সেই বাড়ি সেই বাড়ি, সাঁই বাড়ি সাঁই বাড়ি ! / দেবাশিস লাহা
এ কেমন দৃশ্য ? এ কেমন মত দানের বাতাবরণ ! এ কেমন পূতিগন্ধময় আবহ ? এ কেমন বর্বরোচিত নরমেধ যজ্ঞ ? নারীদের চুলের মুঠি ধরে প্রকাশ্যে প্রহার, লাইভ ক্যামেরায় ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্ত, বন্ধ ঘরে ঝলসে যাওয়া যুগলের লাশ, প্রতিবাদী ভোটকর্মীর নির্মম হত্যা ! এ কেমন প্রাণঘাতী পঞ্চায়েত ! শিউরে ওঠা মন শুধুই আকাশ খুঁজেছে, এক চিলতে আকাশ যেখানে ঠিকঠাক সূর্য ওঠে ! পাখি ওড়ে, শিশুরা তর্জনী উঁচিয়ে বলে—মা, ওই দেখ নীল ! না তেমন কিছুই ঘটেনি। ইতিহাস কেবল আকাশের সরে যাওয়াই লিখেছে,প্রতিটি মুহূর্ত কেবল পাখিদের ডানা বন্ধ করার উপাখ্যান ! তাই কেবল ধিক্কার ! ঘৃণার উপত্যকা থেকে ছুটে যাচ্ছে পুঞ্জীভূত থুতু ! ছি ছি ছি ! আমাদের রাজ্যটির এমন দুরবস্থা হল কিভাবে ! আগে তো এমন কিছু দেখা যায়নি ! এমন হিংস্রতা, নৃশংসতা যে অভাবনীয় ! এ কোন দিকে চলেছে আমার প্রিয় জন্মভূমি ! যা হওয়ার তাই হল—সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট, ফেসবুক টুইটার সর্বত্রই ডান বাম নির্বিশেষে এই সব পাশবিক ভিডিও, ছবি পোস্ট করতে শুরু করলেন। শেয়ারের পর শেয়ার ! ধিক্কারের পর ধিক্কার ! বিজেপি, কংগ্রেস, সি পি এম, এস ইউ সি আই , বুদ্ধিজীবী, অবুদ্ধিজীবী, ছেলে বুড়ো, যুবক যুবতী ধিক্কারের স্রোতে ভেসে গেল ওয়ালের পর ওয়াল ! রাজ্যটা কোন দিকে চলেছে ! এমন তো আগে কখনও শুনিনি ! এ কোন অরাজকতা ! আমার মুখেও থুতু ! কলমে ধিক্কারের বর্ণমালা ! এ কোন জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ ! এমন তো আগে দেখিনি ! আমিও চিৎকার করে উঠলাম—এ কোথায় চলেছি ! আমার প্রিয় মাটি তো এমন ছিল না ! এরা কারা ? সমস্ত শক্তি একত্রিত করে থুতু উগরে চলেছি ! আমার ডানদিকে ডানপন্থী, বাঁ দিকে বামপন্থী— আচমকা একটা অট্টহাসি ! আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে সে ছুটে আসছে। দমকে দমকে তার তীব্র পরিহাস ! চমকে উঠি ! কে হাসছে ? কোন সেই দুরাত্মা ! আমি কি ঠিক শুনেছি ! এখন কি হাসির সময় ? এই নারকীয় বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে কে এমন করে হাসতে পারে ! না, আমি ভুল শুনিনি ! ওই তো সে ! ইশারায় ডাকছে ! রহস্যময়ী এক ছায়ামূর্তি ! নারী ! কে আপনি ? হাসছেন কেন ? আপনি কি মানুষ ? জল্লাদের রঙ্গ মঞ্চে দাঁড়িয়ে পিশাচিনীও এমন করে হাসতে পারে না ! আর আপনি —-কি হল উত্তর দিন !
