বাঙালির অস্তিত্ব: মানুষগুলো মরবে না, কিন্তু বাঙালি থাকবে না।- তপন ঘোষ

বাঙালির অস্তিত্ব: মানুষগুলো মরবে না, কিন্তু বাঙালি থাকবে না। “ভারতমাতা কি জয়” এর পিছনেও রয়েছে বাংলা ও বাঙালি। অর্থাৎ আমরা ভারতকে সব দিয়েছি, নিজেরটা দেখিনি, তাই আজ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। বাঙালি হিন্দু বাঁচবে কি বলা কঠিন। তবে মনে হয় বাঁচবে না। মানুষগুলো মরবে না। কিন্তু বাঙালি থাকবে না।

প্রথমত, বাঙালি হিন্দু কথাটা পুনরুক্তি। হিন্দু ছাড়া বাঙালি হয় না, বাঙালি মানেই হিন্দু। যাদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, পরম্পরা, খাওয়াদাওয়া এই বাংলার মাটিতে অনেকদিন ধরে একইরকমভাবে চলে আসছে, তারাই বাঙালি।

গোসল করে গোস্ত খেলে বাঙালি থাকা যায় না, তেমনি ইরফান হয়ে ফুফু, খালা বলেও বাঙালি থাকা যায় না। বাংলাদেশে কিছু ভীতু হিন্দু ও নাস্তিক মুসলমান এই একটা বাঙালি জাতি তৈরির চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হবে না; বড় জোর একটা নতুন বাংলাদেশি গোষ্ঠী তৈরী হবে, যারা আদ্যন্ত মুসলমান।

সুতরাং বাঙালি মানেই হিন্দু, আর বাংলাদেশি মানেই মুসলমান-এই জায়গায় এসে শেষ হবে। বাঙালি মানেই তো হিন্দু, কিন্তু সেই বাঙালি থাকবে কি? টিকবে কি? মনে হচ্ছে টিকবে না। শুধু বাঙালি নয়, আরো দুটি গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে-কাশ্মীরি হিন্দু ও মালয়ালি হিন্দু।

আশ্চর্যের কথা, এই তিনটি প্রজাতির মধ্যেই ভীষণরকম মিল। এই তিনটি প্রজাতিই তর্কবাগীশ, আড্ডা দিতে ও কথা বলতে খুব ভালবাসে।

এরপর আসা যাক একটু পরিসংখ্যানে। সারা বিশ্বে মোট বাংলাভাষীর মধ্যে ত্রিশ শতাংশ হিন্দু, কাশ্মীরিভাষীদের মধ্যে পনেরো শতাংশ হিন্দু এবং মালয়ালিভাষীদের মধ্যে প্রায় পয়তাল্লিশ শতাংশ হিন্দু। অদ্ভূত মিল না!

ভারতের আর কোন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে এই অবস্থা হয় নি, অর্থাৎ সেই ভাষায় কথা বলা লোকের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া। কী করে এই তিনটি ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে গেল, সেটা অত্যন্ত গভীর গবেষণার বিষয়।

এই লেখা সেই গবেষণার পরিধির বাইরে। এই লেখার উদ্দেশ্য শুধু বর্তমান ঘটনাবলী, লক্ষণ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভবিষ্যতে পরিণতি বোঝার চেষ্টা করা।

অনেকগুলি তথ্য, ঘটনা ও পরিসংখ্যান এলোমেলোভাবে পেশ করব। পশ্চিমবঙ্গের চারটি বৃহত্তম শহর কলকাতা, হাওড়া, আসানসোল ও শিলিগুড়ি।

এই চারটি শহরেই আজ জনজীবন বা দৈনন্দিন চলাফেরা বা কাজকর্ম মারোয়াড়ি ও হিন্দিভাষী মানুষদেরকে বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না।

এছাড়া দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, রিষড়া, কোন্নাগর, ব্যান্ডেল, নৈহাটি, ব্যারাকপুর, টিটাগড় প্রভৃতি আরও বহু শহরেরই একই পরিস্থিতি। এই শহরগুলির চারিদিকে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে এগুলির উপরইতো অনেকটা নির্ভরশীল।

