ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক চৈতন্য মহাপ্রভু………………………………….।।।

চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ – ১৫৩৪) ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[১] গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাকে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার মনে করেন।[২] শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা।[৩] তিনি বিশেষত রাধাকৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করেন এবং হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন।[৪] সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাষ্টক নামক প্রসিদ্ধ স্তোত্রটিও তারই রচনা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতানুসারে, ভাগবত পুরাণের শেষের দিকের শ্লোকগুলিতে রাধারানির ভাবকান্তি সংবলিত শ্রীকৃষ্ণের চৈতন্য রূপে অবতার গ্রহণের কথা বর্ণিত হয়েছে।


চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বাশ্রমের নাম ‘গৌরাঙ্গ’, বা ‘নিমাই’। তার
গাত্রবর্ণ স্বর্ণালি আভাযুক্ত ছিল বলে তাকে ‘গৌরাঙ্গ’ নামে অভিহিত করা হত;[৬] অন্যদিকে, নিম বৃক্ষের নীচে জন্ম বলে তার নামকরণ হয়েছিল ‘নিমাই’।[৭]
ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সন্তজীবনী ধারায়
এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। সেযুগে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী
অবলম্বনে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্য চরিতামৃত, বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের চৈতন্য ভাগবত,[৮] এবং লোচন দাস ঠাকুরের চৈতন্যমঙ্গল[৯]

চৈতন্য জীবনকথা

চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি দোলপূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার নবদ্বীপে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম।[১০] তাঁর পিতামাতা ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের অধিবাসী জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবী।[১১] চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ওড়িশার জাজপুরের আদি বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ মধুকর মিশ্র ওড়িশা থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।[১২]
চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন
স্বনামধন্য পণ্ডিত। তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ছিল
অবিসংবাদিত। জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনি থেকে।[১৩] কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন। পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদান করতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বর পুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।[১৪] বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত রূপে তাঁর অপ্রত্যাশিত মন পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান। অনতিবিলম্বে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।
কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন।[১৫] সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে[১৬]
ওড়িশার সূর্যবংশীয় হিন্দু সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্য
মহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র
চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন।[১৭] ভক্তদের মতে, জীবনের শেষপর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।[১৮]

অবতারত্ব


চৈতন্য মহাপ্রভু (ডানে) ও নিত্যানন্দের (বামে) মূর্তি, ইসকন মন্দির, দিল্লি

গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের
মতে, চৈতন্য মহাপ্রভু ঈশ্বরের তিনটি পৃথক পৃথক রূপের আধার: প্রথমত, তিনি
কৃষ্ণের ভক্ত; দ্বিতীয়ত, তিনি কৃষ্ণভক্তির প্রবক্তা; এবং তৃতীয়ত, তিনি
রাধিকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ কৃষ্ণের স্বরূপ।[১৯][২০][২১][২২] ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চৈতন্য জীবনীগ্রন্থগুলির বর্ণনা অনুসারে, তিনি একাধিকবার অদ্বৈত আচার্যনিত্যানন্দ প্রভুকে কৃষ্ণের মতো বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।[২৩][২৪][২৫] চৈতন্যদবের দেহকান্তি ও স্বভাব সম্পর্কিত একটি পদ নিম্নরূপ:

প্রকান্ড শরীর শুদ্ধ কাঞ্চন বরণ
আজানুলম্বিত ভুজ কমল লোচন।
বাহু তুলি হরি বলি প্রেমদৃষ্ট্যে চায়
করিয়া কল্মষ নাশ প্রেমেতে ভাসায়।

চৈতন্য মহাপ্রভু ও পাঠান সৈনিক 

 