কোনো উত্তর নেই। অনন্তের মত মুহূর্ত।জমাট বাঁধা নীরবতায় দীর্ঘশ্বাসের বরফ। কতক্ষণ কাটল কে জানে ! তারপরেই বিস্ময়। নারীটি যেন একটু নড়ে উঠলেন। প্রসারিত তর্জনীতে অদ্ভুত এক ইশারা। কি যেন দেখাতে চাইছেন ! ফিসফিসিয়ে বললেন এসো, আমার পেছন পেছন এসো। সবাইকে নিয়ে এসো। কি হল দাঁড়িয়ে আছ কেন ? চল তোমাদের একটি জিনিষ দেখাব ! একা হয়ত ভয় পেতে পারো। বড় অন্ধকার। তাই সবাইকে নিয়ে এসো !
হ্যাঁ, বড় ভয় করছে আমার। বড় রহস্যময়ী এই ছায়ামানবী। আমাকে পথ বলে দিয়ে গেছেন। কিন্তু একা যাওয়ার সাহস নেই। প্লিজ আসুন না আমার সঙ্গে। মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপ সব কিছু নিয়ে আসুন। ইচ্ছে হলেই লাইভ হয়ে যেতে পারবেন, ভিডিও রেকর্ডিং-এও বাধা নেই, আর স্টিল পিকচার যত খুশি ! তবে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আটচল্লিশ বছর। চিন্তার কিছু নেই। এইচ জি ওয়েলস-এর টাইম মেশিন আছে। আসুন উঠে পড়ি। আমি-ই আপনাদের গাইড।আর উনি আমার। এই তো সবাই উঠে পড়েছেন। এবার বোতাম টেপার পালা। দাঁড়ান তারিখ আর সালটা এডজাস্ট করে নিই। টাইমার দিতে হবে তো ! ১৭ই মার্চ, ১৯৭০, সকাল সাতটা। এই তো এবার ইগ্নিশন অন ! স্টার্ট ! বন্ধুগণ আমরা পেছনে চলতে শুরু করেছি। হুউউউউউউস—–
এসে গেছি এসে গেছি ! এবার নেমে পড়ুন। কোন চাপ নেবেন না। ইয়ে মানে নিশ্চিন্তে। কারণ কেউ আপনাদের দেখতে পাবে না। এই মুহূর্তে আমরা সবাই অদৃশ্য। কেবল পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পাব। কি হল নেমে পড়ুন। এখন অনেক কাজ আমাদের। আমরা এখন বর্ধমান জেলার একটি বিশেষ ভূখণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছি। ওই দেখুন সামনে একটি বড় সড় বাড়ি। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে। দেখেই বোঝা যায় বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ। মোটা মোটা থাম, মজবুত খিলান, ঠাকুর দালান—পুরনো জমিদার বাড়ি যেমন হয়, অনেকটা তেমন। একি কাণ্ড ! ক্যামেরা কোথায় ? প্রথমেই কয়েকটা স্টিল নিয়ে নিন। জুমটা দেখে নিয়েছেন ? বাহ ! এই তো ফ্যান্টাসটিক। হ্যাঁ এটাই হল সাঁই বাড়ি। আরে করছেন কি ? ভিডিও লাইভ এসব পরে করবেন। সবে তো কলির সন্ধে। তার আগে শুনুন। এই বাড়িটি কিন্তু একটু অন্যরকম। মানে আর পাঁচটা বাড়ির মত নয়। কি বললেন ? পয়সাওয়ালা ? আরে ছো ! পয়সাওয়ালা বাড়ির কি অভাব আছে নাকি ! শুনুন মন দিয়ে। এই গ্রামের সবাই সি পি এম। এঁরাই শুধু কংগ্রেস। ইয়ে মানে