পরবর্তী খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আসামের বরাক উপত্যকায় অর্থাৎ কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হিন্দু বাঙালি সংখ্যালঘু হয়ে গেছে।

তবুও তারা এখনও নিজেদেরকে বাঙালি বলেই মনে করে। কিন্তু ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকায় অর্থাৎ ধুবড়ী থেকে গুহায়াটী হয়ে তেজপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় যে বাঙালিরা  আছে, যারা বহুবার ভাষাদাঙ্গার শিকার হয়েছে, ভাষা বৈষম্যের শিকার হওয়া যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের অনেকেই ভাবতে বাধ্য হচ্ছে যে তারা আর বাঙালি পরিচয়কে বহন করবে কিনা!

তাদের অনেকেরই মনে হচ্ছে যে বাঙালি পরিচয় নিয়ে তারা সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে না। তাই নিজেদের বাঙালি পরিচয় বিসর্জন দিয়ে অসমীয় পরিচয় গ্রহণ করবে কিনা।

তিন, মহারাষ্ট্রে চন্দ্রপুর ও গড়চিরৌলি দুটি জেলায় কয়েক লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তু আছে। তারা এখনও বাংলায় কথা বলে, কিন্তু তাদের সন্তানদের লিখিত বাংলা ভাষা শেখানোর কোন সুযোগ নেই।

তাই, সেখানকার বর্তমান প্রজন্মের বাঙালিরা বাংলা লিখতে ও পড়তে পারে না। এই উদ্বাস্তুদের প্রধান দাবি হল বাংলা মাধ্যম স্কুল চালু করা। এই অবস্থায় তারা কতদিন বাংলা ভাষাকে ধরে রাখতে পারবে?

চার, বিহার ও ঝাড়খন্ডে যে বাঙালিরা আছে, তাদের সন্তানরা স্কুলে গিয়ে বা বাড়ির বাইরে নিজেদের নামের পরে পদবী ব্যবহার করে না। অর্থাৎ নিজেদের বাঙালী পরিচয়কে লুকিয়ে রাখতে চায়। কারণ সহজবোধ্য।

এছাড়া বাঙালির বর্তমান নিজস্ব বাসস্থান, যেখানে নির্বাধভাবে সে তার বাঙালি পরিচয় ও অস্তিত্বকে ধরে রাখতে পারবে, সংরক্ষণ ও সংবর্ধন করতে পারবে, সেই জায়গাটা তো ১৯৪৭ সালে দুই-তৃতীয়াংশ সংকুচিত হয়ে আজ এই এক-তৃতীয়াংশ বঙ্গভূমি পশ্চিমবঙ্গেই পরিণত হয়েছে।

এইটুকু ভূমির মধ্যেও আবার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাঙালি সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে আরবীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। তাহলে আর বাকি থাকলে কতটা ? আর এই প্রক্রিয়াওতো থেমে নেই। বাঙালি সংস্কৃতির অবক্ষয় বা অবলুপ্তির এই প্রক্রিয়াকে হাওয়া দিয়ে ত্বরান্বিত করে চলেছে আমাদের পবিত্র গণতন্ত্র, অর্থাৎ ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি।

মমতা ব্যানাজী হিজাব পারেন, কিন্তু জ্যোতি বসু মোল্লাটুপি না পরেই পনেরো লক্ষ মুসলমানকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বসিয়ে দিয়েছিলেন। কেন ? মোল্লাপ্রীতিতে নয়, বাড়তি ভোটব্যাঙ্ক তৈরীর জন্য।

আজকে মমতা ব্যনাজী দক্ষিণেশ্বরের পাশেই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে বসিয়েছেন ওই কটা বাড়তি ভোটের জন্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের তিরিশ শতাংশ মুসলিম ভোটের মুখ চেয়ে। গণতন্ত্রের এমনই মহিমা! কিন্তু ভুগতে হবে আমাদেরকেই।

আজকে আমরা মমতা ব্যানার্জী বা জ্যোতি বসুকেই যতই দোষ দিই না কেন, একটা তথ্য মনে রাখা দরকার।

