জন্মগতভাবে সব মানুষকে একদিন সমগ্র পৃথিবীই তার নাগরিত্ব মেনে নিবে…।

জেরুজালেমের সঙ্গে ইসলাম তথা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকারের তত্ত্বতালাশ করে জালিয়াতির নজিরবিহীন ইতিহাস জেনে বিস্মিত না হয়ে পারবেন না। মুসলমানদের জেরুজালেমের উপর দাবীর প্রধান কারণ এখানে তাদের নবী মুহাম্মদ মিরাজ যাবার কালে নামাজ আদায় করেছিলেন। ইসলামী বর্ণনা মতে, মুহাম্মদ গাধার মত দেখতে ডানাওয়ালা একটা জন্তুর পিঠে চড়ে মদিনা হয়ে সিনাই পর্বত, যীশুর জন্মস্থান বায়তে লাহম হয়ে বিদ্যুৎ গতিতে জেরুজালেম পৌঁছে যান। এখানে তিনি ‘মসজিদুল আকসা’ দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন সমস্ত নবী ও রসূলের ইমাম হিসেবে। ইহুদীদের কাছ থেকে যত নবীর নাম পাওয়া যায় তাদের সবাই মুহাম্মদের পিছনে নামাজ আদায় করে। ঠিক এই তথ্যের কারণেই জেরুজালেম মুসলমানদের জন্য ‘পবিত্র’ হয়ে আছে। মুসলমানদের এই পবিত্রতার নেপথ্য জালিয়াতি বলার আগে কেন জেরুজালেম ইহুদীদের প্রধান তীর্থকেন্দ্র সেটা বলে নেই।

তাওরাত মতে, জিহোবা (ঈশ্বর) দাউদ নবীকে জেরুজালেমে তার প্রার্থনা করার জন্য একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। সেই মতে দাউদ একটি মন্দির প্রতিষ্ঠায় হাত দিলে তার মৃত্যুর পর তার পুত্র সোলাইমান নবী মন্দিরের কাজ সমাপ্ত করেন। সেকরণেই একে সোলাইমানের মন্দির বলে অভিহত করা হয়। ৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদ জেরুজালেম আক্রমন করে সোলাইমানের মন্দিরের দু-একটি দেয়াল বাদে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এরপর ৭০ বছর পর ৫১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইহুদীরা ফের এই জায়গায় সোলাইমানের মন্দির নির্মাণ করে এর নাম দেয় ‘টেম্পল মাউন্ট’। কিন্তু ৭০ খ্রিস্টাব্দে অর্থ্যাৎ মুসলমানদের নবী মুহাম্মদের জন্মের ৫০০ বছর আগে রোম সম্রাট জেরুজালেম আক্রমন করে আবার সোলাইমানের মন্দির ধ্বংস করে ফেলেন। সম্ভবত একটি দেয়াল কেবল অবশিষ্ঠ ছিলো। এই আগুনে পোড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়ালে কপাল ঠেকিয়েই এখন ইহুদীরা বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে থাকে। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমারের খিলাফতকালে যখন জেরুজালেম মুসলমানরা দখল করে নেয় তখন জেরুজালেম সফর করে উমার দেখেন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া সেখানে কোন মসজিদ বা মন্দিরের চিহৃ নেই! তাহলে মুহাম্মদ মিরাজে গিয়ে বাইতুল মোকাদ্দেস বা মসজিদুল আকসায় নামাজ পড়ার যে দাবী করেছিলেন তার কি হবে? মিরাজের ঘটনার পর মুহাম্মদের কাছে বাইতুল মোকাদ্দেসের বর্ণনা জানতে চাইলে তিনি মসজিদের কতগুলো দরজা, জানালা, পিলার, গুম্বুজ সব বর্ণনা করে শোনান! কিন্তু মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলামী খিলাফত জেরুজালেম পর্যন্ত বিস্তৃত হলে উমার সেখানে গিয়ে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাননি!