ভগবান শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু একদিন
ভক্তদের নিয়ে বৃন্দাবনের একটি গাছের ছায়াতলে বসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
নিয়ে আলোচনা করছিলেন । অনেক গাভী গাছটির নিকট চড়ছিল । তা দেখে শ্রী চৈতন্য
মহাপ্রভু অন্তরে উল্লসিত হয়েছিল । তখন হঠাৎ এক গোপ-বালক বংশী বাজাল । তা
শুনে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু প্রেমাবিষ্ট হলেন । শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তখন
অচেতন হয়ে ভূমিতে পড়লেন । তাঁর মুখ দিয়ে ফেনা পড়তে লাগল, তাঁর শ্বাসরুদ্ধ
হতে লাগল ।
সে সময় ধনার্জন পাঠান ঘোড়া সওয়ার সেখানে এসে উপস্থিত হলেন
এবং ঘোড়া থেকে
নামলেন । শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে দেখে তারা ভাবল এ সন্যাসীর কাছে নিশ্চয়ই
অনেক স্বর্ণ আছে । এবং এ চারজন ভক্তবেশী বাটপাড় নিশ্চয়ই এ সন্যাসীকে ধুতুরা
খাইয়ে মেরে ফেলে তার সমস্ত ধন অপহরণ করে নিয়েছে। সে পাঠানেরা তখন চারজনকে
বাঁধলেন এবং তাদের হত্যা করতে উদ্বত হলে মহাপ্রভুর দুজন ভক্ত ভয়ে কাঁপতে
লাগলেন । সে চারজন ছিলেন বলভদ্র ভট্টাচার্য তার সহকারী ব্রাহ্মন, রাজপুত
কৃষ্ণদাস এবং মাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য মনোড়িয়া ব্রাহ্মন ।
রাজপুত কৃষ্ণদাস ছিলেন নির্ভীক, মনোড়িয়া ব্রাহ্মনটিও ছিলেন নির্ভীক এবং
তিনি মুখে খুব সাহস দেখাতে লাগলেন । সেই ব্রাহ্মনটি বললেন, তোমরা পাঠান
সৈনিকেরা বাদশাহের অনুগত । চল তোমাদের সেনাপতির কাছে ন্যায্য বিচারের জন্য
যাই ।
“এই সন্ন্যাসী হচ্ছেন আমার গুরু এবং আমি মথুরার ব্রাহ্মন ।
বাদশাহের বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে আমি চিনি ।ব্যাধির প্রভাবে এই সন্ন্যাসী
কখনও কখনও মূর্ছিত হন । আপনারা দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন এবং তাহলেই
দেখবেন যে অচিরেই তিনি চেতনা ফিরে পেয়ে সুস্থ হবেন” ।
”আপনারা এখানে কিছুক্ষণ বসুন এবং আমাদের সকলকে বেঁধে রাখুন, তারপর একে জিজ্ঞাসা করে, আমাদের সকলকে হত্যা করবেন”।
সেই সময় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর চেতনা ফিরে পেলেন ।
হুঙ্কার করে উঠে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ‘হরি’ ‘হরি’ বলতে লাগলেন এবং
উর্ধ্ববাহু করে প্রেমাবেশে নৃত্য করতে লাগলেন ।প্রেমাবেশে শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভু যখন চিৎকার করতে লাগলেন, তখন সেই মুসলমান সৈনিকদের হৃদয় তা যেন
বজ্রপাত করতে লাগল ।
ভয় পেয়ে সেই পাঠান সৈনিকেরা চারজনকে ছেড়ে দিলেন এবং তাদের বন্ধন মুক্ত করলেন ।
তখন বলভদ্র ভট্টাচার্য এসে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ধরে বসালেন; এবং মুসলমান
সৈনিকদের দেখে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাহ্য চেতনা ফিরে এল ।
মুসলমান
সৈনিকেরা তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে এসে তাঁর চরণ বন্দনা করলেন এবং
তাঁকে বললেন এই চারজন লোক ঠক্‌ । এই চারজন আপনাকে ধুতুরা খাইয়ে পাগল করে,
আপনার সমস্ত ধন চুরি করে নিয়েছে ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু – এরা ঠক্‌ নয় । এরা আমার সঙ্গী । আমি সন্ন্যাসী
ভিক্ষুক, তাই আমার কাছে কোন ধন নেই । মৃগী রোগ আছে বলে আমি কখনও কখনও অচেতন
হয়ে পড়ি এবং এই চারজন আমাকে দয়া করে পালন করেন ।
সেই স্লেচ্ছদের মধ্যে একজন ছিলেন পরম গম্ভীর, তার পরণে কালো বস্ত্র, এবং
লোকেরা তাঁকে বলত ‘পীর’ । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে দর্শন করে তার চিত্ত আদ্র
হয়েছিল এবং তিনি তার শাস্ত্রের যুক্তি প্রদর্শন করে ‘নির্বিশেষ-ব্রহ

