কালেই মনোবিজ্ঞান চর্চার পথটি উম্মোচন করলেন না? পতঞ্জলি কেবল যোগসূত্রই রচনা করেন নি তিনি বিখ্যাত বৈয়াকরণিক পানিনির অষ্টাধ্যয়ী গ্রন্থের একটি ভাষ্যও রচনা করেছেন। সেই সঙ্গে পতঞ্জলি আয়ুবের্দ শাস্ত্রের ওপর বই লিখেছেন ।
আমরা জানি যে, যে যোগ সাধনা করে সে যোগী। একজন যোগীকে কৈবল্য (মুক্তি) লাভ করতে হলে বিভিন্ন স্তরের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। পতঞ্জলি যোগসূত্রে সেরকম স্তর নির্দেশ করেছেন। একে বলা হয় অষ্টাঙ্গ । যোগসূত্রের দ্বিতীয় পদে অর্থাৎ সাধনা পদে অষ্টাঙ্গের বর্ণনা রয়েছে। অষ্টঙ্গ হল: যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রতিহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি।
যম- অহিংসা সত্য আস্তেয় ব্রহ্মচর্য অপরিগ্রহ -এই ৫ ভাগে বিভক্ত।
অহিংসা হল জীবিত প্রাণীর প্রতি হিংসা পোষন না করা। সত্য হল সদা সত্য কথা বলা এবং সত্যে অটল থাকা। আস্তেয় হল লোভ না করা; ব্রহ্মচর্য হল নিষ্কাম জীবনযাপন করা। এবং
অপরিগ্রহ হল কোনও কিছুর অধিকারী না হওয়া। নিয়ম – শৌচ, সন্তোষ, তাপস, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রনিধান- এই ৫টি ভাগে বিভক্ত। শৌচ হল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা; সন্তোষ হল সর্বদা সন্তুষ্ট থাকা; তাপস হল মন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সংযমী হওয়া। স্বাধ্যায় হল নিয়মিত ধর্মীয় শাস্ত্র অধ্যায়ন করা।
এবং ঈশ্বরপ্রনিধান হল ঈশ্বরের কাছে পরিপূর্ণরূপে আত্বসমর্পন করা। আসন হল এক ধরনের শারীরচর্চা ; এর উদ্দেশ্য হল শক্তি সংরক্ষণ। আসনসাধনায় অঙ্গপ্রতঙ্গ সুগঠিত হয় ও স্নায়ূ সুস্থ থাকে । কয়েকটি আসনের নাম হচ্ছে: শবাসন, শীর্ষাসন ইত্যাদি।
প্রাণায়াম মূলত শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ। এর আগের এক পোস্টে আমি বলেছিলাম যে ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে বাংলার বাউলগানের একটা সম্পর্ক রয়েছে।Maqsoodul Haque (ঢাকা ব্যান্ডের মাকসুদ) এর Bauliana Worshiping the great God in man বইয়ের কয়েকটি লাইন পড়ে আমার সেরকমই ধারণা হল।
কেননা, ওই বইতে মাকসুদ লিখেছেন `Yoga taught us proper breathing thousands of years ago …this deliberation on breathing is essential in our real underatanding after
translation of the word Baul. (page 5) পতঞ্জলিনির্দেষত প্রাণায়াম এবং বাংলার বাউলের সম্পর্কের বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রতিহার হল Withdrawal of senses from their external objects. এর মানে কি? বহিস্থ বস্তু থেকে ইন্দ্রিয় অপসারণ কী ভাবে সম্ভব? যাই হোক। ধারণা হল চিত্তকে (মনকে?) কোনও বস্তুর ওপর নিবিষ্ট করা। এই যেমন প্রদীপের আলো কিংবা দেবতার ছবি। এতে চিত্ত স্থির এবং মন শান্ত হয়।
ধ্যান অর্থ কোনও কিছুতে একাগ্র মনোনিবেশ করা। এক কথায় ধ্যান হল Undisturbed flow of thought around the object of meditation (pratyayaikatanata).তবে The act of meditation and the object of meditation remain distinct and separate. সমাধি হল আরাধ্যবস্তুতে বা ধারণায় বিলীন হয়ে যাওয়া। উপাস্যের সঙ্গে একাত্ম বোধ করা। পতঞ্জলির সমাধির ধারণা বৈষ্ণবদের প্রভাবিত করেছে কিনা এই প্রশ্নটি উঠতেই পারে। রাধা কৃষ্ণসমুদ্রে বিলীন হতে চায়। কৃষ্ণই তো রাধার আরাধ্য।
পতঞ্জলির সমাধির ধারণাটির সঙ্গে ইসলামি সুফিদের ফানার ধারণার সাদৃশ্য রয়েছে। ফানা সম্বন্ধে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা লিখেছে, fana, Arabic Fanā, ʾ (“to pass away,” or “to cease to exist”), the complete denial of self and the realization of God that is one of the steps taken by the Muslim Ṣūfī (mystic) toward the achievement of union with God.Fana may be attained by constant meditation and by contemplation on the
attributes of God, coupled with the denunciation of human attributes.
