প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে

এখানেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি পার্থক্য: প্রকৃতিকে মাতৃরূপে দেখার শিক্ষা পেলে তাকে ভােগ্যবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা যায় না।

এখানেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি পার্থক্য: প্রকৃতিকে মাতৃরূপে দেখার শিক্ষা পেলে তাকে ভােগ্যবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা যায় না।  হিন্দু দর্শনের বাণী, গীতা ও উপনিষদের উপদেশগুলিকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত করতেই তাকে ধর্মাচরণের অঙ্গ করা হয়। ধর্ম, হিন্দুদর্শন এবং সমাজের প্রধান যােগসূত্র।

ধর্মাচরণের মধ্যেই এই মহান দর্শনের উপলব্ধি বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসনে হিন্দুর কর্ত্তব্য ও অকর্তব্যের কথা সহজভাবে বলা আছে। এই কর্তব্য ও অকর্তব্যের তালিকা পড়লে অবাক হতে হয় এই দেখে যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের আচার আচরণের কথা ভাবা হয়েছে। সংসারে সরল ও সত্য পথে চলতে গেলে কেমন আচরণ আমাদের করা উচিত তার পুত্থানুপুঙ্খ উপদেশ একমাত্র হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসনেই পাওয়া স্ময়।

এই পর্বটি পড়ার আগে পূর্বের প্রথম এবং দ্বীতিয় পর্ব দুইট আগে পড়ে আসুন-ধন্যবাদ।

 

হিন্দু ধর্মে এই কৰ্তব্য ও অকর্তব্যের দৈনন্দিন তালিকা অনুসরণের মধ্যেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার বীজমন্ত্র আছে। এমন অনেক কর্ত্তব্য-কর্মের কথা কলা আছে যাতে বন জঙ্গল ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। ভুমিক্ষয় রােধ হয়। জল ও বাতাস নির্মল থাকে। জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি পায়। অকারণ পশু হত্যায় ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে।

ধর্মীয় অনুশাসন ও পরম্পরা প্রত্যেক হিন্দুকেই তার সামাজিক জীবনে কিছু ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিদিন অথবা বিশেষ সময়ে মেনে চলতে হয়। এইসব অনুশাসন বা নিয়ম পদ্ধতি হিন্দুর পূজার্চনার অঙ্গবিশেষ। পূজা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলাে প্রকৃতিকে রক্ষা করা, তাকে ধ্বংস করা নয়। হিন্দু তাই গবাদি পশুকে নিছক পশু হিসাবে দেখে না, গােমাতা রূপে পূজা করে। হাতি, ঘােড়া, সাপ, পাখি সবই দেবতার বাহন অথবা দেবতা। বট, অশ্বখ, তুলসী পূজিত হয়।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি পার্থক্য
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি পার্থক্য

নদী, পৰ্ব্বত, ভূমি, যন্ত্রপাতি, বই, কলম ইত্যাদি সবই হিন্দুর পূজার বস্তু। সমস্ত পূজা বস্তুকে রক্ষা করাই হিন্দুর পবিত্র কর্ত্তব্য। হিন্দু তাই প্রকৃতির সম্পদকে ধ্বংস করতে পারে তার ধর্ম, তাকে এমন শিক্ষা দেয়নি।

 

ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের মতই হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস ও পরম্পরা গড়ে উঠেছে। ধর্ম বিশ্বাসের এই সুদীর্ঘ পরম্পরা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেছে। সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে, যেমন কৃষি, ফলফুলের বাগিচা, ভেষজ, গৃহ নির্মাণ, ধর্মীয় পরম্পরার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

এই পরম্পরার মত সুপ্রাচীন বিশ্বাস পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করেছে। এই জাতীয় অনেক বিশ্বাসের যুক্তি বা কারণ খুঁজে পাওয়া হয়তাে শক্ত। কিন্তু যদি | সেই বিশ্বাস পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করে তবে তা গ্রহণ করা উচিত।

 

যেমন মহারাষ্ট্রে বেশ কিছু মন্দির আছে পাহাড়ের চূড়ায়। এই সব মন্দির, পাহাড় | ঘিরে আছে বনাঞ্চল। সেখানের মানুষ বিশ্বাস করে জঙ্গলের গাছ কাটলে বা বন্য পশু হত্যা করলে দেবতার অভিশাপ নেমে আসবে। মন্দির সংলগ্ন বনের গাছ, পশু, পাখি সবই দেবতার আশ্রিত সন্তান। যুগ যুগ ধরে জঙ্গল রক্ষা করায় এখানে ভূমিক্ষয় হয়নি।

বাতাস সর্বদা নির্মল ও শীতল। প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। এখন এই বিশ্বাসকে যদি যুক্তিবাদীরা অন্ধ বিশ্বাস বলে বিপ করে তাতে কোন ক্ষতি নেই। কারণ এই যুক্তিহীন অন্ধ বিশ্বাসই যুগ যুগ ধরে পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছে। আধ্যাত্মিক মূল্যবােধ এই ভাবেই হিন্দুর ধর্মবােধে কর্ম ও পাপের ধারণা গড়ে উঠেছে। যদি কেউ গাছ কাটে অথবা অকারণে পশু হত্যা করে, তবে তাকে পাপের দায় মাথায় নিতে হবে।

