জার্মানিতে এবার নির্বাচনে ইসলাম ধর্মকে ঠেকাতে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাবার কারণ কি??

জার্মানিতে এবার নির্বাচনে ইসলাম ধর্মকে ঠেকাতে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাবার কারণ কি হতে পারে? মাত্র চার বছর আগে গঠিত নতুন দল এএফডি মনে করে, জার্মান সমাজে ইসলামের কোন জায়গা নেই। এই দলটি আরো বলে, তারা জার্মান মসজিদে বিদেশ থেকে যে অর্থ আসে তা নিষিদ্ধ করবে। বোরখা এবং আজান নিষিদ্ধ করাও তাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি খোদ মুসলিম দেশগুলোই নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে জিহাদ ঠেকাতে। মাইকে ‘উচ্চস্বরে’ আজান সৌদি আরবেই নিষিদ্ধ আছে। আশ্চর্য যে এএফডি’র এই দাবীগুলোকে ইউরোপীয়ান সেক্যুলার এবং মুসলিম বিশ্বের মিডিয়া ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ বলে প্রচার করছে। এএফডি কি বলেছে জার্মানীতে কোন মুসলমানের স্থান হবে না? জার্মান মসজিদগুলোতে মাধ্যপাচ্য থেকে আসা অর্থে জঙ্গি-জিহাদী তৈরির কানেকশনকে ঠেকাতে চাওয়াকে কি করে মুসলিম বিদ্বেষ বলা যাবে? বোরখার সুযোগ নিয়ে সুইসাইড বোমারু হামলা ঠেকাতে মুসলিম দেশগুলোই বোরখা নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। সেই একই কাজ ইউরোপীয়রা করতে গেলেই সেটা বিদ্বেষ?

এএফডি উগ্র জাতীয়তাবাদী দল। জার্মানিতে এত ধর্ম, জাতি থাকতে কেবল মাত্র ইসলামের পিছনে লাগার কারণটি কি? যদি এটিকে ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ বলেই ধরি তাহলে অবধারিতভাবে আমাদের এই অনুসন্ধান জরুরী- ঠিক কি কারণে জার্মানরা মুসলমানদের ঠেকাতে এবার ভোটে এএফডিকে ১৩ শতাংশ ভোট দিয়ে ফেলল! এমন না জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমরা খুব এগিয়ে তাই জার্মানরা তাদের সঙ্গে কম্পিটিশনে পিছিয়ে পড়ছে। সাধারণত অভিবাসী কোন জাতি বা সম্প্রদায় মূল অধিবাসীদের সঙ্গে অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রতিদ্বন্দি হয়ে পড়লে তারা বিদ্বেষের শিকার হতে শুরু করে। মুসলমানদের যোগ্যতা নিয়ে বড় কথা বলার কিছু নেই। কাজেই জার্মান সমাজে ইসলামের জায়গা হবে না- এই দাবীর নেপথ্যের কারণটি আমরা সবাই মিস করে চলেছি। ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ এর যৌক্তিক কারণটি এই দাবীদারদের কেউই দিতে পারেননি।

