বাঙালি কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়………………….।।।

  1. দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯ জুলাই ১৮৬৩১৭ মে ১৯১৩) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন।[১] এই গানগুলি বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি
    নামে পরিচিত। তার বিখ্যাত গান “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা”, “বঙ্গ আমার! জননী
    আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ” ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। তিনি অনেকগুলি
    নাটক রচনা করেন।[২] তাঁর নাটকগুলি চার শ্রেণিতে বিন্যস্ত : প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক।[৩] তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।

    প্রথম জীবন

    দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে[২] তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (১৮২০-৮৫)[৪] ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান।[২][৪] তাঁর বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত।
    কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক।[৪] এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়।[২] তাঁর মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যস্রষ্টা।[৫]

    দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ. এ. পাস
    করেন কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন।[৫] এরপর কিছুদিন ছাপরা’র রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারীতে শিক্ষকতা করার পর[৫] সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য।[২]
    রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায়
    FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে
    প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind। এই
    বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কর্মে নিযুক্ত হন দ্বিজেন্দ্রলাল।
    কিন্তু তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে
    তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়।[৫]

    ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন ১৮৮৭ সালে। ১৮৯০
    সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত
    অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ
    ঘটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারি চাকরি হতে অবসর নেন।

    সাহিত্য কর্ম

    বাল্যকালে তিনি একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত হয়েছিলেন। পিতা
    কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, গায়ক ও লেখক। দ্বিজেন্দ্রলালের
    দুই অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় ও হরেন্দ্রলাল রায় – দু’জনেই ছিলেন লেখক ও
    পত্রিকা সম্পাদক। গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল।[৬] এরকম একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। তিনি পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন, যা দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্ণিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল।[২] তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।[৩] দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে।

    হাস্যরসেও তিনি অসামান্য পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন:[৭]

    স্ত্রীর চেয়ে কুমীর ভাল বলেন সর্বশাস্ত্রী

    ধরলে কুমীর ছাড়ে বরং, ধরলে ছাড়ে না স্ত্রী।

    গ্রন্থতালিকা

    কাব্যগ্রন্থ

    • আর্যগাথা, ১ম খণ্ড (১৮৮৪)
    • The Lyrics of India (ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রচিত) (১৮৮৬ )
    • আর্যগাথা, ২য় খণ্ড (১৮৮৪)
    • আষাঢ়ে (১৮৯৯)
    • হাসির গান (১৯০০)
    • মন্দ্র (১৯০২)
    • আলেখ্য (১৯০৭)
    • ত্রিবেণী (১৯১২)

    উল্লেখযোগ্য নাটক :

    (১) প্রহসন বা লঘু রসাশ্রয়ি নাটক-

    • একঘরে (১৮৮৯)
    • কল্কি অবতার (১৮৯৫)
    • বিরহ (১৮৯৭)
    • এ্যহস্পর্শ বা সুখী পরিবার (১৯০১)
    • প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২)
    • পুনর্জন্ম (১৯১১)
    • আনন্দ-বিদায় (১৯১২)

    (২) ইতিহাসাশ্রয়ী নাটক-

    • তারাবাঈ (১৯০৩)
    • রানা প্রতাপসিংহ (১৯০৫)
    • দুর্গাদাস (১৯০৬)
    • সোরার রুস্তম (১৯০৮)
    • নূরজাহান (১৯০৮)
    • মেবার পতন (১৯০৮)
    • সাজাহান (১৯০৯)
    • চন্দ্যগুপ্ত (১৯১২)
    • সিংহল বিজয় (১৯১৫)

    (৩) পৌরাণিক নাটক-

    • পাষাণী (১৯০০)
    • সীতা (১৯০৮)
    • ভীষ্ম (১৯১৪)

    (৪) সামাজিক নাটক-

    • পারাপারে (১৯১২)
    • বঙ্গনারী (১৯১৬)

    মৃত্যু

    ১৯১৩ সালের ১৭ই মে তারিখে কলকাতায় দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনাবসান ঘটে।

    তথ্যসূত্র

    পাদটীকা

  2. দ্বিজেন্দ্রগীতি সমগ্র, সুধীর চক্রবর্তী সংকলিত ও সম্পাদিত, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ৭
  3. ভারতকোষ, চতুর্থ খণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৯৭০, পৃ. ১১০-১১
  4. বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তুলসী প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৮ সং, পৃ. ৪৫২-৫৬
  5. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৮৪
  6. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৬-২৭
  7. ‘ক্ষেত্রমোহন বসুর পত্র’, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ : শিবনাথ শাস্ত্রী
  8. “সাহিত্য-সন্দর্শন”, শ্রীশচন্দ্র দাশ, বর্ণ বিচিত্রা, ঢাকা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৭