্ম’ স্থাপন করার চেষ্টা করলেন । তিনি যখন কোরাণের ভিত্তিতে ‘অদ্বৈত-ব্রহ্মবাদ’ স্থাপন করলেন, তখন তাঁর শাস্ত্র যুক্তির দ্বারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার মতবাদ খন্ডন করলেন ।
তিনি যে যে যুক্তি প্রদর্শন করলেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একে একে তার সবকটি
যুক্তি খন্ডন করলেন । তখন তার মুখে আর কোন কথা এল না এবং তারা সকলে স্তদ্ধ
হলেন ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু – তোমাদের শাস্ত্র কোরাণে অবশ্যই
নির্বিশেষবাদ প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু কোরাণের শেষে সেই নির্বিশেষ
তত্ত্ব খন্ডন করে সবিশেষ তত্ত্ব স্থাপিত হয়েছে । কোরাণে প্রতিপন্ন হয়েছে যে
চরমে ভগবান একই । তিনি সর্ব ঐশ্বর্যপূর্ণ এবং তাঁর অঙ্গকান্তি বর্ষার জল
ভরা মেঘের মতো ।
কোরাণের বর্ণনা অনুসারে, ভগবানের দেহ সচ্চিদানন্দময় ।
তিনি পূর্ণ ব্রহ্ম-স্বরূপ । তিনি সর্বাত্মা, সর্বজ্ঞ এবং সবকিছুর উৎস
স্বরূপ ।”
সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় তাঁর থেকেই হয় । স্থূল এবং সূক্ষ্ণ
জগতের তিনি মূল আশ্রয় । তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, সকলের আরাধ্য এবং সর্বকারণের
পরম কারণ । তাঁকে ভক্তি করা হলে জীবের সংসার-বন্ধন মোচন হয় ।
তাঁর সেবা বিনা বদ্ধজীবের সংসার মোচন হয় না এবং তাঁর চরণে প্রীতি লাভ করাই জীবের চরম লক্ষ্য ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দেখিয়ে গেছেন যে মুসলমানদের শাস্ত্রের ভগবৎ-প্রেম
লাভই জীবনের চরম লক্ষ্য । কোরাণে কর্ম যোগ এবং জ্ঞান যোগের কথা অবশ্যই
বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু চরমে পরম ঈশ্বরকে প্রার্থনা (এবাদৎ) নিবেদন করাই
জীবনের চরম লক্ষ্য বলে বর্ণিত হয়েছে । মোক্ষ আদি আনন্দ যার এক কথাও নয়, সেই
পূর্ণ আনন্দ লাভ করা যায় তাঁর শ্রীপাদপদ্ম সেবা করার মাধ্যমে ।
চৈতন্য মহাপ্রভু আরও বললেন,
”কোরানে কর্ম, জ্ঞান এবং যোগ আগে স্থাপন করে, সেগুলি সব খন্ডন করে ভগবানের সবিশেষ রূপ এবং তাঁর সেবার মহিমা স্থাপন করা হয়েছে ।
তোমার পন্ডিতদের যথাযথ শাস্ত্র জ্ঞান নেই, যদিও তোমাদের শাস্ত্রে বহু
প্রকার বিধির অনুশীলন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তারা জানে না যে
তার চরম সিদ্ধান্তই হচ্ছে সবচাইতে বলবান । তোমার নিজের শাস্ত্র কোরাণ দেখ,
এবং সেখানে কি লেখা রয়েছে তা বিচার করে কি সিধান্ত নির্ণীত হয়েছে তা আমাকে
বল?”
সেই সাধু মুসলমানটি উত্তর দিলেন, আপনি যা বললেন তা সত্যি ।
কোরাণে তা অবশ্যই লেখা হয়েছে, কিন্তু আমাদের পন্ডিতেরা তা বুঝতে পারে না
এবং গ্রহণ করতে পারে না । তারা কেবল ভগবানের নির্বিশেষ রূপেরই ব্যাখ্যা