ইন্দিরা কংগ্রেসের সমর্থক। গোঁড়াই বলা যায়। কি বললেন ? যে যার ইচ্ছে মত দল করবে , তাতে কি ! ঠিকই তো। বেশ তবে এই টপিক থাক। চলুন আর একটু এগিয়ে যাই। অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান গন্ধ মনে হচ্ছে ! কিছু টের পাচ্ছেন ? উঁহু ঠিক তাই। বেশ কিছু লোকজনের আনাগোনা। সুখাদ্যের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রান্নার জোগাড়ও চলছে। কিন্তু আজ নাকি এলাকায় বন্ধ। তাতে কি ! ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সমস্যা কি ! চলুন ঢুকেই পড়ি। কোনো টেনশন নেবেন না। আমরা তো অদৃশ্য ! কেউ দেখতে পাবেনা। ওই দেখুন কি ফুটফুটে একটি বাচ্চা ! কতই বা বয়স ! বড় জোর এক মাস। ওর জন্যই এই আয়োজন। নামকরণের অনুষ্ঠান। ঠিকও হয়ে গেছে। অমৃত ! কি সুন্দর নাম বলুন তো ! হ্যাঁ ওই এখন এই পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। অনেকেই নিমন্ত্রিত। খাওয়া দাওয়া গল্প গুজব। সারাদিন ধরেই চলবে। আসুন আমরাও প্রাণ ভরে দেখি।
একি ! ওরা কারা ? একটা মিছিল মনে হচ্ছে ! বাহ এই তো ক্যামেরা চালু হয়ে গেছে। ঠিক তাই। সি পি এম-এর মিছিল। সবার হাতে লাল পতাকা। চলুন তো একটু ভাল করে দেখি। তবে একটু সরে সরে দাঁড়াবেন। ইয়ে মানে সাইডে থাকাই ভাল। দেখতে না পেলেও ধাক্কা লাগার চান্স কিন্তু আছে। বেশ বড় সড় মিছিলই বলা যায়। কয়েক শ লোক তো হবেই। ওই দেখুন একটা রোগা ঢ্যাঙ্গা লোক— মিছিলের অন্যতম নেতা— চিনতে পেরেছেন ? হ্যাঁ বিনয় কোনার। আর ওই যে আর একজন—একটু চাপা গায়ের রঙ ! ঠিক ধরেছেন। নিরুপম সেন। কি বললেন ? মন্ত্রী ! ধুত এখনও হন নি। ভবিষ্যতে হবেন। ভুলে যাচ্ছেন কেন আপনারা ১৯৭০ এ আছে। সাতাত্তর আসুক। মন্ত্রিত্বের গল্প পরে। কান খাড়া রাখুন। শুনুন ওঁরা বিপ্লবের শ্লোগান দিচ্ছেন। সর্বহারার মুক্তির কথা বলছেন। বুর্জোয়াদের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! বাহ বেশ বেশ ! রক্ত কেমন গরম হয়ে যায় তাই না ! সহজ সরল আদিবাসী মানুষগুলোর মগজ কেমন ধোলাই করেছে দেখুন ! কিন্তু একি ! ওই শুনুন ! মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছে—সাঁই বাড়ি থেকে কেউ নাকি ইট ছুঁড়েছে। আপনারা কেউ দেখেছেন ? আমার চোখে তো তেমন কিছু পড়েনি। ওই শুনুন আর একজনের গলা—ইটের সঙ্গে নাকি গরম ভাতের ফ্যানও ফেলছে ! আপনারা কিছু দেখেছেন ? এত বড় মিছিলে কেউ ইট ছোঁড়ে ! পাগল নাকি ! কি তাজ্জব ব্যাপার ! অন্ধ মানুষগুলো কি নেতাদের বুজরুকি বিশ্বাস করে নিল ? তাই তো দেখছি। মিছিলটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওই দেখুন কারা যেন আগুন জ্বালাচ্ছে ! ছুটে আসছে রাশি রাশি তীর। দাউ দাউ করে জ্বলছে দরজা জানালা। দরজায় লাথি। ওই দেখুন ওরা ঢুকে পড়েছে। সামনে যা পাচ্ছে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে, তছনছ করে অন্দর মহলের দিকে ছুটে যাচ্ছে ওদের পা। হাতে লাঠি,টাঙ্গি, দা, বল্লম। ওই দেখুন একজন মানুষ সকালের জলখাবার খাচ্ছেন। নাম প্রণব সাঁই। মুখ ফেরানোর আগেই পিঠের উপর কোপ। দেখুন দা এবং বল্লমের আঘাতে একটা জলজ্যান্ত মানব শরীর কিভাবে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ! কোনটা মুণ্ডু, কোনটা হাত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাহ এই তো। দুর্দান্ত শট। কি বললেন ? লাইভ হয়ে গেছেন ? বাহ বেশ বেশ ! কিন্তু একটা লোকেশনে স্টিক করে থাকলে চলবে ? ওই দেখুন আর একজন ! প্রাণ ভয়ে কেমন পালাচ্ছে ! প্রণবের ভাই, মলয় সাঁই। কিন্তু কমরেডদের হাত থেকে পালানো কি এত সোজা। মার শালাকে ! চমকে উঠবেন না। বিপ্লবের গর্জন এমনই হয়। কিন্তু মলয় সাঁই লুকোলেন কোথায় ? কদ্দুরই বা যাবে। ইঁদুর হয়ে গেলেও ওকে আজ ওরা খুঁজে বের করবে। ওই তো ! কি, দেখতে পেয়েছেন ? ওই তো খাটের তলায়। ভয়ে কেমন জুবুথুবু। বেশি বয়সও নয়। নিন, জুম করে নিন। ফোকাসটা ঠিকঠাক ফেলুন। একটু পর না হয় লাইভে যাবেন। বাহ এই তো দুর্দান্ত। ওই দেখুন মলয় সাঁইকে কেমন বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খাটের তলা থেকে বের করে আনা হচ্ছে। শালা বুর্জোয়া শুয়ারের বাচ্চা ! পালাবি কোথায় ? জানিস না পুরো এলাকা আমাদের দখলে। আমরা হলাম প্রলেতারিয়েত ! ইয়ে মানে সর্বহারা। বেরো শালা চুতমারানি ! আরে কি হল ! প্রিয় বন্ধুরা ! নিশ্চুপ কেন ? এখনই রেকর্ডিং করার সময়। হ্যাঁ ভিডিও রেকর্ডিং ! স্টিল ছবিও নিতে পারেন। পোষ্ট করার সময় খুব গ্রাফিক মনে হলে ফেবু কর্তৃপক্ষ হাইড করে দিয়ে প্রোফাইল মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে আনকভার করতে পারে। নইলে একটু ব্লারড করে দেবেন। উঁহু আর দেরি নয়। ওই দেখুন মলয় সাঁইকে প্রতিবেশীর খাটের তলা থেকে বের করে আনা হয়েছে। তারই এক দিদিকে ইতিমধ্যেই চিত করে শুইয়ে ফেলা হয়েছে। উঠোনের উপর। এরপর কি হবে ? উঁহু একদম ভাববেন না। শুধু লাইভ হয়ে যান। ওই দেখুন সন্ত্রস্ত আধমরা মলয় সাঁইকে সেই নারীটির উপর জোর করে পেড়ে ফেলা হচ্ছে। দিদির উপর ভাই। ভাইয়ের নিচে দিদি।