থেমিসকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতে (২৬ মে, ২০১৭) বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন সুপ্রিম কোর্ট ভবনের সামনে থেকে ভাস্কর্য শিল্পী মৃণাল হকের করা ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রীক দেবী থেমিস ভাস্কর্যটির অপসারণ। ভাস্কর্যটিকে সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পেছনে নিয়ে রাখা হয়েছে। টিভি ক্যামেরার সামনে কাঁদতে কাঁদতে শিল্পী জানিয়েছেন- ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয়েই তিনি তাঁর শিল্পকর্মকে সরিয়ে নিচ্ছেন।
এই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে যখন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী ‘বায়না’ ধরল যে হাই কোর্টের সামনে থেকে নারীর মূর্তি (!) সরাতে হবে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু বলেননি দেখে সবাই ভেবেছিলেন এবার আর তিনি কোনও অন্যায় আবদার মানবেন না। যদিও এর আগে হেফাজতের আবদারে পাঠ্যপুস্তকে অমুসলমানদের লেখা সব কিছু সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তারপরেই ধাক্কাটা এল এপ্রিল মাসে। বঙ্গভবনে (বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দপ্তর ও বাসভবন) শেখ হাসিনা আলেমদের এক সমাবেশে বলে বসেন- মূর্তিটা তাঁরও পছন্দ না। হেফাজত খুশি হয়ে মূর্তি অপসারণের আন্দোলন জোরদার করে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়রা শুধু নয়, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও এর সাথে নানান কৌশলে সুর মেলাতে থাকেন। সবচাইতে ধাক্কা লাগে যখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে সমর্থন করে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা বলতে থাকেন, বিশ্বে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ভাস্কর্যটিকে নাকি শাড়ি পড়িয়ে বিকৃত করা হয়েছে, তাই এটা নাকি বিকৃত শিল্পকর্ম। আওয়ামী লীগের ভাস্কর্য বিরোধী অবস্থানে সবচাইতে সরব দলের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও জনপথ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এছাড়া মৃণাল হক কতটা খারাপ শিল্পী সেটাও হঠাৎ যেন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। অনেকের কথাবার্তা এমন ছিল যেন মৃণাল হক ইচ্ছে করে ভাস্কর্যটি ওখানে বসিয়েছেন। যাই হোক অনেক আবেদন, নিবেদন, প্রতিবাদ সব ব্যর্থ করে ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়। আর অপসারণের সময় মৃণাল হককে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। শুক্রবার রাতে দু’টি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অন্তত রবিবারের আগে ভাস্কর্য বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।
আশ্চর্য লাগছে যে এই ভাস্কর্যটি ২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে এতদিন ছিল, তখন কারোরই ঈমান-আকিদায় লাগেনি? এটি যখন স্থাপন করা হচ্ছিল, তখন এত ‘সৌন্দর্য’ বিশেষজ্ঞরাই বা কোথায় ছিলেন? মজার কথা হচ্ছে ওবায়দুল কাদেরকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে যে যদি এবার হেফাজত আবদার করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরিয়ে দিতে, তাহলে কী হবে? তিনি উত্তর দিয়েছেন- ওটা তো মূর্তি নয়, ওটা ভাস্কর্য। অর্থাৎ, নারী হলে সেটা মূর্তি এবং পুরুষ হলে সেটা ভাস্কর্য। তার মানে হচ্ছে দেশব্যপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিগ্রহ ভাঙার যে উৎসব হয়, সেগুলো মূর্তি এবং তা ভাঙা জায়েজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের অধ্যাপক আবদুস সবুর খান নিউজ24-এর ‘জনতন্ত্র গণতন্ত্র’ অনুষ্ঠানে অদ্ভুত যুক্তি দেন- যেহেতু বাংলাদেশে কোনও নারী বিচার করেন না, তাই এই মূর্তি থাকা উচিত নয়। অথচ এই দেশে অসংখ্য নারী বিচারক রয়েছেন। আইন মন্ত্রী আনিসুল হক আরও এক কাঠি এগিয়ে, পাঁচজন গণমাধ্যমকর্মীকে তামাক নিয়ন্ত্রণ সাংবাদিকতায় পুরস্কার দেবার অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা যাকে থেমিস বলি, সেটার আসল রূপ এই মূর্তিটা নয়। তাই এটা কোনও মূর্তিই ছিল না। এই মূর্তিটা সরিয়ে বরং ইসলাম-সহ অন্যান্য ধর্মের প্রতি আমার মনে হয় সম্মান করা হল। আমরা যদি এই ধরনের মূর্তি স্থাপন করতাম, তাহলে এটা আসল থেমিসকে বিকৃত করা হত। এই ঘটনায় বাংলাদেশের কোনও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি।”
