ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী কি কেরালার আরেক ‘তীতুমীর’?

ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী কি কেরালার আরেক ‘তীতুমীর’?
…………………………………………..
একজন জিহাদীকে যদি জাতীয় বীর বানিয়ে তাকে নিয়ে এই সময়ে এসে সিনেমা বানানো হয় তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠতে পারে এর পিছনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি?
ভারতে কেরালাতে ‘ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী’ নামের একজনকে নিয়ে সিনেমা বানানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে যেমন তীতুমীরকে নিয়ে সিনেমা বানানো হয়েছে ঠিক সেরকম। হাজি তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা’র কথা আমাদের কবিদের কবিতায় বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে বার বার ব্যবহার হয়েছে। তাকে পাঠ্য পুস্তকে স্থান করে দেয়া হয়েছে বীর হিসেবে। ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘মালাবার বিদ্রোহ’ নামের একটা ছোট চ্যাপ্টার আছে যেখানে ‘ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী’ বাংলার তীতুমীরের মতই মুসলিমদের কাছে আরেক নায়ক!
কেরালার যারাই ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীকে সাম্প্রদায়িক এক খুনি হিসেবে দেখছে তাদের সকলকেই ‘হিন্দুত্ববাদী’ হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। তীতুমীর ইংরেজ প্রশাসন ও তাদের তাবেদার জমিদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীও সেটাই করেছিলেন। দুদু মিয়া বা হাজি শরীয়াতুল্লাহ প্রমুখ সকলেই ইংরেজদের ও দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। খিলাফত যদি আপনি প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে যারা তখন ক্ষমতায় তাদেরকে হটিয়েই সেটা করতে হবে। কাজেই তীতুমীর বা ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীকে যদি ভগবৎসিং, সূর্যসেন প্রীতিলতাদের কাতারে বিদ্রোহী হিসেবে তুলে ধরি তা কি বস্তুনিষ্ঠ হবে?
তীতুমীর চেয়েছিলেন তার এলাকায় ইংরেজ ও তাদের তাবেদার জমিদারদের হটিয়ে ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে। যদিও শুরুতে তার আন্দোলন এই লক্ষ্যে ছিলো না। ১৮২২ সালে হজ করতে মক্কায় যাওয়ার পর সেখানে সাইয়িদ আহমদ বেরেলী নামের একজনের হাতে জিহাদের বায়াত লাভ করেন তিনি। বেরলি তাকে বাংলার মুসলমানদের ‘অনৈসলামিক রীতিনীতির’ বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন শুরু করতে আদেশ দেন। শুরু হয় তীতুমীরের ‘শিরক ও বিদাত’ বিরোধী আন্দোলন। তীতুমীর মুসলমানদের আরবী নাম রাখা এবং ধুতি পরা বিসর্জনের ঘোষণা দেন। চবিবশ পরগনা ও নদীয়া জেলার মুসলমানদের মধ্যে যে সহিষ্ণুতা বজায় ছিলো তীতুমীর তাদেরকে কট্টর মুসলিম রূপে প্রতিষ্ঠত করতে সক্ষম হোন। নদীয়াতে তীতুমীর ‘তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নবী মুহাম্মদের আসল ইসলামের দিকে মুসলমানদের ফিরিয়ে আনা। আজকে যারা তারেক মুনায়ের, আবদুল রাজ্জাক বিন ইউসুফদের নিন্দা করেন উগ্র কথাবার্তার জন্য তারা জানেন না ১৮২২ সালে তীতুমীর সেই একই ওয়াজ করেছিলেন চবিবশ পরগনা ও নদীয়া জেলায়। এই ওয়াজ নসিহতে ব্যাপক সফলতা লাভ করার পর তীতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা আজকের চরমোনাই পীর বা হেফাজত ইসলামের মতই হয়ে উঠেছিলো। তীতুমীর তখনই তার রাজনৈতিক ইসলামের তলোয়ার বের করেন। তিনি চবিবশ পরগনা ও নদীয়ায় ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে তার খলিফা হওয়ার জন্য ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। জমিদাররা অত্যাচারী ছিলো সে ইতিহাস অস্বীকার করছে না কেউ। ইংরেজদের নীল চাষের শোষণও কেউ ভুলে যায়নি। কিন্তু ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য ইংরেজ ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে তিনি কি করে স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান বীর বলে গোণ্য হতে পারেন?
ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজীকে নিয়ে কেরালাতে সিনেমা বানানোর ঘোষণাতে তাই নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। মালায়লাম সিনেমার খ্যাতনামা পরিচালক আশিক আবু এই সিনেমা বানানোর ঘোষণার পর যারা বিরোধীতা করছেন তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি করে দেওয়া একটা ভাষ্য আছে, সেটা অনেক মানুষ বিশ্বাসও করেন। ঐতিহাসিকরা অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সেই ভাষ্যটা মিথ্যা।”
আশিক আবু বা তাদের মত অনেকেই আজকাল ইংরেজদের উপর সব দোষ চাপিয়ে বহু ইতিহাস নতুন করে লেখাতে চাচ্ছেন। যেমন আওরাঙ্গজেব কঠরভাবে হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন বলেই মুসলমান ছেলেদের নাম অহংকার ভরে আওরাঙ্গজেব রাখা হত। আজকাল নতুন ইতিহাস লেখা হচ্ছে যে আওরাঙ্গজেব আসলে খুবই সাধু টাইপের মানুষ ছিলেন। দুষ্ট হিন্দুরা অন্যায় অপরাধ করায় তিনি যে ব্যবস্থা নিতেন সে কাহিনীগুলোই ইংরেজরা মুসলিম শাসনগুলোকে কলংকিত করতে এসব বানিয়ে বানিয়ে লিখে রেখে গেছে। অথচ আমরা জানি ভারতবর্ষে হাজার হাজার মুসলিম ছেলের নাম ‘তৈমুর’ রাখা হয়। এই লোকটা (তৈমুর লং) ভারতের ‘কাফের হত্যা’ নিয়ে নিজে খুব গর্ব করতেন। নিজের আত্মজীবনীতে তার কাফেরদের প্রতি ঘৃণা ছিলো স্পষ্ট। দিল্লির সুলতান নাসিরউদ্দিন তুঘলকের প্রতি তৈমুর অনেক বেশি ক্ষিপ্ত ছিলেন কারণ তিনি শুনেছিলেন দিল্লির সুলতান কাফেরদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ইসলাম পুরোপুরি কায়েম না কারায় দিল্লিতে তৈমুর একটু বেশিই রক্ত ঝরায়। দিল্লিতে তার চারদিন ধরে চলানো হত্যা ধর্ষণের কাহিনী কে কবে জানি বলে বসবে সব বানোয়াট!