এনাদের মোল্লা তোষণের বদমাইসি শুরু হবার অনেক আগেই কিন্তু বাংলায় কথা বলা জনগোষ্ঠীর মধ্যে (ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে) প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ অহিন্দু হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে নিয়েছে। এর দায় আজকের ভোটলোভী রাজনৈতিক নেতাদের উপর চাপানো সম্পূর্ণ ভুল।

কিন্তু এই দুর্ঘটনা, অর্থাৎ বাঙালি হিন্দু ত্ৰিশ শতাংশ হয়ে যাওয়া, কী করে হল, তার সঠিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। নদীনালা বেষ্টিত দুৰ্গম পূর্ববঙ্গে একাত্তর শতাংশ মুসলমান হয়ে যাওয়া ১৯৪৭ সালে শুধু নবাব বাদশাদের অত্যাচারের ফলে হয়েছে, মানা যায় না। শ্ৰীচৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন, বা নাম সংকীর্তন কর্মসূচী বাংলাকে ইসলামীকরণের হাত থেকে রক্ষা করেছে – অনেকেই এটা মনে করেন।

কিন্তু আমি কিছুতেই এটা বুঝতে পারি না, শ্রীচৈতন্য তাঁর ভক্তি আন্দোলন শুরু করার পর মাত্ৰ ৭-৮ বছর বাংলায় থেকেছেন। তারপর দীর্ঘ আঠারো বছর, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নীলাচলে অবস্থান করেছেন।

সেইসময় রাজা প্রতাপরুদ্র তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। তারপরেও উড়িষ্যার মানুষ শ্ৰীচৈতন্যের নামধর্ম গ্রহণ করেনি বা তাঁর ভক্তি আন্দোলনে সামিল হয়নি।

আজও উড়িষ্যার মুসলিম ২.৪ শতাংশ। যৌথ বাংলার সঙ্গে একবার তুলনা করে দেখুন। আশ্চর্য হতে হয় না কি? কারও কারও মতে উত্তর ভারত থেকে উড়িষ্যায় প্রবেশ করার প্রাকৃতিক দুৰ্গমতার কারণে উড়িষ্যা বেঁচে গিয়েছে। কী করে মেনে নিই?

উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে তো সেই প্রাকৃতিক দুর্গমতা ছিল না। এই দুটি রাজ্যের উপর দিয়েই তো সমস্ত মুসলিম আক্রমণকারীরা এসেছে। আবার এইসব রাজ্যে হিন্দুধর্মের মধ্যে জাতপাতের ভেদাভেদও খুব ছিল, অস্পৃশ্যতা ছিল।

তা সত্ত্বেও আজও উত্তরপ্রদেশে মাত্র আঠারো শতাংশ মুসলমান, বিহারে সতেরো শতাংশ মুসলমান। আর আমাদের যৌথ বাংলায় তাদের সংখ্যা সত্তর শতাংশ।

তাই শ্রীচৈতন্যদেব বাংলাকে রক্ষা করতে পেরেছেন – উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে তুলনা করে একথা কি করে মেনে নিই? আর একটা কথাও খুবই স্পষ্ট নয় কি ? ১৭৫৭ সালে মুসলমানের হাত থেকে ইংরেজের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর না হলে বাংলার হিন্দুদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে যেত না কি?

ভাগ্যিস দুঃশ্চরিত্র, লম্পট সিরাজদ্দৌলা জগৎশেঠের বিধবা সুন্দরী কন্যার দিকে লালসার হাত বাড়িয়েছিল, তাই তো বাংলার হিন্দুর মুক্তিদাতা হিসেবে মিরজাফরের আবির্ভাব হল! তাই তো হল পলাশী!