শেখ হাসিনার সমর্থনে এই ভাস্কর্য অপসারিত হলেও আওয়ামী লীগ দায় চাপিয়ে দিচ্ছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ওপর। ব্যপারটা খুবই হাস্যকর। কারণ সবাই জানে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিচারপতির দ্বন্দ্বের কথা। তাছাড়া হেফাজতের নানান বায়ানাক্কার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল সিনহাকে বরখাস্ত করা। আইন মন্ত্রীকে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, এ’বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রধান বিচারপতির আলোচনা হয়েছে কিনা? তিনি জানান, তাঁর কাছে কোনও তথ্য নেই!
শিল্পী মৃণাল হক।
ঘটনার আরেকটি অদ্ভুত দিক হল এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করতে নিশ্চয়ই মৃণাল হক ‘কমিশন্ড’ হয়েছিলেন, তাহলে কোন যুক্তিতে তাঁকে কমিশন দেওয়া হল? উনি নিশ্চয়ই এমন একটা স্থানে নিজে নিজে ভাস্কর্যটি স্থাপন করেননি। ভাস্কর্যটির এখন কী হবে? প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, “এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। আমি কিছু জানিনা।” আর ওবায়দুল কাদের বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের সামনের মূর্তি অপসারণের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারে নেই। এটা সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত।”
এর প্রতিবাদ হয়েছে। খুব ছোট্ট করে হলেও। বামপন্থী দলগুলোর একটি ছোট অংশ অপসারণের রাত থেকেই ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করে। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে হাই কোর্টের দিকে যাবার সময় পুলিশ জলকামান, লাঠি আর রাবার বুলেট নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা কলেজ শাখার সভাপতি মোর্শেদ হালিম, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী জয় ও উদীচীর আরিফুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য মামলা করেছে পুলিশ। এরমধ্যে আছে ৩০৭ ধারা (হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত), ৩৩৩ ধারা (সরকারি কর্মকর্তাকে গুরুতর জখম)। এছাড়াও আছে ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯ ধারা (সশস্ত্র অবস্থায় দাঙ্গা হাঙ্গামার জন্য সমবেত হওয়া), ১৮৬ ধারা (উদ্দেশ্যমূলক সমাবেশ), ৩৩২ ধারা (সরকারি কাজে বাধা), ৩৫৩ ধারা (রাষ্ট্র কর্মে বাধা) ও ৪২৭ ধারা (ভাঙচুর)। ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে শনিবার (২৭ মে) সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। শক্রবার শাহবাগের এক সমাবেশ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে চরমোনাই পীর (মুক্তিযুদ্ধকালের রাজাকার)-এর দলের অনুগত ছাত্র সংগঠন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন প্রতিবাদকারীদের প্রতিহত করার কথা ঘোষণা করেছে ।
এই মুহূর্তে সবার মুখে দু’টিপ্রশ্ন- ১) মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ভাস্কর্য শিল্পী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের যে ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি আছে সেটা তুলে দেবার বায়না করলে কি শেখ হাসিনা তা মেনে নেবেন? ২) যেহেতু হেফাজতে ইসলামের কাছে নারী নেতৃত্ব হারাম, তাই প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে বললে উনি কি সরে যাবেন?
বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি ‘মূর্তি’ অপসারণে অভিনন্দন জানিয়েছে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সামনে আরও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।