করেন, কিন্তু ভগবানের সবিশেষ রূপ যে সকলেরই সেব্য, সে সম্বন্ধে তাদের কোন
জ্ঞান নেই ।
সেই সন্ত মুসলমানটি স্বীকার করেছিলেন যে, কোরাণ শাস্ত্রের
তথাকথিত পন্ডিতেরা কোরাণের সারমর্ম হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না । তাই তারা কেবল
ভগবানের নির্বিশেষ রূপই স্বীকার করেন । সাধারণত তারা কেবল সেই অংশটিই পাঠ
করেন এবং বিশ্লেষণ করেন । ভগবানের চিন্ময় রূপ যদিও সকলেরই আরাধ্য, কিন্তু
তাদের অধিকাংশই সেই সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ।
আপনি হচ্ছেন সেই সাক্ষাৎ
পরমেশ্বর ভগবান, আপনি দয়া করে আমাকে কৃপা করুন । আমি অযোগ্য পামর । আমি
অনেক মুসলমান শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, কিন্তু তা থেকে আমি নির্ধারণ করতে
পারিনি জীবনের পরম উদ্দেশ্য কি এবং কিভাবে তা প্রাপ্ত হওয়া যায় । আপনাকে
দেখে আমার জিহবা কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করছে । নিজেকে মস্ত বড় জ্ঞানী বলে মনে
করার মিথ্যা অভিমান আমার দূর হয়েছে । এই বলে সেই মুসলমানটি শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মে পতিত হলেন, এবং তাঁকে অনুরোধ করলেন জীবনের চরম
উদ্দেশ্য এবং তা প্রাপ্তির উপায় সম্বন্ধে তাকে উপদেশ দিতে ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, ওঠো, তুমি কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করেছ, তার ফলে
তোমার কোটি কোটি জন্মের পাপ দূর হয়ে গেল । এখন তুমি পবিত্র হলে ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তখন সমস্ত মুসলমানদের বললেন, “কৃষ্ণনাম কর!! কৃষ্ণনাম
কর!!” এবং তাঁরা সকলে যখন কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করতে লাগলেন তখন তাঁরা
প্রেমাবিষ্ট হলেন । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেই শুদ্ধ চরিত্র মুসলমানটিকে
‘হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র’ কীর্তন করার উপদেশ দান করে, পরোক্ষভাবে দীক্ষা দিয়ে,
তাঁর নাম রাখলেন রামদাস । সেখানে আর একজন পাঠান ছিলেন যাঁর নাম ছিল বিজলী
খাঁন ।
বিজুলী খাঁনের বয়স ছিল অল্প, এবং তিনি ছিলেন রাজার পুত্র । রামদাস আদি পাঠানেরা ছিলেন তাঁর চাকর ।
বিজুলী খাঁন ‘কৃষ্ণ’ বলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মে পতিত হলেন, এবং মহাপ্রভু তাঁর শ্রীপাদপদ্ম তার মাথায় স্থাপন করলেন ।
তাদের সকলকে কৃপা করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেখানে থেকে চলে গেলেন।
এবং সেই পাঠান মুসলমানেরা বৈরাগীতে পরিণত হলেন । পরে তারা পাঠান বৈষ্ণব
নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তাঁরা সর্বত্র শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মহিমা কীর্তন
করে ঘুরে বেড়াতেন ।।