মহাঋষি পতঞ্জলির সময়কাল ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব বলে পতঞ্জলির সময়কাল জৈন্য ও বৌদ্ধ যুগের পরে। কাজেই পতঞ্জলির যোগসূত্রে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। যেমন যোগসূত্রের সমাধির ধারণা অনেকটা বুদ্ধকথিত নির্বান-এর মতো । কেবল তাই নয়- দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাবার উদ্দেশ্যে বুদ্ধ অস্টাঙ্গিক মার্গ বা ৮টি মহান পথের কথা বলেছেন। যাম ধারণাটি একান্তভাবেই জৈনদের । জৈনধর্মের ২৪ তম তীর্থঙ্কর মহাবীর ‘চর্তুযাম’ প্রচার করেছেন, যার অন্তর্গত অহিংসা, আস্তেয় এবং অপরিগ্রহ।
এভাবে ভারতীয় চিন্তাধারায় ‘অহিংসা’র ধারণাটি মহাবীরেরই গভীর অবদান বলা যেতে পারে। উল্লখ্য,কুড়ি শতকে অহিংস আন্দোলনের জন্য বিশ্বময় শ্রদ্ধেয় মহাত্মা গান্ধীর জন্ম একটি জৈন পরিবারে। যদিও তিনি বেদান্ত দর্শনে বিশ্বাস করতেন। পতঞ্জলির ওপর জৈন-বৌদ্ধ প্রভাব সত্ত্বেও তাঁর সঙ্কলিত যোগসূত্রটি বিগত ২৩০০ বছরে বিশ্বময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বর্তমানেও গ্রন্থটির প্রতি জিজ্ঞাসু মানুষের গভীর আগ্রহ বিদ্যমান । পতঞ্জলির যোগসূত্রটি ঘিরে ইউরোপে গভীর আগ্রহের কারণটি পূর্বেই বলেছি।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত জ্যোতিষী মহাজাতক আজও তাঁর শিষ্যদের যে মেডিটেশন-এর কলাকৌশল শেখাচ্ছেন সেই সমস্ত কলাকৌশলের মধ্যেও রয়েছেন মহাঋষি পতঞ্জলি এবং তাঁর ১৯৪টি সূত্র সম্বলিত যোগসূত্র …যে যোগসূত্রটি মহাঋষি পতঞ্জলি প্রাচীন ভারতের এক অন্ধকার অধ্যায়ের বিপর্যস্ত মানুষের কল্যাণে সংকলিত করেছিলেন … আজ তাই বিশ্বের
লক্ষকোটি মানুষের মনের শান্তির নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
- পতঞ্জলি……………………
- জীবক ছিলেন তক্ষশীলার শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যায় অনন্য …
- মহাভারতের সময় হতে ইন্দ্রপ্রস্থের ৪, ১৭৫+ বছরের রাজ…
- ব্রাহ্মনেতা ও লেখক রজনীকান্ত গুহ…………………
তথ্যসূত্র:
কণকপ্রভা বন্দ্যোপাধ্যায়; সাংখ্য-পাতঞ্জল দর্শন।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য: ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট
রাহুল সাংকৃত্যায়ন; দর্শন-দিকদর্শন (দ্বিতীয় খন্ড)
Ernest Wood; Yoga
Kim Knott; Hinduism A Very Short Introduction
Maqsoodul Haque; Bauliana Worshiping the great God in man
Click This Link
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Patañjali
Click This Link
http://www.yogajournal.com/wisdom/2208
Click This Link
http://swamij.com/yoga-sutras-patanjali.htm
Click This Link
Click This Link