সাইফ আলী খানের পুত্রের নাম তাই ‘তৈমুর’ রাখায় কম বেশি সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিলো। হিন্দু মুসলমান বাবা মায়ের ভালোবাসার সন্তানের নাম কেন তৈমুর হবে? তৈমুর লং কখনই ভারতবর্ষ শাসন করেননি। তিনি ভারত থেকে সম্পদ লুট করে সমরকন্দে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদি তৈমুর লং ভারতে থেকে যেতেন তাহলে তাকেও মহান এক বীর হিসেবে দেখানো অনেক সহজ ছিলো। যেমন বাংলাদেশে ‘শহীদ তীতুমীর’ কেরালাতে ‘শহীদ ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী’। ভারতকে যারা শরীয়া শাসনে নিয়ে যেতে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন তাদেরকে যদি আজকের যুগের গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি কপচানোর দলই বীরের মালা পরায় তাহলে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচিন্তার নায়ক কারা হবেন?
ভারতে হিন্দুত্ববাদ জেগে উঠেছে এই কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু মুসলমানরা কি ‘তৈমুর’ নাম রাখা বন্ধ করেছে? কবিরা কি ‘শহীদ তীতুমীরের বাঁশের কেল্লাকে’ বিদ্রোহের প্রতীক দেখানো বন্ধ করেছে? কেরালাতে যে সিনেমা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে সেই মূখ্য চরিত্র ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী সম্পর্কে ভারতের ইতিহাস গবেষণার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ বা আইসিএইচআরের সদস্য অধ্যাপক সি আই আইজ্যাক বলেছেন, “ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ একদিকে ছিলেন একজন ধর্মান্ধ, আর অন্যদিকে দস্যুদলের নেতা। ইসলাম ধর্মের অন্ধ অনুসারী ছিলেন তিনি। ১৯২১ সালের যে ঘটনার কথা বলা হয়, সেটা আদতে ছিল একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।”
এরকম জিহাদীদের ধরে ধরে বীর বানানো শুরু হলে, তাদেরকে এই একবিংশ শতাব্দীতে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার চরিত্র বা দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা ভারতের মত দেশে হিন্দুত্ববাদ কঠরভাবে জেগে উঠলে দায়টা কাদের উপর বর্তাবে? গণহারে সবাইকে ‘হিন্দুবাদী’ ট্যাগ মারা যে সবখানে সফল হবে না সেটাও বুঝতে হবে। বামপন্থিদের হাতে রচিত ইতিহাসে বরাবরই হিন্দু মুসলিম ব্যালেন্স রাখতে গিয়ে জিহাদী খিলাফতীদের ভারতের স্বাধীনতার নায়ক বানানোর চেষ্টা হয়েছে। খুঁজলে মুসলিমদের মধ্যে কি সত্যিকারের নায়ক পাওয়া যাবে না যিনি ভারতের সব মানুষের মেলবন্ধ চেয়ে লড়াই করেছিলেন? অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ যেমন চলছে তেমন করে তার পাল্টিও চলছে। ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপক আব্দুর রেজ্জাক এই সিনেমা বিতর্কে বলছেন, “কে এন পানিক্কর থেকে শুরু করে বহু ইতিহাসবিদ মালাবার বিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। কোনও বইতেই ওই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা হয় নি। ইতিহাস বলছে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ বরঞ্চ তার দলের সেই সব সদস্যদের কঠোর শাস্তি দিতেন, যারা লুটপাট চালাতো বা জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করত।”
তার মানে ভারিয়ানকুন্নাথুর দলে জোর করে ধর্মান্তরিত হত! লুটপাটও চলত! তবে ভারিয়ানকুন্নাথু ‘নিষেধ’ করতেন! ডালমে কুছ কালা হ্যায়…। অধ্যাপক রেজ্জাক কি বলতে পারবেন ভারিয়ানকুন্নাথুর ইংরেজ ও জমিদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যে রাজ্য করতে চেয়েছিলেন সেই রাজ্য কি মতে চলত? কোন সে তড়িকা যা হাজি সাহেব তাদের ‘হারানো খিলাফত’ ফিরে পেতে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন? ভারতবর্ষ মুসলিম শাসন থেকে ইংরেজ শাসনে চলে যায়। তাই মুসলমানরা মনে করে ভারতে ফের মুসলিম শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। এই যে মনে করা তাকে কি নাম দেয়া যাবে? হিন্দুত্ববাদকে নামকরণ করা গেছে, কিন্তু তৈমুর লংকে হিরো মনে করাকে কোন নামকরণ দেয়া যায়নি।…