ভালো মানুষটি সেজে আসামকে নিন্দা করা তাদের মুখে শোভা পায় না।

আসামে কি হচ্ছে…?

এমন নয় আসামে কোন অ-অসমীয়া বাস করতে পারবে না। মানে ভারতীয় হলে যে কেউ যে কোন রাজ্যের স্বাধীন নাগরিক। আসামে ১৯ লাখ মানুষকে ‘বিদেশী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে যাদের কেউ নিজেদের ভারতীয় হিসেবে বৈধ কোন কাগজ দেখাতে পারেননি। আসাম দাবী করছে এরা ‘বাংলাদেশী’। আসামে অবৈধভাবে বাস করছিলো। সত্যি সত্যি এরকম কিছু হলে আসামের কার্যক্রমকে কেউ নিন্দা করতে পারে না। যে কোন দেশ তার অভ্যন্তরে থাকা অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিছুদিন পর পরই মালয়েশিয়া, সৌদি আরব তাদের দেশ থেকে অবৈধ নাগরিকদের বের করে দেয়। এই অবৈধ নাগরিকদের বেশির ভাগ বাংলাদেশী পাকিস্তানী ভারতীয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার দেশ আমেরিকা থেকে অবৈধ নাগরিকদের বের করে দেয়া ঘোষণা দেয়। দিয়ে অবশ্য সারাবিশ্বে সমালোচিত হন। সৌদি বা মালযেশিযা কিন্তু সেভাবে সমালোচিত হয় না। ট্রাম্প নিজে অভিবাসী হয়ে কেন বাইরে থেকে আসাদের বের করে দিতে এত মড়িয়া এটা বলে আমরা তার মন্ডুপাত করি। কিন্তু ট্রাম্প কি একবারও বৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলেছে? বলেনি। বলেছে অবৈধ অভিবাসীদের যাদের বৈধ কোন কাগজ নেই তাদের বের করে দিবেন। আসামও সেরকম চাইছে। ৪০ বছর ধরে আসামে বাস করার পর এখন জানতে পারছে সে আসামের কেউ না। তার কোন বৈধ কাগজ নেই। আসাম বলছে ১৯৭১ সালে ২৪ মার্চের আগে যারা আসামে এসেছেন তারা আসামের বৈধ নাগরিক। ২৫ মার্চ পর থেকে যারা আসামে এসেছেন তারা আসামে বৈধ বলে বিবেচিত হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৫০-৬০ বছর ধরে আসামে বাসকারীদের অনেকেরই এমন কোন কাগজ নেই যেটা দিয়ে তারা নাগরিক বৈধতা প্রমাণ করতে পারেন…।

সত্যি সত্যিই ৪০ বা তার কম বেশি সময় আগে তারা আসামে এসেছিলো বাংলাদেশ থেকে। এই সত্য মিথ্যে নয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সম্পত্তি এনিমি প্রোপার্টি ঘোষণা করে তাদের পাইকারী হারে ‘ভারতের দালাল’ ঘোষণা করে দাঙ্গা লাগিয়ে দিলো। হিন্দুরা প্রাণ হাতে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সময় ভারতের আসাম, পশ্চিমবাংলা, মেঘালয়, ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলো। তারপর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান অপারেশ সার্চলাইট (২৫ মার্চ ১৯৭১) চাপিয়ে দিয়ে একদিনেই কয়েক লক্ষ মানুষ মেরে ফেলেছিলো। পাকিস্তানীদের প্রধান ক্ষোভ ছিলো হিন্দু আর নৌকার সমর্থকদের। এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে ঠাই নিয়েছিলো যাদের বেশির ভাগই হিন্দু ছিলো। দেশ স্বাধীন হবার পর এদের অনেকেই বাংলাদেশে আর ফিরে যায়নি নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। ৪৭, ৬৫, ৭১- তিন দফা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বাংলাদেশকে আর নিরাপদ মনে করেনি। এদের সংখ্যাটা তখন কত ছিলো অনুমান করা না গেলেও আসামের এখনকার লিস্ট দেখে অনুমান করা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ কিন্তু কেবলমাত্র ৭১ সালের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো। তারা স্পষ্টত বলেছিলো ৬৫ সালে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগকারীদের ঠাই বাংলাদেশে হবে না। দেশ স্বাধীন হবার মাত্র ছয় বছর আগে যারা অন্যায়ভাবে ধর্মীয় পরিচয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো তাদের যারা নিতে চায়নি তারাই আজ আসামের নিন্দা করছে! ৯০ সালের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ছাড়া কাউকে কি বাংলাদেশ ফিরিয়ে নিতে এখন প্রস্তুত আছে? কাপ্তাই জলবিদ্যুত করতে গিয়ে বাস্তচ্যুত আদিবাসীদের কি বাংলাদেশ ঠাই দিবে? বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সাঁওতালরা তো আর ভেনিস হয়ে যায়নি। তারা যদি আজ বাংলাদেশে ফিরতে চায় বাংলাদেশ প্রস্তুত আছে তাদের গ্রহণ করতে?

আমি দাবী করছি জেনেভা ক্যাম্পে যে শরণার্থীরা আছে, যে উর্দুভাষী বিহারীরা আছে তাদের সবাইকে বাংলাদেশের নাগরিত্ব দেয়া হোক। ৪৭ বছর ধরে তারাও বাংলাদেশে বসবাস করছে নাগরিত্বহীনভাবে। পাকিস্তান কোনদিন তাদের ফিরিয়ে নিবে না। বাংলাদেশের কোন সরকারই পাকিস্তানকে দিয়ে সেটা করাতে পারেনি। যে ১৫ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে তাদেরও বাংলাদেশের নাগরিত্ব দেয়া হোক। আসামে ১৯ লাখ বাঙালীকে (হিন্দু-মুসলমান) আসামের নাগরিকত্ব দেয়া হোক। ভাষা সংস্কৃতি ধর্মের দোহাই দিযে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিতে পারে না কেউ। যারা ৬৫ সালে দেশত্যাগ করা স্বদেশীদের বাংলাদেশে নাগরিত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলো হিন্দুদের সম্পত্তি এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে ভোগ দখল করতে তারা আর অসমীয়া জাতীয়তাবাদীরা একই স্তরের মানুষ। এখন ভালোমানুষটি সেজে আসামকে নিন্দা করা তাদের মুখে শোভা পায় না।