 

পাদটীকা

  • Britannica: Caitanya Movement
  • Ravi Shankar discusses Sri Chaitanya Mahaprabhu
  • Srimad Bhagavatam (Introduction)
    “Lord Caitanya not only preached the Srimad-Bhagavatam but propagated
    the teachings of the Bhagavad-gita as well in the most practical way”
  • Sri Chaitanya Mahaprabhu
    “He spread the Yuga-dharma, or the practice most recommended for the
    attainment of pure love for Sri Sri Radha-Krishna. That process is
    Harinam Sankirtan, or the congregational chanting of the Holy Names of
    the Lord: Hare Krishna Hare Krishna Krishna Krishna Hare Hare, Hare Rama
    Hare Rama Rama Rama Hare Hare”
  • Bhag-P 11.5.32
    “In the age of Kali, intelligent persons perform congregational
    chanting to worship the incarnation of Godhead who constantly sings the
    names of Krishna. Although His complexion is not blackish, He is Krishna
    Himself. He is accompanied by His associates, servants, weapons and
    confidential companions. “
  • In the Name of the Lord (Deccan Herald) “He was also given the name of ‘Gaura’ (meaning golden) because of his extremely fair complexion.”
  • KCM Archive “they named Him, Nimai, as he was born under a neem tree”
  • Gaudiya Literature
  • Biography of Sri Locana Dasa Thakura (salagram.net)
  • Sri Caitanya Mahaprabhu: His Life and Precepts, by Bhaktivinoda Thakura
    “Caitanya Mahäprabhu appeared in Mäyäpur in the town of Nadia just
    after sunset on the evening of the 23rd Phälguna 1407 Shakabda,
    answering to 18 February, 1486, of the Christian Era. The moon was
    eclipsed at the time of His ‘birth'”
  • Sri Caitanya Mahaprabhu: His Life and Precepts, by Bhaktivinoda Thakura
  • Nair, p. 87
  • CC Adi lila 14.22
  • CC Adi lila 17.9
    “In Gayla, Sri Chaitanya Mähaprabhu was initiated by Isvara Puri, and
    immediately afterwards He exhibited signs of love of Godhead. He again
    displayed such symptoms after returning home.”
  • Teachings of Lord Chaitanya “They were surprised to see Lord Caitanya after He accepted his sannyasa order from Kesava Bharati”
  • History of Gaudiya Vaishnavism
    “Chaitanya spent the remainder of His life, another 24 years, in
    Jagannäth Puri in the company of some of His intimate associates, such
    as Svarüpa Dämodara and Rämänanda Räya”
  • Gaudiya Vaishnavas
    “His magnetism attracted men of great learning such as Särvabhauma
    Bhattächärya, the greatest authority on logic, and Shree Advaita
    Ächärya, leader of the Vaishnavas in Bengal, and men of power and wealth
    like the King of Orissa, Pratapa Rudra and his brähman minister,
    Rämänanda Räya…”
  • Srimad Bhagavatam, Introduction “At Puri, when he [Caitanya] entered the temple of Jagannätha, he became at once saturated with transcendental ecstasy”
  • Daniel
    Coit Gilman, Harry Thurston Peck, Frank Moore Colby, The New
    International Encyclopædia – Encyclopedias and dictionaries (1904) p.
    198, “was regarded as also divine and as a reincarnation of Krishna
    Himself”.
  • Margaret H. Case, Seeing Krishna: The Religious World of a Brahman Family in Vrindaban (2000) p. 63
  • C. J. Fuller, The Camphor Flame: Popular Hinduism and Society in India (2004) p. 176
  • David G. Bromley, Larry D. Shinn, Krishna Consciousness in the West(1989) p. 69
  • CC Adi-lila 17.10
  • Chaitanya Bhagavata Ādi-khaṇḍa 1.122
  • Chaitanya Bhagavata, Madhya-khaṇḍa 24
    1. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স।

    তথ্যসূত্র

    বহিঃসংযোগ