তাই তো হল ক্ষমতার হস্তান্তর! বঙ্কিমচন্দ্ৰ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহীর উল্লেখ করেছেন, যে ‘সন্তান’দের কল্পনা করেছেন, তা বাস্তবে কতটা ছিল এবং তা আদৌ বাংলাকে যবন শাসন থেকে মুক্ত করতে পারত কিনা, — এরকম কোন ঐতিহাসিক তথ্য বা ইঙ্গিত তো পাওয়া যায় না।

তাই মিরজাফর ও ইংরেজই বাংলার হিন্দুর মুক্তিদাতা হিসাবে এসেছিল। আর মীরমদন ও মোহনলালের মত সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতিরা বাংলায় যবন শাসন স্থায়ী করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। এগুলি সব অপ্রিয় ঐতিহাসিক সত্য।

চলে আসি অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৭৫৭-এর পর বাঙালি হিন্দুর বোধহয় পুর্নজন্ম হল। তারপরে প্রায় একশো ষাট বছর যে বাঙালী গোটা ভারতকে নেতৃত্ব দিল, কোন মূলধন নিয়ে সেই নেতৃত্ব দিয়েছিল? সেই মূলধন কি ইংরাজী শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষা এবং ইউরোপের সান্নিধ্য নয়? যে জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এখানে হল, তার পেছনে কি ইউরোপের ম্যাজিনি ও গ্যারিবল্ডির প্রেরণা কাজ করেনি?

রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে সেদিন সেই উন্মেষের অগ্রদূতের অনেকেই কি ইউরোপ থেকে নতুন আলো ও স্বাভিমানের নতুন concept নিয়ে আসেন নি ? এমনকি পশ্চিমী প্রভাব ছাড়া আমরা কি বিবেকানন্দ, অরবিন্দ বা সুভাষকে পেতাম ?

কিন্তু রামমোহন থেকে শুরু করে শ্যামাপ্রসাদ পর্যন্ত যে উন্নত বাঙালিরা সারা ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা বাংলার কথা কম চিন্তা করেছেন।

খুবই কম চিন্তা করেছেন। বোধ হয় কেউই এর ব্যতিক্রম নন। স্বামী বিবেকানন্দের মত একটা চৌম্বক ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে একটাও বাঙালি আলাসিঙ্গা-পেরুমল তৈরী হল না কেন ? রাসবিহারী বোসও পাঞ্জাব ও দিল্লীতে বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

বাংলায় তাঁর কয়জন অনুগামী ছিল ? শ্ৰী অরবিন্দের জীবনের শুরু আর শেষ দুটোই বাংলার বাইরের। মাত্ৰ সাত-আট বছর বাংলায় তাঁর কর্মভূমি। এমনকি আমাদের প্রিয় শ্যামাপ্রসাদও কাশ্মীরের জন্য মরতে গেলেন, বাংলাকে দেশদ্রোহী কমিউনিস্টদের হাতে ছেড়ে দিয়ে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাঙালি (বাঙালি মানেই হিন্দু)। সারা ভারতকে উপকৃত করছে, আলোকিত করেছে, প্রেরণা দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, দিয়েছে দুটি রাষ্ট্রগান, দিয়েছে দুটি স্লোগান-বন্দে মাতরম ও জয় হিন্দ। এমনকি বর্তমানে জনপ্রিয় স্লোগান “ভারতমাতা কি জয়”, তার মধ্যেও ভারতমাতা বঙ্গমাতা কনসেপ্টেরই বর্ধিত রূপ।

মহারাষ্ট্র দেশমাতৃকা বা ভারতমাতা-র কনসেপট আমরা দেখতে পাইনি। ভারতমাতা-র প্রথম চিত্র এঁকেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। সুতরাং “ভারতমাতা কি জয়” এর পিছনেও রয়েছে বাংলা ও বাঙালি। অর্থাৎ আমরা ভারতকে সব দিয়েছি, নিজেরটা দেখিনি, তাই আজ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি।

অনেকে তর্ক করবেন, এ তো টাকপয়সা দেওয়া নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রেরণা দিলে কেউ নিঃস্ব হয় না, বরং তা বাড়ে। এ তর্কের উত্তর আমি দিতে পারব না। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসের দুটো উদাহরণ দিতে চাই। পৃথিবীর দুটি রিফিউজি জাতি হল। ইহুদি ও পার্সি। পার্সিরা আছে ভারতে আর ইহুদিরা আছে সারা বিশ্ব জুড়ে। পারস্য দেশবাসী পারসিদের’কে ভারতের সবাই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।