যে কেউ হযরত মুহাম্মদের সময়কালের প্রাচীন ম্যাপ, ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই জানতে পারবেন মিরাজের কথিত ঘটনার সময় জেরুজালেমে কোন মন্দির বা মসজিদের অস্তিত্ব ছিলো না। উমারই সেখানে কাঠ দিয়ে সাধারণ মানের একটি মসজিদ তৈরি করেন। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে এখানে সুদৃশ্য নয়নাভিরাম একটি মসজিদ নির্মাণ করে। এটাই বর্তমান কালের ‘মসজিদুল আকসা’। এই হচ্ছে ইতিহাস। মুহাম্মদ এখানে বসবাস করেননি। তিনি ঐশ্বরিকভাবে এখানে ভ্রমণের কথা বলেছেন। বর্ণনা করেছেন সোলাইমানের মন্দিরের যেখানে আদৌ কোন মন্দিরই তখন ছিলো না। তাতেই জেরুজালেম হয়ে গেছে মুসলমানদের ইহুদীদের চাইতে বেশি দাবী! এতখানি দাবী যে এখানে তারা ছাড়া বাকীরা বহিরাগত! অন্যরা তীর্থ করতে আসবে মুসলমানদের অনুমতি নিয়ে! ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে ফিলিস্তিনিরা জেরুজালেমের মসজিদসহ অন্যান্য ‘ইসলামী স্থানগুলোর’ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে দিতে দাবী জানায়। ইজরাইল আরর যুদ্ধের পর ইজরাইল যুদ্ধে জিতে মসজিদুল আকসার ভার ইসলামী ওয়াকফ’র হাতে ন্যাস্ত করে দেয়। এর আগে বলতে গেলে জেরুজালেম ছিলো জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব চাচ্ছে এই ‘পবিত্র ভূমি’ কেবল মুসলমানদের হবে। তারাই এর নিয়ন্ত্রণ রাখবে। ইহুদীরা মুসলমানদের অনুমতি নিয়ে তীর্থ করতে পারবে। আমরা প্রায়ই তর্কের সময় বলি জেরুজালেম তিনটি প্রধান ধর্মেরই পবিত্রতম স্থান। যীশুকে জেরুজালেমেই ক্রুশে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। এখানেই শিশু যীশুকে নিয়ে মন্দিরে এসেছিলো মেরী। তাই খ্রিস্টানদের কাছে জেরুজালেম একটি তীর্থস্থান। ইহুদীদেরই মূলত জেরুজালেম ধর্মীয় কেন্দ্র। কারণ তাদের ঈশ্বর জিহোবা এখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে বলেছিলেন। এখানেই তাদের মুসার নেতৃত্বে বসবাস করতে বলেছিলেন। পক্ষান্তরে ইসলামের নবীর সঙ্গে জেরুজালেমের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তার মিরাজে গিয়ে জেরুজালেমে নামাজ পড়ার দাবী ঐতিহাসিক দলিলপত্র থেকেই জানা যায় এখানে তখন কোন মসজিদ বা মন্দির কিছুই ছিলো না।

এই হচ্ছে ধর্মীয় দাবীর কথা। কিন্তু মাটির কাছে মানুষের দাবী ধর্মের নয়, জন্মস্থানের। পূর্বপুরুষের। এই ভূমি তাই সেস্থানে বসবাস করা প্রতিটি ইহুদী, মুসলমান, খ্রিস্টানসহ আরো ছোট ছোট সম্প্রদায়ের সকলের। ‘পবিত্র ভূমি’ এই দাবী নিয়ে রক্ত আর সংঘাত ছাড়া আর কিছু দিতে পারবে না। দাবী তুলতে হবে তাই মানুষের পরিচয়ে। জন্মগতভাবে সব মানুষকে একদিন সমগ্র পৃথিবীই তার নাগরিত্ব মেনে নিবে…।