এমন না জার্মানরা সবাই হঠাৎ করে খুব ধার্মীক হয়ে পড়েছে। গোটা ইউরোপেই ধার্মীক ইউরোপীয়ান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের উপমহাদেশীয় ধার্মীক কনসেপ্ট থেকে বলছি। সেই হিসেবে পৃথিবীর ৯৯ ভাগ ধার্মীকের বাস সাব-কন্টিনেন্টে। যারা ধর্মীয় শাসন চায়। মন্দির মসজিদ ভাঙ্গতে যায়। ধর্মীয় পরিচয়ে নাগরিকদের বৈষম্য করতে আগ্রহী। ইউরোপীয়ান ডানপন্থিদের তাই জাতীয়তাবাদী হ্ওয়া ছাড়া গতি নেই। চার্চের শাসন বা খ্রিস্টীয় আইন চাই- এসব বলে ইসলামী ডানপন্থিদের মত জনগণকে ম্যানেজ করার যুগ বহু আগেই গত হয়েছে। এখন যেটা তাদের করতে হয় ইউরো মুদ্রা বাতিলের ডাক, বিদেশীদের চাকরির বাজার দখল ইত্যাদি ইস্যুই তাদের সম্বল। তারা কখনই বলতে পারে না- তারা ক্ষমতায় যেতে পারলে মধ্যযুগের চার্চের শাসনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মানুষের চাকরির বাজার, শ্রমবাজারে টান পড়লে তারা জাতীয়তাবাদী না হয়ে পারে না। ইউরোপের ডানপন্থিদের এটাই এখন সম্বল। এএফডি জামাতে ইসলাম, চরমোনাই পীর, হেফাজত ইসলাম, ওলামা লীগের মত ডানপন্থি দলের মত রাষ্ট্রকে কয়েক শো বছরের পিছনে ধর্মীয় শাসনে নিতে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ইউরোপীয়ানদের ডানপন্থার পিছনে ঝোঁকা যেমন ধার্মীয় ভাবাবেগ নয় তেমনি ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ভোট প্রয়োগও সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় নয়। ইসলামের হাত থেকে তারা আসলে বাঁচতে চাইছে। গোটা ইউরোপের নিরোহ জনগণ আর কোন লরি-ট্রাককে জনসম্মুখে ‘আল্লাহো আকবর’ বলে উঠে যেতে দেখতে চায় না। তারা বিশ্বাস করেছে তাদের হত্যা করার গুপ্ত শলাপরামর্শ কেন্দ্র মুসলিমদের এই মসজিদগুলো। তাদের নিস্পাপ শিশুদের রক্তাক্ত নিথর দেহের পরিকল্পনা হয় মসজিদে বসে। সেক্যুলার দলগুলো নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এই জায়গাগুলোতে হাত দেয়াকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে সাধারণ জনগণের আস্থা হারাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আস্থায় চলে আসছে।

এএফডি বলেছে, জার্মান সমাজের সাথে ইসলামি সংস্কৃতি এবং জীবনধারার সহাবস্থান অসম্ভব। এটি যে কতখানি সত্য তার প্রমাণ সৌদি তথা মধ্যপাচ্যের মুসলমানের সঙ্গে আবহমানকালের বাংলার মুসলমানের সঙ্গে তফাত দেখে। এদেশের আলেমদের তিরিশ বছর আগেও একটা ক্ষোভ ছিলো- এদেশের মুসলমানরা সত্যিকারের ইসলামকে অনুসরণ করে না। সাহাবীকেরামের ইসলামকে অনুসরণ করে না। পাকিস্তানীরাও বলত বাঙালী মুসলমানরা অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলমান। প্রকৃত ইসলাম পৃথিবীর কোন সংস্কৃতি ও জীবনধারায় সহাবস্থান করতে পারবে না। ইসলামের চোখে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ব্যাতিত সমস্ত সংস্কৃতিই শয়তানের কাজ। ইসলাম ক্ষমতা হাতে পেলেই ভিন্ন সংস্কৃতি আর ধর্মকে সমূলে উচ্ছেদে রত হয়। ইসলাম একটি মতবাদ। সেই মতবাদকে ভয় পেলে কেউ যদি তার বিরোধী হয়ে উঠে তাহলে সে কেন ‘মুসলিম বিদ্বেষী’ হবে? ইসলাম মনে করে নারীর মাথার চুল তার জরাযুর মতই গোপন অঙ্গ তাই এটিকে পুরুষের সামনে ঢেকে রাখতে হবে। এই ঢেকে রাখার পোশাকটি ব্যক্তি স্বাধীনতা হলে ইসলামী দেশে নারীর জন্য বাধ্যতামূলক হতো না। তবু পর্দার সুযোগ নিয়ে ইসলাম কায়েম করতে যাওয়া স্বামীর ৭২ হুরের গর্বিত সর্দানি মুমিনা জিহাদী বোরখার ভেতর বোমা নিয়ে না গেলে পৃথিবীবাসী মুসলিম নারীদের পর্দা নিয়ে মাথাই ঘামাতো না। অর্থ্যাৎ কথিত মুসলিম বিদ্বেষ (ইসলাম বিদ্বেষ) মুসলিমদের ধর্মীয় চর্চার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছু না।