আর দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ইহুদিরা চরম ঘূণা ও অবজ্ঞার পাত্র ছিল এবং বিদ্বেষ ও হিংসার শিকার ছিল। এমনকি সেকসপিয়ারের মত মহান সাহিত্যিকও চরম ইহুদি বিদ্বেষী ছিলেন। উদাহরণ, “মার্চেন্ট অফ ভেনিস” গ্রন্থে ক্রুর নিষ্ঠুর সাইলক চরিত্র।

এই দুই জাতির মধ্যে কী তফাৎ ছিল? ইসলামের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পালিয়ে এসে পার্সিরা ভারতের গুজরাটের যে রাজ্যে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের নেতা সেই রাজ্যের রাজাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে দুধের মধ্যে মেশালে চিনি যে রকম ভাবে থাকে, ঠিক সেই রকম ভাবে পার্সিরা হিন্দু দেশে থাকবে ও সেই ভূমিকা পালন করবে।

তাদের পরবতী প্রজন্ম সেই প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রেখেছে। দাদাভাই নাওরোজি, জামসেদজী টাটা এবং আরও বহু পার্সি ভারতকে বহু দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন কোনরকম সমস্যা সৃষ্টি না করেই। কিন্তু আজকে? আজকে পার্সি জাতি বিলুপ্ত প্রায়।

সারা পৃথিবীতে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতেও বিলোপের পথে। আর ইহুদিরা? প্রায় ১৮০০ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে তারা ঘৃণা, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষের পাত্র হয়েছিল, তা কি একেবারে বিনা কারণে? তা কি শুধু তারা দেশত্যাগী ভূমিহীন রিফিউজি ছিল বলে ? না, তা নয়। এক হাতে তালি বাজেনি। ইহুদিরা চরম স্বার্থপর ও গোঁড়া ধর্মান্ধ ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি দেখে ইহুদিদের আগের রূপ বোঝা কঠিন। অর্থাৎ ইহুদিরা নিজেদেরটা বেশি করে দেখত, নিজের ভাল বেশি বুঝত, – স্বার্থপর ছিল। তাই পৃথিবীতে তারা এরকম ঘৃণার পাত্র হয়েছিল।

কিন্তু আজ ? পার্সি জাতির মতো আজ ইহুদিরা বিলুপ্তির পথে নয়, বরং নিজের ভূমিতে ফিরে গিয়ে সেখানে জাঁকিয়ে বসে সারা পৃথিবীতে তাদের দাপট ও প্রভাব ক্রমবর্ধমান। নিঃস্বার্থ পার্সি জাতি বিলীন হয়ে গেল, স্বার্থপর ইহুদি জাতি তাদের অস্তিত্বকে সুসংবদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বনেতৃত্বের অংশীদার হয়ে গেল।

বাঙালি হিন্দু সারা ভারতকে আলোকিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে, সন্মানিত করেছে, মিষ্টতা দিয়েছে, (বঙ্কিম-রবীন্দ্ৰ-শরৎ-রবিশঙ্কর-হেমন্ত-মান্না-কিশোর-ভূপেন হাজারিকা)। কিন্তু মানা-গড়চিরোলি-রুদ্রপুর-আন্দামান-আসামের বাঙালিদের দিকে তাকানোর অবসর কারো নেই। এমনকি বাঙালি বোদ্ধাদেরও নেই।

সমস্ত মহানতা, বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও অন্তরের সম্পদ দিয়ে সারা ভারতকে সমৃদ্ধ করে বাঙালি আজ-নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। এই প্ৰজাতি টিকবে না। এদের মধ্যে একটা অংশ কোনরকমে বড়জোর হিন্দু হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। তারা রবীন্দ্ৰ-শরৎ-বঙ্কিম-শরদিন্দু অন্য কোন ভারতীয় ভাষার অনুবাদ পড়বে। বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

(পুনশ্চঃ তপন ঘোষেরও কোন বাঙালি আলাসিঙ্গা পেরুমল জোটেনি। জুটেছে- রবি রাঘবন, তামিল, হিউস্টন প্রবাসী)।

সৌজন্যেঃ স্বদেশ সংহতি সংবাদ। পূজা সংখ্যা; ২০১৭, পৃষ্ঠা – ৬
লেখকঃ শ্রী তপন ঘোষ….

আরো পড়ুন…..