 

সত্যি কি এই কর্মের জন্য পাপ হয় অথবা নরকে পচতে হবে? যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। কিন্তু যুক্তি তর্ক দিয়ে যে কাজ হয় না তা বিশ্বাসে সম্ভব হয়। নদী, মাটি, পর্বত ইত্যাদি সবই জড় পদার্থ। তবে ভূমি, নদীকে হিন্দু মাতৃরূপে পূজা করে কেন? জড় প্রাকৃতিক বস্তু কিভাবে মাতা হতে পারে? হ্যাঁ, এখানেই হিন্দু ধর্মশিক্ষার শ্রেষ্ঠত্ব।

প্রকৃতিকে মাতৃরূপে দেখার শিক্ষা পেলে তাকে ভােগ্যবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা যায় না।
প্রকৃতিকে মাতৃরূপে দেখার শিক্ষা পেলে তাকে ভােগ্যবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা যায় না।

প্রকৃতিকে মাতৃরূপে দেখার শিক্ষা পেলে তাকে ভােগ্যবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। এখানেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য। প্রাচ্যের হিন্দু প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের মধ্যে ঈশ্বরের রূপ প্রত্যক্ষ করে। আর পাশ্চাত্যের সভ্যতা প্রকৃতিকে ভােগ্যা নারী রূপে দেখেছে। শক্তি প্রয়ােগে তাকে অধিকারের চেষ্টা করেছে।

 

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে হিন্দু যে সব গাছ-গাছড়াকে দেবজ্ঞানে পূজা করে তার অধিকাংশই ভেষজ গুণসম্পন্ন, অথবা ধর্মাচরণে তার পত্ৰপুষ্প লাগে। সাধারণভাবে বিশেষ গুণসম্পন্ন এইসব গাছ-গাছালি হিন্দুর বাড়ির চারপাশে লাগানাে হয়। যুক্তিবাদীরা বলবেন বাড়ির চারপাশে গাছ লাগানাে ভাল কাজ। তবে তার সঙ্গে ধর্মকে জড়ানাের কোন অর্থ নেই। হাস্যকর ব্যাপার। হিন্দু তা মনে করে না। হিন্দু ধর্মের প্রবক্তারা শুধু মহাজ্ঞানী ছিলেন

তাঁরা বাস্তববাদী ছিলেন। পরিবেশ রক্ষার প্রয়ােজনে তাঁরা প্রকৃতির সম্পদকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করার উপদেশ দিয়েছিলেন। আজকের যুক্তিবাদীরা একটা কথাতাে স্বীকার করবেন যে নিজক আবেদন-নিবেদন বা যুক্তি তর্কে মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় বাধ্য করা যাচ্ছে না: বুদ্ধি যুক্তি দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য জগৎ পরিবেশ রক্ষার প্রয়ােজনীয়তা সাধারণ মানুষকে বােঝাতে পারেনি। অথচ প্রাচীন হিন্দু-ভারত শুধু ধর্ম বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে সে কাজ করে দেখিয়েছে।

 

হিন্দু ধর্মের প্রবক্তারা সেই সুপ্রাচীনকালেই উপলব্ধি করেছিলেন যে যা কিছু কল্যাণময় তা মানুষের গ্রহণযােগ্য করতে গেলে ধর্মীয় আচার অনুশাসনের মধ্য দিয়েই প্রচার করতে হবে। তাঁরা জানতেন সাধারণ মানুষ যুক্তি তর্কের কচকচিতে যেতে চায় না। তাদের কাছে ঋষি বাক্য অলঙ্ঘনীয়। ঋষির উপদেশ পালন করাই ধর্ম। ধর্মীয় আচার আচরণ গড়ে উঠেছে ঠিক এইভাবে। হিন্দুর সামাজিক জীবনে ধর্মের এক বিশেষ আসন পাতা আছে।

হিন্দুর জীবন ও ধর্ম অভিন্ন। কারণ জন্ম থেকে মৃত্যু হিন্দুর দৈনন্দিন জীবন ধর্মীয় অনুশাসনের শৃঙ্খলায় পরিচালিত। সুতরাং যা কিছু প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় প্রয়ােজন, তার সবই পূজা পদ্ধতি, আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে হিন্দু ঋষিরা যুক্ত করেছিলেন। ভেবে অবাক হতে হয় যে সেকালের ঋষিরা কত উচ্চস্তরের মনােবিজ্ঞানী ছিলেন।

যুক্তি তর্কের বৃথা কচকচিতে না গিয়ে তারা সাধারণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার কল্যাণে কেমন সার্থকভাবে কাজে লাগিয়ে ছিলেন। ত্যাগ ও ভােগের সুসমম্বয়। | হিন্দুত্ববাদের মূল ভিত্তিই গড়ে উঠেছে ত্যাগের আদর্শে। তবে কি হিন্দুত্ববাদে ভােগের কোন স্থানই নেই? হিন্দু পরজন্ম বা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী।