উঁহু চোখ বন্ধ করবেন না। দেখুন না বিপ্লব জমে উঠেছে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। ওই দেখুন হাঁসুয়া । দা-এর মত দেখতে, তবে অনেক ধারালো আর বড় সড়। মলয় সাঁইইয়ের কন্ঠনালীর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। ওই তো রক্ত। এবার ক্লোজ আপে যান মশাই। দেখুন কেমন করে মানুষ কাটতে হয়। ঠিক ধরেছেন । যেমন করে রুই মাছ কাটে। ওই দেখুন মুণ্ডুটা আর ধড়ের সঙ্গে লেগে নেই। ফুটবলের মত গড়াচ্ছে। ভাইয়ের রক্তে রাঙা দিদির শরীর। দু একবার কেঁপে উঠে কেমন নিথর হয়ে যাচ্ছে মলয় সাঁইয়ের দেহ। কাট ! কাট ! কাট ! এবার লোকেশন চেঞ্জ। পরের টেকে আসুন । আরে মশাই বিচলিত হলে চলবে ? রিভোলুশন চলছে যে। নিন এবার বাঁ দিকে ক্যামেরা তাক করুন। ওই যে মহিলা থর থর করে কাপছেন—উনি হলেন রেখা রানী সাঁই। আর ওই যে যিনি ছুটে পালানোর চেষ্টা করছেন-উনি তাঁর স্বামী—নব কুমার সাঁই। কিন্তু পালানোর গল্পটা তো বেশি দূর যাবে না, বন্ধু। পুরো বাড়িটাই ঘিরে ফেলা হয়েছে। ওই দেখুন নবকুমারকেও ধরে ফেলেছে সর্বহারার কমরেডরা। কি বললেন ? কোপ বসাবে ? মুণ্ডু আলাদা করে দেবে? ছি ! ওদের আপনারা কি ভাবেন ? কমরেড বলে কি নান্দনিক বোধ নেই ? সবাইকে একই কায়দায়—বৈচিত্রের তো একটা স্বাদ আছে, তাই না ? নবকুমার বাবুর চোখই আপাতত লক্ষ্য ! ওই যে বল্লম দিয়ে কেমন খোঁচানো হচ্ছে ! গলে যাওয়া মণি থেকে রক্ত আর রস গালের উপর কেমন হু হু করে— ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! উঁহু চোখ বন্ধ করবেন না। ভয় পাবেন না। কারণ মলয় কুমার সাঁইকে এখনই মেরে ফেলা হবে না। শুধু একটু কড়কে দেওয়া হচ্ছে। এই অন্ধত্ব নিয়ে তাঁকে আরও একটি বছর বাঁচিয়ে রাখা হবে। তারপর —–
কাট ! লোকেশন চেঞ্জ ! ক্যামেরা অন– টেক থ্রি ! ওই দেখুন আর একটি মানুষ। রান্না ঘরের পাশের পাঁচিল টপকে কেমন পালানোর চেষ্টা করছেন। উনি কে বলুন তো ? জিতেন মাস্টার। এ বাড়ির কচিকাঁচাদের পড়ান। আজ ওঁরও নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ওকে পালাতে হবে কেন ? প্রশ্ন করবেন না। বুর্জোয়া বাড়ির প্রাইভেট টিউটর মানে বোঝেন না ? কতটা বিপদজনক ! বেচারা পালাতে পারল কই ? ভাতের ফ্যানে পা হড়কে একেবারে কুপোকাত। ওই দেখুন সর্বহারারা ওঁকেও ধরে ফেলেছে। ওই দেখুন কেমন কুড়ুলের কোপ পড়ছে। ঘচাঘচ ! ফালা ফালা হয়ে যাওয়া অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রক্তের স্রোত ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ !
লোকেশন চেঞ্জ। টেক ফোর ! কি বললেন ? আর পারছেন না ? কি মুশকিল আপনারা সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখে এসেছেন। এসবে অভ্যস্ত হওয়া উচিত। তবে এবার যে দৃশ্যটি দেখতে চলছেন, আহা ! আর কোথাও চট করে দেখতে পাবেন না। ওই দেখুন আর একজন মহিলা ! ইনিও আধমরা ! এত রক্ত দেখার পর কি ঠিকঠাক বেঁচে থাকা যায় ? এঁর নাম কি বলুন তো? মৃগনয়না দেবী। মলয় সাঁই, প্রণব সাঁইইয়ের মা। ওঁর নাম কে মৃগনয়না রেখেছিল জানা নেই। সন্তানদের এমন ভয়াবহ পরিণতি নিজের চোখে দেখতে হবে জানলে নামকরণকারী নিশ্চয় একটু ভাবতেন। একি ভাতের থালা এল কোথা থেকে ! ওঁর কি এখন খাওয়ার সময় ? কি পরিহাস ! উনি এখন ভাত খাবেন ? কে জানে বাপু ! উঁহু, ভাল করে দেখুন। শুধু ভাত নয়। থালার উপর রক্ত ঢালা হচ্ছে। উঠোনের উপর পড়ে থাকা মৃতদেহগুলি থেকে আঁচলা ভরা রক্ত—কি অপূর্ব ভঙ্গিমায় মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে ভাতের সঙ্গে ! নে মাগী খেয়ে ফেল ! সন্তানের রক্তমাখা ভাত ! শালী বুর্জোয়া জননী ! এমন শয়তানের বাচ্চাদের জন্ম দিস কেন ? ইনলিলাব জিন্দাবাদ ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ ! একি আপনাদের হাত কাঁপছে কেন ! ভয় পাবেন না। উনিও এখন মরবেন না। সর্বহারারা বিদায় হওয়ার পর ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন—কিন্তু মরে গেলেই বোধ হয় ভাল হত ! এরপর উনি উন্মাদ হয়ে যাবেন—ঘেয়ো কুকুরের মত ধুঁকতে ধুঁকতে কয়েকটা সুদীর্ঘ বছর—তারপর অবশ্য শান্তি ওম শান্তি !
উঁহু ক্যামেরা থামালে চলবে না। ওই দেখুন ওরা এক মাসের বাচ্চাটিকেও কেমন দাউ দাউ আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন তো ? কানে কানে একটা কথা বলি ! শান্ত হোন। ভয় পাবেন না। আত্মীয়স্বজনের তৎপরতায় শিশুটি বেঁচে যাবে।
নিন এবার ক্যামেরা বন্ধ করুন। এ বাড়িতে এখন রক্ত আর আগুন ছাড়া আর কিছু নেই। ওই যে শুনুন ! আর্তনাদের শব্দ। প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া রমনীরা কাঁদছে। ওরা সর্বহারার বিপ্লবের গুরুত্ব বোঝে না। চলুন এবার ২০১৮ তে ফিরে যাই। টাইম মেশিন রেডি। ওয়ান টু থ্রি –ইগনিশন—স্টার্ট !
আমরা এখন বর্তমানে। ওই দেখুন সেই নারী। এতক্ষণ যা দেখলেন শুনলেন, সব ইনিই জানিয়েছেন। ওই দেখুন এখনও কেমন অট্টহাসি হেসে চলেছেন। ঝড়ে উড়ে যাওয়া পাকা চুল, উদ্ভ্রান্ত চোখের পাতায় জমাট বাঁধা রক্ত। পুড়িয়ে ফেলা প্রমাণ আর নথিপত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে কেবল তিনটি সাদা কালো ছবি এখনও বেঁচে আছে। ইনিই তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। মলয় কুমার সাঁই, প্রণব কুমার সাঁই, নবকুমার সাঁই ! তদন্ত কমিশনের ধূপ ধোঁয়া লাল সবুজের মিশেলে কবেই উধাও। তখন তাঁর বয়স ছিল ছাব্বিশ, এখন চুয়াত্তর ! হ্যাঁ ইনিই রেখা রানী সাঁই। সেদিনের পর আর ঘুমোতে পারেন নি ! গভীর অন্ধকারে একটু চোখ লেগে এলে এখনও শুনতে পান —ইনকিলাব জিন্দাবাদ ইনকিলাব জিন্দাবাদ !