 

তার অর্থ কি তারা ইহজন্মে ইতর প্রাণীর মত জীবন কাটায়? মােটেই নয়। | হিন্দুর গৌরবময় অতীত ইতিহাস সে কথা বলে না। প্রাচীন ভারতে হিন্দুরা | এতটাই স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন যা প্রতিবেশী দেশের মানুষের কাছে ঈর্ষনীয় ছিল।

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যে সুদূর অতীতে বিদেশী বণিকের দল

ভারতে এসেছে মসলা, সিল্ক, হীরার সন্ধানে। আধ্যত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য নয়। একমাত্র ভারতেই সেরা মানের ভােগ্য পণ্য পাওয়া যেত। বিশ্বের আর কোন দেশে নয়। বৃটিশ বণিক এবং রাজশক্তি ভারতের সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। অর্থাৎ বিপুল সম্পদ আমাদের ছিল বলেই তা লুঠ করা সম্ভব হয়েছিল।

ত্যাগের আদর্শে গড়ে ওঠা হিন্দু সমাজে ভােগের উপকরণের এমন সহাবস্থান কিভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, এই সহাবস্থান, এমন সুসমন্বয় সম্ভবপর হয়েছিল মহান হিন্দুধর্ম প্রবক্তাদের দূরদৃষ্টির জন্য। এই মহাজ্ঞানী মহাজনেরা বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তাঁরা জানতেন সমাজের সাধারণ গহী মানুষের দুর্বলতা কোথায়। কতটা তারা গ্রহণ করতে পারবে আর কতটা পারবে না। সাধারণ মানুষ জৈবিক কামনা বাসনা, ইন্দ্রিয়সুখ সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে পারে না। জোর করে ইন্দ্রিয় বাসনা ত্যাগে বাধ্য করলে মানুষের মনে, সমাজে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে; বিকৃত বাসনা জীবনকে বিষাক্ত করে তুলবে।

 

হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা তাই ভােগের ইচ্ছাকে পুরােপুরি বর্জন করার কথা সাধারণ গৃহী মানুষকে বলেনান। বলেছেন, ভােগের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রয়ােজনের অতিরিক্ত ভােগের উপকরণ অমঙ্গলের কারণ হয়। হিন্দু ধর্মের অনুশাসনে গৃহী সংসারী মানুষের সুখী জীবনযাপনের নানা উপদেশ আছে। এই সব অনুশাসনে ভােগের সীমারেখা টানা আছে। যার অর্থ, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে পার্থব বস্তু ভােগ করা যেতে পারে।

যদি তােমার ভােগ সুখ পরিবশেকে দূষিত না করে, প্রকৃতির নিজস্ব চক্রকে ধ্বংস না করে, তবে তা মােটেই আপত্তিকর নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গীতার বাণীতেই এমন নিয়ন্ত্রিত ভােগের উপদেশ দিয়েছেন। বলেছেন, তােমার বাসনা, ভােগেচ্ছা যদি ধর্ম বিরুদ্ধ না হয় তবে তা নির্ভয়ে পালন করাে। হিন্দুধর্মে বিষয় সম্পত্তি, ভােগ সুখ থেকে সাধারণ মানুষকে দুরে থাকতে বলেনি। শুধু বলেছে তােমার লােভ, লালসা যেন সীমাহীন না হয়। কারণ তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। এইভাবে ধর্ম মানুষের ভােগের সীমাহীন ইচ্ছার মুখে শৃঙ্খলার লাগাম পরিয়ে দিয়েছে। ত্যাগ ও ভােগের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেছে।

লেখাটির

প্রথম পর্ব এখানে

দ্বীতিয় পর্ব এখানে

৪র্থ পর্ব এখানে

আরো পড়ুন…..

খাবার স্যালাইনের ফর্মুলা আবিষ্কারক হেমেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জী, কেন বর্ণ-বৈষম্যমূলক ভাবধারা শিখার ?

৪৭ এর ধর্ষিত মায়েদের সন্তানরা কি সেকুলাঙ্গার ?-দূরর্ম

“বৈদিক সভ্যতার অন্তরাত্মা “

গণিতবিদ কে পি বসুর (কালিপদ বসু)। গনিত শাস্ত্রে কালিপদ বসুর অবদান।

 

সূত্র:-
প্রাচীন ভারত – উইকিপিডিয়া
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার তথ্য – প্রাচীন ভারতের ইতিহাস
প্রাচীন ভারত সভ্যতার রহস্যের …
হিন্দুধর্মের ইতিহাস
সিন্ধু সভ্যতা – উইকিপিডিয়া
হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক সভ্যতা
বৈদিক সভ্যতা – উইকিপিডিয়া
বৈদিক সভ্যতা (Vedic Civilisation) | BengalStudents
প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার
আদি বৈদিক যুগের ইতিহাস জানার

লেখক-অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যাপক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
সভ্যতা, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক।